Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
book review

যে দেশে নদীরা খুব ভাল নেই

নদীর ‘স্বাভাবিক’ চরিত্র আর তাকে বদলে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় তাড়নার কথা বার বারই উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে। সহস্র ধারা বইটিতে সে বিষয়টিই আরও বিশদে আলোচিত।

বয়ে চলেছে নদি।

বয়ে চলেছে নদি।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:১৮
Share: Save:

নদীর অস্তিত্বের প্রথম কথা, তা এক চলন্ত সজীব জলধারা। এক জায়গায় পতিত অনেকখানি জলকে সে অপেক্ষাকৃত নীচের দিকে বইয়ে দেয়। এই কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ভূমির নিম্নতম জায়গাটি দিয়েই জল প্রবাহিত হয় এবং চলতে চলতে নীচের ভূমি ক্ষয় করার মাধ্যমে সে ওই নিচু জায়গার গভীরতা ক্রমশ বাড়িয়ে তোলে। ব্যাপারটা এক-দুই বছরের নয়, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলতে থাকে। সেই দীর্ঘ কাল ধরে কোনও নির্দিষ্ট স্থানের জল-মাটির সংস্থান হয়, লিখেছিলেন জয়া মিত্র, মাল নদীতে হড়পা বানে যখন তলিয়ে গেলেন বিসর্জনে অংশ নিতে আসা বহু মানুষ, সেই প্রসঙ্গে (‘প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করার ফল’, আবাপ, ১০ অক্টোবর ২০২২)।

নদীর ‘স্বাভাবিক’ চরিত্র আর তাকে বদলে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় তাড়নার কথা বার বারই উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে। সহস্র ধারা বইটিতে সে বিষয়টিই আরও বিশদে আলোচিত। এ বই যেন লেখকের ‘ভারত আবিষ্কার যাত্রা’, বইয়ের মুখবন্ধে বলেছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। গভীর সংবেদনশীল মন আর সাবলীল লেখায় উঠে এসেছে নদীর দুই তীরের মানুষদের জীবনচর্যাও, যাঁরা দীর্ঘ কাল লোভ আর পীড়নের শিকার। যেমন, সাহেবগঞ্জ থেকে সুলতানগঞ্জের কাছাকাছি পীরপৈঁতী পর্যন্ত আশি মাইল দৈর্ঘ্যে গঙ্গার উপর দুই জমিদার পরিবারের মালিকানা কায়েম ছিল। এই অঞ্চলের মধ্যে মাছ ধরতে হলে জেলেদের জাল-পিছু টাকা জমা দিয়ে পাট্টা নিতে হত। করের জুলুম, ফরাক্কায় বাঁধ নির্মাণের ফলে গঙ্গায় মাছের পরিমাণ হ্রাস এবং গঙ্গার ক্রমবর্ধমান দূষণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল এ অঞ্চলের দরিদ্র জেলে পরিবারগুলিকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় গঙ্গামুক্তি আন্দোলন। আন্দোলনের ইতিবৃত্তকে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে মিশিয়ে সুন্দর তুলে ধরেছেন লেখক।

সহস্র ধারা

জয়া মিত্র

৪০০.০০

লালমাটি

তুলে ধরেছেন যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে নদীকে আটকে, ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বিপজ্জনক প্রবণতার ছবিও। বহু দেশ যখন বড় বাঁধ নির্মাণের লাভ-ক্ষতির অনুপাত বিবেচনা করে দেখছে, তখন ভারতে কাজ চলছে মধ্যপ্রদেশে নর্মদার উপরে মহেশ্বর, গোসীর্খুদ ও বরর্গী বাঁধ, গঙ্গোত্রীর কাছাকাছি টিহরী বাঁধের। টিহরী বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে অনশন করেছেন সুন্দরলাল বহুগুণা। কিন্তু কাজ বন্ধ হয়নি। জাতীয়, আন্তর্জাতিক জনমতের বিপুল আপত্তি সত্ত্বেও ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে নর্মদার সর্দার সরোবর বাঁধের জলে ডোমখেড়ি ও জলসিন্ধি গ্রাম দু’টি। রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু সম্মেলনে মহাসচিব বলেছেন, আমরাপরিবেশ নরক-গামী হাইওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছি, আর আমাদের পা অ্যাক্সিলারেটর-এর উপরে চাপ দিচ্ছে। অথচ, এই দেশের নেতৃত্ব সেই মহাবিপর্যয়েরসামনে দাঁড়িয়েও পরিবেশকে উপেক্ষা করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও লুণ্ঠনে সমর্থন জোগাচ্ছে। যে দেশের নামের আগে ‘সুজলা’ শব্দটি বসে, সেখানকার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রয়োজন মতো পানীয় জল পান না। বৃহৎ কোম্পানিগুলো দেশের ক্রমশ দুর্লভ হতে থাকা ভূজল যথেচ্ছ তুলে, এ দেশেরই অর্থে নিজেদের সমৃদ্ধ করে, দেশ ভরায় প্লাস্টিকের আবর্জনায়।

লেখক যথার্থই বলেছেন, ভারতের মতো নদীমাতৃক সভ্যতায় অসুখের চিহ্ন স্পষ্ট হয় নদীরা ভাল না থাকলে। তাই এখনই এর প্রতিকার প্রয়োজন। তার সম্ভাব্য পথটি অবশ্য এ বইয়ে স্পষ্ট নয়। কিন্তু সে পথ খোঁজার দায়িত্বও তো লেখকের নয়। দায়িত্ব নেবে সম্মিলিত রাষ্ট্রশক্তি। তাদের শুধু মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন এই অপূরণীয় ক্ষতির পরিমাণ এবং অমোঘ প্রভাব সম্পর্কে। সে কাজটি সুসম্পন্ন করতে এমন আরও অনেক বইয়ের প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy