—প্রতীকী চিত্র।
১৯৩১ সালে বাংলা ছবি সবাক হল। প্রথম সবাক ছবি স্বল্পদৈর্ঘ্যের জামাইষষ্ঠী এবং প্রথম সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র দেনাপাওনা— দুয়েতেই গানের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায় (দ্র. ডিরেক্টরি অব বেঙ্গলি ফিল্মস/ তথ্য-সংস্কৃতি দফতর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০১৮)। কিন্তু এ দু’টি তো বটেই, ১৯৩১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছয়টি বাংলা সবাক ছবির কোনওটিরই গানের কোনও গ্রামোফোন রেকর্ড বেরোয়নি। ১৯৩২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নয়টি ছবির মধ্যে মাত্র একটি (চণ্ডীদাস) এবং ১৯৩৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১১টি ছবির মধ্যে মাত্র দু’টির গানের (যমুনা পুলিনে, মীরাবাঈ) রেকর্ড বেরিয়েছিল। আরও আশ্চর্যের কথা এই, যে ম্যাডান কোম্পানি বাংলা ছবিকে সবাক করার ব্যাপারে সর্বপ্রথম উদ্যোগী হয়েছিল, তাদের ব্যানারে তৈরি কোনও ছবিরই গানের রেকর্ড বেরোয়নি।
কথাগুলো মনে এল বেঙ্গলি ফিল্ম আলমানাক: আ স্টাডি অব গ্রামোফোন রেকর্ডস, প্রথম খণ্ড (১৯৩২-১৯৫০) বইটি পড়তে গিয়ে। এ বইয়ে বাংলা ছবির গানের রেকর্ডের তালিকা শুরু হচ্ছে চণ্ডীদাস দিয়েই। চণ্ডীদাস মুক্তি পায় ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে। তার তিন দিন পর ম্যাডানদের কৃষ্ণকান্তের উইল। আনন্দবাজার পত্রিকা-র পুরনো সংস্করণ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ম্যাডানরা ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছেন, “বহু ব্যয়ে ও বিপুল পরিশ্রমে ইহাকে সবাক নৃত্যগীতমুখর চলচ্চিত্র করা হইল।” অথচ তার গ্রামোফোন রেকর্ড বার করার কোনও প্রয়াস তাঁরা করেননি। কে না জানে, উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি, দুই-ই ইতিহাসে সমান বাঙ্ময়! রেকর্ড-তালিকায় চণ্ডীদাস-এর পরের ছবিই তাই যমুনা পুলিনে।
বাংলা ছবির গ্রামোফোন রেকর্ডের এই তথ্যপঞ্জির প্রথম খণ্ড শুরু হয়েছে চণ্ডীদাস-এ, শেষ হয়েছে তথাপি ছবিটিতে। এই কালখণ্ডে প্রকাশিত প্রতিটি ছবির গানের গ্রামোফোন রেকর্ডের তথ্য (রেকর্ড নম্বর, রেকর্ড সংস্থা, সঙ্গে আরও আনুষঙ্গিক তথ্য) এক জায়গায় জড়ো করা যে কী সুদীর্ঘ অধ্যবসায় এবং সুবিশাল সংগ্রহের উপরে নির্ভরশীল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্কলক-সংগ্রাহক সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় এবং সঞ্জয় সেনগুপ্ত তার জন্য ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকলেন, সেই সঙ্গে আরও অনেক প্রশ্ন এবং কৌতূহলের দরজাও খুলে দিলেন।
যেমন ধরা যাক, সুশান্ত এবং সঞ্জয় যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, এইচএমভি থেকে এ ছবির গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল দু’টি— পি.১১৭৬৪ এবং এইচটি.২। ওঁরা লিখেছেন, এইচটি.২ বেরিয়েছিল ১৯৩৩ সালে। তার মানে ছবি মুক্তির বেশ কয়েক মাস পর। অন্য রেকর্ডটি কবে বেরোল, উল্লেখ থাকলে হিসাবটা স্পষ্ট হত। কোন সময় থেকে ছায়াছবির গান তার নিজস্ব বাজার তৈরি করল, বুঝতে সুবিধা হত। রেকর্ড প্রকাশের তারিখ জানা থাকলে ছবি মুক্তি আর রেকর্ড বেরোনোর মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান কী ভাবে ক্রমশ কমে আসছে, তার একটা আন্দাজ তৈরি হত। যেমন দেখা যাচ্ছে, ১৯৩৫ সালে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২৬টি বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছিল। তার মধ্যে রেকর্ড বেরিয়েছিল সাতটির।
বেঙ্গলি ফিল্ম আলমানাক: আ স্টাডি অব গ্রামোফোন রেকর্ডস, প্রথম খণ্ড (১৯৩২-১৯৫০)সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় সেনগুপ্ত
৮০০.০০
উত্তরণ পাবলিশার্স
আসলে এই ধরনের আকরগ্রন্থের জন্য একটি বিশদ ভূমিকালিখন খুব প্রয়োজন হয়। সঙ্কলকদ্বয় সেটি ভেবে দেখতে পারতেন। যেমন, রেকর্ড লেবেলে কতটুকু তথ্য সংযোজিত হচ্ছে, কতটুকু হচ্ছে না, তথ্য সংযোজনের ধারা কী ভাবে বদলাচ্ছে, তার একটা আলোচনা থাকতে পারত। রেকর্ড লেবেলে তথ্যের অপ্রতুলতা হেতু সঙ্কলকেরা বহু তথ্য নিজেরা সংযোজন করে দিয়েছেন। ছবির মুক্তির বছর, প্রযোজনা সংস্থা, মূল অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকার নাম তাঁরা ‘এন্ট্রি’তে জুড়ে দিয়েছেন। খুব ভালই করেছেন। কিন্তু এর কোন তথ্য রেকর্ড লেবেলে ছিল আর কোন তথ্য বাইরে থেকে সংযোজন, তার ফারাকটা সর্বত্র খুব স্পষ্ট নয়। রেকর্ড লেবেলের তথ্য আর বাইরের তথ্য আলাদা সারণিতে থাকলে পাঠকের পক্ষে বুঝতে আরও সুবিধা হত। আর সারণি জিনিসটাই এমন যে, লম্বালম্বি সাজানো হলে তা চোখের পক্ষে আরামদায়ক হয়, অনুধাবনের পক্ষেও সহজ হয়। পরবর্তী খণ্ডের অঙ্গসজ্জার ক্ষেত্রে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
তথ্যের অপ্রতুলতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, সে সময় বহু ক্ষেত্রেই গায়ক-গায়িকার নামোল্লেখ থাকত না। সঙ্কলকেরা কিন্তু কণ্ঠশিল্পীর একটি সারণি রেখেছেন। কিন্তু সেখানে সব সময় শিল্পীর নাম দেওয়া হয়নি। ছবির বুকলেট এবং রেকর্ড লেবেলে অনেক সময় ছবির কোন চরিত্র গানটি গাইছে, তার উল্লেখ থাকত। ওঁরাও অনেক জায়গায় সেটিই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু শিল্পীর সারণিতে চরিত্রের নাম গেলে অসমঞ্জস দেখায়। সেটা একটু ভাবা দরকার ছিল।
বইয়ের শেষে বেশ কিছু ছবি দেওয়া হয়েছে। সেখানে কোনও কালানুক্রম মানা হয়নি। রেকর্ড লেবেল, বুকলেট কভার, গায়ক-গায়িকাদের স্থিরচিত্র— অনেক কিছুই আছে এই ছবিগুলিতে। যদিও এ ক্ষেত্রে রেকর্ড লেবেলের ছবিই সবচেয়ে বেশি উপযোগী বলে মনে হয়। রেকর্ড লেবেল নিজগুণেই একটি স্বতন্ত্র পাঠের দাবি রাখে। যেমন দেখছি, ১৯৪৭ সালের রাত্রি বা পথের দাবী ছবির রেকর্ড (হিন্দুস্তান রেকর্ডস) লেবেলে লেখা— ‘কম্পোজিশন: প্রণব রায়’। ‘কম্পোজিশন’ শব্দটিতে যে তখন গীতিকারকেও বোঝাত, সেটা দেখে চমক লাগে।
বাংলা ভাষায় দেবপ্রসাদ দাস সঙ্কলিত বই বাংলা চিত্রগীতিকোষ-এর তিনটি খণ্ড পাওয়া যায়। যদিও গত শতকের ত্রিশের দশকটি সেখানে এখনও অমিল। আর আলোচ্য এই ইংরেজি বইটির ক্ষেত্রে সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় ও সঞ্জয় সেনগুপ্ত প্রথম খণ্ড শেষ করেছেন ১৯৫০ সালে এসে। এই বইয়ের পরবর্তী খণ্ডগুলির জন্য প্রতীক্ষা রইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy