নক্ষত্র: ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অনুষ্ঠানে বড়লাট লিনলিথগো, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এ কে ফজলুল হক, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, মেঘনাদ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ ১৯৩৮।
ভারতে ১৯৯০-এর দশক থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইতিহাসচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে মান্যতা লাভ করে। প্রাথমিক পর্বে যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। ২০০০ সালে ডেভিড আর্নল্ড আক্ষেপ প্রকাশ করে বলছিলেন যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুস্পষ্ট গুরুত্ব সত্ত্বেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের মধ্যবর্তী সময়কাল সে ভাবে ইতিহাসবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। তৎকালীন ইতিহাসচর্চার মূল উপপাদ্য বিষয় উপনিবেশে (এ ক্ষেত্রে ভারত) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রকৃতি (ওয়েস্টার্ন/ ইন্ডিজেনাস/ কলোনিয়াল) এবং তার বিস্তার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বিতর্ক— জর্জ বাসাল্লা, ড্যানিয়েল হেডরিক, মাইকেল অ্যাডাম, দীপক কুমার, ধ্রুব রায়না, কপিল রাজ প্রমুখ যে আলোচনায় অগ্রগণ্য। তাঁদের আলোচনায় ঔপনিবেশিক ভারতে বিজ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতা, সাম্রাজ্যনির্ভরতা সংক্রান্ত ধারণাগুলি প্রাধান্য পেয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনের শেষ দশকগুলি নিয়ে যে কতিপয় ইতিহাসবিদ গবেষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে জগদীশ এন সিংহ পথিকৃৎ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল থিসিস থেকে পরে বই হিসাবে সায়েন্স, ওয়র অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজ়ম-এর আত্মপ্রকাশ ২০০৮ সালে। জগদীশবাবু প্রাক্-বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতে বিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতি বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ-পরবর্তী কালে তার অভিরূপ কী হয়েছিল, সে বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোকপাত করেন। তাঁর মূল যুক্তি হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতে মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিকাশ ব্যাহত হয়েছিল, যার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল ১৯৪৭ সালের পরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
লেখক ভারতে বিজ্ঞানচর্চার ঔপনিবেশিক গতিপ্রকৃতির উপর জোর দিয়েছেন এবং তার সঙ্গে ব্রিটেন, এবং কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো ‘হোয়াইট সেটলার কলোনি’র বিজ্ঞানচর্চার যে পার্থক্য বিদ্যমান, তা তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, তার প্রেক্ষাপটে তিনি ভারতের অবস্থান বর্ণনা করেছেন। তাঁর আলোচনায় উঠে এসেছে যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে এবং সময়কালে বৈজ্ঞানিক নীতি ও পরিকল্পনার পরিবর্তন, ভারতে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং বিভিন্ন ঔপনিবেশিক নীতির দেশীয় প্রতিক্রিয়া। যুদ্ধের পূর্বে ভারতে বিজ্ঞানের প্রতি ঔপনিবেশিক মনোভাবকে তিনি কোনও ক্রমে জোড়াতালি দিয়ে চালানোর মানসিকতা বলে বর্ণনা করেছেন, যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বল্পমেয়াদি চাহিদা পূরণের যন্ত্র। যা-ই হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই অবস্থানের এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, কারণ তা ঔপনিবেশিকতা থেকে জাতীয়তাবাদ এবং পরিশেষে স্বাধীনতা লাভের প্রক্রিয়াতে অনুঘটকের কাজ করেছিল। এই সময়কাল ছিল জাতীয় পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার।
সায়েন্স, ওয়র অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজ়ম: ইন্ডিয়া ইন দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়র
জগদীশ এন সিংহ
১৪৯৫.০০
মনোহর
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী পর্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে ঔপনিবেশিক নীতির ব্যর্থতার প্রতি জগদীশ সিংহ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাসের জন্য প্রণীত ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলির মধ্যে সমন্বয়ের ব্যাঘাত ঘটায়— গড়ে ওঠে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। কৃষি, শিল্প এবং স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণে পাঠানো হলেও, রাজস্ব রয়ে গেল কেন্দ্রের হাতে। এর ফলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হল অত্যধিক আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে। এমন এক সময়ে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বভার গ্রহণ করলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান এবং আধুনিক শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং ডিপ্রেশন ইতিমধ্যেই ধুঁকতে-থাকা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা এবং প্রযুক্তি শিক্ষাকে আরও দুর্বল করে দেয়। ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করেছিল এক সুসংগঠিত বৈজ্ঞানিক ও শিল্পনীতি ব্যতিরেকে।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাথমিক পর্বে সাম্রাজ্যের সামরিক ও কৌশলগত চাহিদা পূরণে উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ সরকার ভারতে শিল্প উৎপাদন ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কিছুটা হলেও মনোনিবেশে বাধ্য হয়। যে ক্ষেত্রগুলি উল্লেখযোগ্য সহায়তা লাভ করেছিল, যেমন কৃষি, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য, পরিবহণ প্রভৃতি— লেখক তার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। দেখিয়েছেন, সরকারের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিল যুদ্ধকালীন প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বজায় রাখা এবং তার বৃদ্ধি ঘটানো। তবে তিনি ঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করেননি কেন শক্তি এবংবিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রকে অবহেলা করা হয়েছিল, বা তাদের এই অবহেলা সরাসরি যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না।
জগদীশ সিংহের আর্কাইভ-নির্ভর প্রাথমিক অধ্যায়গুলি যেন অনেকটা ব্যর্থ ঔপনিবেশিক কমিশন এবং কমিটির সঙ্কলন বলে মনে হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ভারতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, যা পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আলোচিত হয়েছে, লেখকের গভীর বিশ্লেষণী মননের পরিচয়বাহী। ১৯৪২ সালে গঠিত ‘কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’ যুদ্ধোত্তর ভারতে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পটভূমি রচনা করে। ১৯৪৩ সালে নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক এবং রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি এ ভি হিল-এর ভারত সফর ও তার রিপোর্ট জাতীয় পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণার অপরিহার্যতাকেই যেন পরিস্ফুট করে। আসন্ন স্বাধীনতার হাতছানি, এশিয়ায় উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আমেরিকার উত্থান এবং ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে গান্ধীবাদী, সোভিয়েট ও পুঁজিবাদী মতবাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সমগ্র পরিস্থিতিকে করে তোলে অত্যন্ত জটিল।
প্রথম সারির ভারতীয় বিজ্ঞানীদের রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান বৈজ্ঞানিক নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা রূপায়ণের ক্ষেত্রে এক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আমদানি করেছিল। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান আর এই জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের সংমিশ্রণে যে ‘হাইব্রিড’ সৃষ্টি হল, তাতে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান (চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, মেঘনাদ সাহা, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা প্রমুখ) যত্ন সহকারে বর্ণনা করেছেন জগদীশ সিংহ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত তথ্য এবং ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম নির্মাণে তার ব্যবহার সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের কাছে শিক্ষণীয়। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ জুড়ে প্রকাশিত বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার পত্রপত্রিকায় যে অমূল্য সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে তার হদিস কিন্তু এই বইতে পাওয়া যায় না।
কেউ বলতেই পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে জোসেফ নিডহ্যাম-এর বিখ্যাত প্রশ্নটি লেখক আবার তুলেছেন— কেন উত্তর আমেরিকা বা ব্রিটেনের তুলনায় ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক বিজ্ঞানের যাত্রাপথ মসৃণ হয়নি? বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে ভারতীয় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্মেষের গল্পটিকে শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক নির্ভরশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা আর বোধ হয় ঠিক নয়। তবে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা অবশ্যই উপেক্ষা করা যায়। বইটি ব্রিটিশ ভারতে বৈজ্ঞানিক এবং শিল্প গবেষণার ঘটনাক্রম নির্মাণে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন সন্দেহ নেই। জগদীশবাবু বহু নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা উত্তর-ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানের ইতিহাসচর্চাকারীদের এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। সাধুবাদ প্রাপ্য বইটির বর্তমান প্রকাশকেরও, দক্ষিণ এশিয়ার পাঠকদের এক সুলভ সংস্করণ উপহার দেওয়ার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy