Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
book review

ক্ষমতা-শাসনের প্রতিস্পর্ধী

ক্ষমতা-শাসনের প্রতিস্পর্ধী রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিমানসকে বুঝতে বইটি অবশ্যপাঠ্য।ক্ষমতা-শাসনের প্রতিস্পর্ধী রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিমানসকে বুঝতে বইটি অবশ্যপাঠ্য।

শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৮:১৫
Share: Save:

রক্তমাখা চরণতল
অভীক মজুমদার
১০০.০০
লালমাটি

১৯১৯-এর এপ্রিলে জালিয়ানওয়ালা বাগে ব্রিটিশ সরকারের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে পঞ্জাব যেতে চাইলেন। রাজি হলেন না গাঁধীজি। কবি অস্থির মন নিয়ে ছুটে গেলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের কাছে, বললেন, “এই সময় সমস্ত দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে এ অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদসভা ডাকো।” অনুদ্যোগই বহাল রইল। শেষ পর্যন্ত ডাকা হয়নি কোনও সভা। এর পরই কবির সেই ঐতিহাসিক প্রতিবাদপত্র ও সরকার-প্রদত্ত নাইটহুড ত্যাগ— ৩০ মে সে চিঠি পাঠানো হয় সংবাদপত্রে। কবি বলেছিলেন, “আমি একাই যদি কিছু করি, তবে লোক জড়ো করার দরকার কি? আমার নিজের কথা নিজের মতো করেই বলা ভালো। এই সম্মানটা ওরা আমাকে দিয়েছিল। কাজে লেগে গেল। এটা ফিরিয়ে দেওয়া উপলক্ষ করে আমার কথাটা বলবার সুযোগ পেলুম।”

ব্যক্তিই কী ভাবে হয়ে উঠতে পারেন ইতিহাসের প্রণেতা, এ তেমনই এক দৃষ্টান্ত। ব্যক্তির ওঠাপড়া শুধুই ইতিহাসের ওঠাপড়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে না, কখনও কখনও সমাজ-নিরপেক্ষ ভাবে ব্যক্তির নিজেরই দায় থাকে ব্যক্তি হয়ে ওঠার, নিজেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই দায় সে তুলে নেয় নিজের কাঁধে, এই দায় কেউ তার উপর চাপায় না। দীর্ঘ পরাধীনতা যখন জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়কে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছিল, প্রবল বাধা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ আত্মপ্রতিবাদের ভিতর দিয়ে সেই আত্মপরিচয়েই স্থিত হতে চাইছিলেন।

অভীক মজুমদার তাঁর বইটিতে উল্লিখিত রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে যোগ করেছেন আশ্চর্য একটি তথ্য— যে ৩০ মে সংবাদপত্রে পাঠানো হয়েছিল তাঁর নাইটহুড ত্যাগ করার চিঠি, সে দিনই বিকেলবেলায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ জোড়াসাঁকোয় গিয়ে দেখেন, কবি তিনতলার ঘরে লাল মলাট দেওয়া একটি ছোট খাতায় শুরু করেছেন নতুন লেখা। “সেই বইটিই ‘লিপিকা’।” এ-কথার সঙ্গে অভীক এও জানাতে ভোলেন না: “লিপিকা (১৯২২) নানা কারণেই রবীন্দ্রনাথের আলোচিত গ্রন্থ। বিশেষত তার আঙ্গিক।... তুলনায় লিপিকার বিষয় বা তার নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা বেশি চোখে পড়ে না। বিশেষত, লিপিকার, ‘রাজনৈতিক’ মাত্রা বইটির আঙ্গিক আর রচনাশৈলীর চমৎকারিত্বে আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।”

পরাধীন দেশে স্বীয় গদ্যভাষাকে সাবালক করে তোলার দায়ও ছিল রবীন্দ্রনাথের। স্বনির্ধারিত এই কর্তব্যবোধ থেকেই দৈনন্দিনের ঊর্ধ্বে এমন এক কল্পনার বৈভব ও তার যোগ্য ভাষা সৃষ্টি করলেন তিনি লিপিকা-য়, বেছে নিলেন রূপকথা-উপকথার রূপকল্প, যা অনিবার্য ভাবে বাস্তব না হলেও তাঁর রাজনৈতিক অভিপ্রায়টি লীন হয়ে থাকল তাতে। দেশে-বিদেশে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তীব্রতম ‘রাজনৈতিক’ রচনা কী ভাবে পরিবেশিত হয়েছে রূপকথা-র ‘ব্যবহৃত’ আদলে, লিপিকা-র সাযুজ্যে তা আলোচনার পর সিদ্ধান্তে আসেন অভীক: “রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিসত্তার বিকাশ আত্মশক্তিতে, যে-আত্মশক্তির শিকড় প্রোথিত আছে দেশকালসমাজমৃত্তিকায়।”

এই অধ্যায়টির নামেই গ্রন্থনাম। জীবনব্যাপী একক বিকল্পসন্ধানী রবীন্দ্রনাথের বিক্ষত পথচলা প্রসঙ্গে ‘রক্তমাখা চরণতল’ শব্দবন্ধটিই প্রযোজ্য, মনে হয়েছে লেখকের। তাঁর সেই ভাবনাই ধ্রুবপদের মতো আবর্তিত হয়েছে এ-বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে, গীতাঞ্জলি-র রচনাদি ও অনুবাদ, সহজপাঠ, শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্রনাটকে বাউলধর্মী চরিত্রকে ঘিরে গভীর আলোচনাতে। এমনকি কবির ‘দ্য স্কুলমাস্টার’ প্রবন্ধটির লেখককৃত তর্জমার অন্তর্ভুক্তিও যেন তাঁর সেই ভাবনারই সম্প্রসারণ। ক্ষমতা-শাসনের প্রতিস্পর্ধী রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিমানসকে বুঝতে বইটি অবশ্যপাঠ্য।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy