কোনও কোনও লেখক প্রথম উপন্যাসেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেন। আত্মপ্রকাশে উন্মুখ বোহেমীয় তারুণ্য, ঘুণপোকার কুরে কুরে অস্তিত্বকে খাওয়া, পৌরুষের একক প্রদর্শনী বা রেসকোর্সের দৌড় তার সাক্ষী। সুনীল, শীর্ষেন্দু, সন্দীপন, সমরেশ মজুমদার, নকশাল আন্দোলন, বাম জমানা পেরিয়ে বহু বছর পরে সেই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন দার্জিলিঙের সিংতাম চা বাগানের ছেলে বিমল লামা। কার্শিয়াং, দার্জিলিং, কালিম্পঙের উত্তাল গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের পটভূমিতেই লিখেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস নুন চা। একই পটভূমিতে বেরিয়েছিল কিরণ দেশাইয়ের বুকারজয়ী দি ইনহেরিট্যান্স অব লস। দুই দৃষ্টিভঙ্গিতে ফারাক ছিল। কিরণের উপন্যাসে কালিম্পঙের ডেয়ারি শিল্প, গ্রাহামস হোম মরণাপন্ন হয়ে পড়া, উচ্চবর্গের বাদামি সাহেবদের আতঙ্ক ইত্যাদি ছিল। আর বিমলের উপন্যাসে ফুটে ফুটে বেরিয়েছিল আনাজ বিক্রেতা, গাড়িচালক, কুলি ইত্যাদি নিচুতলার নেপালিদের যন্ত্রণা। বাংলায় না হলেও ভারতের অন্য ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যে মাঝে মাঝেই এ রকম আশ্চর্য সমাপতন ঘটেছে। দেশভাগ ও দাঙ্গার আগুনে ট্রেনযাত্রা নিয়ে ইংরেজিতে খুশবন্ত সিংহের ট্রেন টু পাকিস্তান আর উর্দুতে কৃষণ চন্দরের পেশোয়ার এক্সপ্রেস।
লোচন দাস শব্দকর-এ সে রকম সমাপতন ঘটেনি, ঘটার কথাও ছিল না। করিমগঞ্জ, শিলচর, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ হাওর বা জলাশয়ের পটভূমিকায় লেখা এই আখ্যানে লালন থেকে শাহ আব্দুল করিমের বাউলগানের মূর্ছনা আছে, আছে সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে নদীস্রোতে গরু পাচার, বেনাগরিক বা ডি-ভোটার হয়ে অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে থাকা, রংচটা পোঁটলায় কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি, ভারতের ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে এ পার-ও পার যাতায়াত, কখনও বা লন্ডনে উড়ান, বাউল-ফকিরদের গানে ইউটিউবে কয়েক হাজার ‘লাইক’ ইত্যাদি অনেক কিছু। তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসে কবিগান বা কালকূটের কোথায় পাবো তারে উপন্যাসেও বাউল, ফকিরদের আনাগোনা ছিল। সুধীর চক্রবর্তী বা শক্তিনাথ ঝাবা বাংলাদেশের আবুল আহসান চৌধুরীর মতো গবেষকদের কথা ছেড়ে দিলাম। তাঁরা মূলত বাউলের সমাজতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, দার্শনিকতা, গানের ঐতিহাসিকতা, সাধনা ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। সেগুলি ‘নন ফিকশন’ অবশ্যই! কিন্তু ফিকশন-নন ফিকশনে সেই বিভেদ আজকাল লুপ্ত। সাহিত্য দুই চাকাতে ভর করেই এগোয়।
সেই নন-ফিকশনের চাকায় ভর করে লোচন দাস শব্দকর এগিয়েছে অনেকটাই। এই উপন্যাস বাউল-ব্যবসা নিয়ে। লোচন, সিতারাদের মেক-আপ করিয়ে ইউটিউবে ভিডিয়ো আপলোড করা হয়। তাতে ঝটিতি কয়েক হাজার লাইক। ইমরুল নিজের উদ্যোগে তাদের লন্ডনে নিয়ে আসে। সেখানকার অনুষ্ঠানও হিট। কিন্তু চুক্তিপত্রে বাউলদের আলাদা সম্মান-দক্ষিণা দেওয়ার কথা নেই। ফলে সিতারা, পারুরা রেগে যায়। ইমরুল ও তার স্ত্রীর সঙ্গে লন্ডনের মাটিতেই তাদের ঝগড়া বাধে। প্রত্যুত্তরে ইমরুল ব্ল্যাকমেল শুরু করে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে আসা লোচন যে আদতে ভারতের ডি-ভোটার, সে এখনই জানিয়ে দেবে সবাইকে। উপন্যাস সাফ জানাল, আর পাঁচটা বিনোদনের মতো বাউল, ফকিররাও এখন পণ্যায়নের শিকার, তাঁদের উপরে লগ্নি করা হয়, কিন্তু লভ্যাংশ তাঁরা পান না।
লোচন দাস শব্দকর
বিমল লামা
৭৫০.০০
আনন্দ
দ্বিতীয়ত, যা ছিল গুহ্য সাধনা, উপন্যাস তাকে এনে দিল প্রকাশ্যে। সিতারা, ইয়াসমিন, পারুদের সঙ্গে লোচনের দমের খেলা। তারা মাঝে মাঝেই এ ওকে বলে, ‘তোমার চন্দ্র আমাকে দাও’। তার পর লোচনের লুঙ্গির নীচে হাত ঢোকায়, লোচন তাদের সায়ার নীচে। নারী পান করে বীর্য, পুরুষ রক্তমাখা স্ত্রীরস। এ সব আর গুহ্যতত্ত্ব নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহম্মদ আব্দুল করিম মিঞা কয়েক বছর আগে তাঁর বাউল-লালন পরিভাষা বইয়ে জানিয়েছিলেন, “রজঃ, শুক্র, বিষ্ঠা ও মূত্র বাউল ফকির বৈষ্ণবরা এই চার চন্দ্র সাধনা করে।” আরও লিখেছিলেন, চন্দ্র বলতে বাউলরা নারীকে বোঝায়, আর চন্দ্রের অমাবস্যা বলতে নারীর ঋতুকাল। এই পরিভাষাগুলি জানতে হবে। লালনের গান ‘মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে’ থেকে যে মনের মানুষ শব্দবন্ধ তুলে এনে সুনীল উপন্যাস লেখেন, গৌতম ঘোষ ছবি করেন, সেই শব্দ দু’টি কোনও রবীন্দ্রনাথ বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বোঝায় না। দেহস্থিত পরম সত্তা বা আত্মাকেই বাউলরা ‘মনের
মানুষ’ বলেন।
তৃতীয়ত, চট্টগ্রাম, ঢাকা, বরিশালের চেনা মাটি ছেড়ে এই উপন্যাস পাড়ি দিয়েছে শ্রীহট্টের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে। যে বিশাল জলাভূমির এ পার-ও পার দেখা যায় না। এখানেই ছিল হাসন রাজার জমিদারি— ‘কী ঘর বানাইনু আমি শূন্যের মাঝার’ বলে গান বেঁধেছিলেন তিনি। শিকার ধরার জন্য ইগলের মতো বিশাল কুড়া পাখি পুষতেন। হাওর অঞ্চলের জীবন নিয়ে গত বছরই বেরিয়েছিল মুহাম্মদ কাইউমের ছবি কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া। কলকাতার মঞ্চেও এখন হাসন রাজাকে নিয়ে নাটক। আধোচেনা হাওরের সূত্রে দুই বাংলাকে মিলিয়ে দিল লোচন দাস।
সেখানেই হালকা আপত্তি। ‘যখন ছিলাম শূন্যে ভাসমান তুমি ছিলে কোথায় হায় রে’, লোচনদাস কারিগর নামে তাঁর ক্ষীণতনু কাব্যগ্রন্থটিতে লিখেছিলেন উৎপলকুমার বসু। মহাভারতের অর্জুনকে নিয়েও কেউ এখন উপন্যাস লিখলে শরণার্থী নিয়ে সুনীলের উপন্যাস মনে পড়বেই। মানবজমিন যতই শূন্যে পতিত থাকুক, ওই নামে পঞ্চাশ বছর পরেও কেউ উপন্যাস লিখলে সেখানে থেকে যাবে শীর্ষেন্দু-স্মৃতি।
আখ্যানে মাঝে মাঝেই জাদুবাস্তবতার ব্যবহার। “লোচনের মনে হয় তার রক্ত মাংস হাড় মজ্জা সবকিছু গলে গিয়ে মিশে যাচ্ছে হাওরের জলে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মানুষ থেকে হয়ে যাবে জল। আর সকালে যখন রোদ আসবে, তার তাপে ধীরে ধীরে সে বাস্প হয়ে ভেসে যাবে বাতাসে। মহাশূন্যের কাছাকাছি ভেসে থাকবে মেঘ হয়ে।” এক দিকে ম্যাজিক্যাল রিয়ালিটি, আর এক দিকে মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয়, সর্বগুণান্বিত ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নায়ক। পতাকা বিক্রেতা লোচন জীবনে প্রথম গান বাঁধলেও সবাই মন্ত্রমুগ্ধ, রহিমা ও পারু তাকে একই ভাষায় বলে, ‘তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব ঝান্ডিওয়ালা’। এই নায়কত্ব শাপমোচন বা গুরুদক্ষিণা ছবিতে থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনাময় উপন্যাসে কেন? আর বারংবার ফিরে এসেছে চেনা ‘ট্রোপ’। অনেকেই গাঁজা খায়, ফুলটিয়ার আশ্রমে আগুন ঘিরে সবাই মনের মানুষ সিনেমার মতো নাচানাচি করে। প্রেমের কথা বলতে গিয়ে গান নিয়ে সলমন রুশদির উপন্যাস দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার
ফিট-এ ফিরে এসেছিল অর্ফিউসের উপাখ্যান, এখানে সেই শক্তিমত্তা নেই। বিন্দুধারণ হল না, দমের খেলায় লোচন ও তার লেখক দু’জনেই মাঝ পথে স্খলিত হলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy