Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Book Review

কার স্বাধীনতা, কে মাসুল গোনে

বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে বেলা ভাটিয়া কাজ করেছেন বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতি ও দলিত বর্গের মধ্যে, যাঁরা ক্ষমতার দাপটে ক্রমাগত বিপন্ন এবং বিপর্যস্ত।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২৪ ০৭:১৭
Share: Save:

বছরখানেক আগে রচিত ভূমিকায় গ্রন্থকার লিখেছেন, “আমার আশা, এ-বইয়ের নিবন্ধগুলি ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রসাধনী চরিত্রটিকে উদ্ঘাটিত করে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি সময়মতো এবং যথাযথ ভাবে দেশের মানুষের ক্ষোভের প্রতিকার করতে পেরেছে, এমন একটা কাহিনিও এখানে নেই। এবং সেই সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের দমনপীড়নকে আটকাতেও ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো দিকে, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সুকৌশলে বহাল রেখেছে স্থিতাবস্থাকেই, যে স্থিতাবস্থার সুফল কুড়োয় উচ্চকোটির ন্যূনাংশিকেরা, আর তার মূল্য দেন ভারতীয় সমাজের বৃহদাংশিক মানুষ।”

অতিরিক্ত কঠোর সিদ্ধান্ত? একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি? সাড়ে পাঁচশো পৃষ্ঠা উল্টে পৌঁছনো যাক বইটির উত্তরকথা অংশে। সেখানে আমরা পড়ি দু’টি সংক্ষিপ্ত এবং সুতীক্ষ্ণ বাক্য: “অবশ্যই এখানে সকলের হয়ে কথা বলা হচ্ছে না।” কেনই বা বলা হবে? বেলা ভাটিয়া নিছক মেধাবী সমাজবিজ্ঞানী নন, তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের অনেকগুলি রাজ্যের দরিদ্র, অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, আক্ষরিক অর্থে সর্বহারা নাগরিকদের মধ্যে বাস করে, তাঁদের জীবন নামক অন্তহীন লড়াইয়ের বিশ্বরূপ দর্শন করে, নিজেকে সেই সংগ্রামে জড়িয়ে নিয়ে এবং তার ফলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এই লেখক মর্মে মর্মে জানেন, বহুমাত্রিক বৈষম্যে কণ্টকিত সমাজে ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ মানে আসলে কী! অতএব ‘সকলের হয়ে’ কথা বলার অলীক কুনাট্য পরিত্যাগ করে তাঁকে স্থির করে নিতে হয়েছে, কাদের হয়ে কথা বলতে হবে। তিনি লিখেছেন সেই সংখ্যাহীন মার-খাওয়া ভারতবাসীর কথা, হাতে হাত মিলিয়ে যাঁদের জীবনকে এক দিকে ক্রমাগত লুণ্ঠন করেছে উত্তরোত্তর আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র, ক্রমশ অতিকায় হয়ে ওঠা পুঁজি, এবং জাতপাত বর্ণভেদ আর সঙ্কীর্ণতার দুর্মর ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ, আর অন্য দিকে যাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়াকে, ন্যূনতম অধিকারকে, এমনকি অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে এই সর্বগ্রাসী ক্ষমতার তন্ত্র। তাই এ-বইয়ের অনিবার্য শিরোনাম: ভারতের ভুলে-যাওয়া দেশ। ভারতের বিবিধ ‘প্রান্তদেশ থেকে দেখা’ সে আর এক দেশ, আর এক ভারত।

নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধ থেকে শুরু করে ২০২০ পর্যন্ত প্রকাশিত (এবং দু’-একটি ক্ষেত্রে অপ্রকাশিত) পঁচিশটি নিবন্ধে দেশের যে সব রাজ্য বা অঞ্চলের কথা আছে, তারা হল: গুজরাত, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, কাশ্মীর, মেঘালয়, মণিপুর ও নাগাল্যান্ড। এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে বেলা ভাটিয়া কাজ করেছেন বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতি ও দলিত বর্গের মধ্যে, যাঁরা ক্ষমতার দাপটে ক্রমাগত বিপন্ন এবং বিপর্যস্ত। ‘উন্নয়ন’ নামক আধুনিক মহাবিদ্যার ছলেই হোক অথবা সরাসরি কাঙালের ধন লুণ্ঠন করে রাজা মন্ত্রী সওদাগরদের শ্রীবৃদ্ধির আদিম পদ্ধতিতেই হোক, ক্ষমতা সতত সক্রিয়, ক্লান্তিহীন। “রাজস্থানের দলিত, বিহারের মজদুর (খেতমজুর), বস্তারের আদিবাসী, গুজরাতের বিধবা, নর্মদা উপত্যকার উচ্ছিন্ন মানুষ, মেঘালয়ের ছাত্রছাত্রী, (দিল্লির) সঞ্জয় বস্তির আবাসিক এবং কাশ্মীর বা নাগাল্যান্ডের অধিবাসীরা, সকলেই প্রাণপণ লড়াই করে চলেছেন সেই সব শক্তির বিরুদ্ধে, যারা তাঁদের স্বাধীনতা তথা স্বক্ষমতাকে খর্ব করে।”

ইন্ডিয়া’জ় ফরগটন কান্ট্রি: আ ভিউ ফ্রম দ্য মার্জিনসবেলা ভাটিয়া

১২৯৯.০০

পেঙ্গুইন ভাইকিং

এই নিরবচ্ছিন্ন স্বাধীনতা-হরণের কাহিনিগুলি প্রত্যেকে একে অপরের থেকে আলাদা। কিন্তু সমস্ত কাহিনি থেকেই ক্রমাগত উঠে আসতে থাকে সেই অমোঘ প্রশ্ন: কার স্বাধীনতা? প্রান্তে বাস করা, আড়ালে থাকা, তফাতে রাখা অগণন ভারতবাসীর যে-সব স্বাধীনতাকে আমরা মূল্য দিই না, লক্ষও করি না, এই বইয়ের পাতায় পাতায় সেগুলির স্বরূপ উন্মোচিত হয়, উন্মোচিত হয়ে চলে ওই স্বাধীনতা হরণের ভয়ঙ্কর সব দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়েই। যেমন, গুজরাতের সেচ-সেবিত শস্যক্ষেত্রের শোভায় মুগ্ধ দর্শককে খেয়াল করিয়ে দেওয়া হয়, সম্পন্ন ভূস্বামী আর কৃষি-ব্যবসায়ীদের সমৃদ্ধির রসদ জোগাতে গিয়ে কী ভাবে ভূজলের ভান্ডার শোষণ করে নেওয়া হয়েছে আর তার ফলে অন্তহীন খরার শিকার হয়ে চলেছেন দরিদ্র, বঞ্চিত অধিবাসীরা। এই অধ্যায়ের স্মরণীয় শিরোনাম: ‘লাশ ফিল্ডস অ্যান্ড পার্চড থ্রোটস’। আবার, তার ঠিক পরেই আমরা চলে আসি বর্তমান ঝাড়খণ্ডে, যেখানে বহু দশক ধরে ভূগর্ভ থেকে ইউরেনিয়াম নিষ্কাশনের মাসুল গনে চলেছেন জাদুগড়া ও সন্নিহিত এলাকার মানুষ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আক্ষরিক অর্থে ধনেপ্রাণে মরছেন তাঁরা, অথচ প্রশ্ন তুললে বরাবর একই জবাব শুনেছেন: দেশের আত্মরক্ষার জন্য পারমাণবিক শক্তি জরুরি। লেখকের প্রতিপ্রশ্ন: দেশ মানে কী? কার আত্মরক্ষার কথা বলছি আমরা, কাদের জীবনকে তছনছ করে সেই আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? উত্তর আমাদের জানা। তাই আমরা প্রশ্নটাই উচ্চারণ করি না।

বিদেশি শাসক থেকে স্বদেশি শাসকের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় আট দশক পরেও যখন গণতন্ত্র নামক প্রদীপের নীচে পিলসুজের গা বেয়ে তেল গড়িয়ে পড়তেই থাকে এবং আলোকপ্রাপ্তরা সে দিকে ফিরেও তাকায় না, তখন স্বাধীনতার হারানো অর্থ খোঁজার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় সংঘাত। রাজস্থানের দলিত, বিহারের মজদুর, বস্তারের আদিবাসী... “কোনও না কোনও ভাবে সংঘাতই তাদের জীবনকে চালনা করে।” সেই সংঘাতের রূপ কী হবে, কেমন ভাবে তার প্রকাশ ঘটবে, সেটাও অবশ্যই গুরুতর প্রশ্ন। অনাচারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া-বাঁধা অতিকায় পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ হিসেবে যাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামকে বেছে নিয়েছেন, লেখক তাঁদের সংগ্রামকে গভীর ভাবে এবং কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, সে বিষয়ে তাঁর বিশদ বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা লিখেছেন একাধিক নিবন্ধে। ‘হিংসা নয়, শান্তি চাই’ মার্কা অসার কথামৃত পরিবেশনে তাঁর স্বভাবতই কোনও রুচি নেই। কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং নিরন্তর চিন্তানুশীলনের ভিত্তিতে তিনি একটি ধারণায় পৌঁছেছেন, গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার সত্যমূল্য উদ্ধারের জন্য যে ধারণা কেবল মূল্যবান নয়, অপরিহার্য।

তার নাম জনসংযোগ। ম্যারাপ বেঁধে স্লোগান এবং বক্তৃতা শোনানোর রুটিন নয়, মার-খাওয়া এবং ভুলে-থাকা লোকসমাজের সঙ্গে প্রকৃত সংযোগ। দেশের আরণ্যক অঞ্চলের উগ্র-বামপন্থী হিসেবে পরিচিত গোষ্ঠীগুলির উদ্দেশে তিনি যা বলেছেন, তার মূল প্রতিপাদ্য হল: তারা ‘লোকের প্রকৃত সমস্যার সঙ্গে নিজেদের লক্ষ্যকে যতটা মিলিয়ে নিতে পারবে, তাদের আন্দোলন ততটাই জোরদার হবে।’ তাঁর বক্তব্য, যেখানেই আন্দোলনের ভিতর থেকে এই ধরনের সমন্বয় ঘটেছে, নানা সংগ্রামী দল ও গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে বা অগ্রাহ্য করে তাদের ‘গণ ফ্রন্ট’গুলি মানুষের কাছে পৌঁছেছে এবং তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছে, সেখানেই কাজ হয়েছে। ক্ষমতাবানদের সাধারণ লোকের কথা শোনানোর— শুনতে বাধ্য করার— কাজ।

ওইখানেই ভরসা। এ-বইয়ের উত্তরকথার নাম: শেষ পাতা। নামটি ও হেনরি-র প্রসিদ্ধ গল্প থেকে নেওয়া; গল্পের শেষে প্রবীণ শিল্পী, বিদায় নেওয়ার আগে, দেওয়ালে একটি পল্লব এঁকে তাঁর তরুণ প্রতিবেশিনী ও সহরোগিণীকে বাঁচার আশাটুকু দিয়ে যান। বেলা লিখেছেন, এই অন্ধকার সময়ে আমাদের সকলেরই একটা শেষ পাতা দরকার। চার দশকের ভারত-দর্শনে তিনি সেই পাতাটির সন্ধান পেয়েছেন দেশের অগণন মানুষের মধ্যে, ‘অন্যায় ও হিংস্রতা’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁদের ‘সাহসী ও নিঃস্বার্থ’ সংগ্রামের মধ্যে। সেটাই যথার্থ স্বাধীনতা সংগ্রাম।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy