ইতিহাস: কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের পুরনো গোরস্থান খুলেছিল ১৭৬৭ সালে।
সায়েবমেম সমাচার: কোম্পানির আমলে কলকাতা
নিখিল সুর
৩০০.০০
আনন্দ
“তোমরা অনেক দিয়েচ, অনেক নিয়েচ, অনেক শিখিয়েচ, অনেক ঠেঙিয়েচ… ক্যাম্বেল সাহেব, অ্যাডাম সাহেব, আর হুঁ হুঁ— তোমার নামের তো বাবা উচ্চারণ জানি না!— দোহাই বাবা, তোমরা ধুলো, ধুলো হয়েই থাকো বাবা, ধুলো… ধুলো...।” এই বই হাতে নিতেই রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ়ের দুর্ধর্ষ লেখক লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে জটায়ুর এই অনবদ্য স্বগতোক্তিটি মনে এল। তিনি আর তোপসে তখন পার্ক স্ট্রিটের পুরনো গোরস্থানে। আজ প্রায় বিলীন হয়ে আসা পুরনো কলকাতার আশ্চর্য সময়ের এক টুকরো যেন থমকে রয়েছে সেখানে— ১৭৬৭ থেকে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ পর্যন্ত। এখানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গায়ে কাঁটা দেয়। আর এখানে ‘ধুলো… ধুলো’ হয়ে রয়েছেন যাঁরা, সায়েবমেম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী এবং অনেক শিশু, তেমন মানুষদের নিয়েই নিখিল সুরের এই বই। অবশ্য তাঁর চর্চিত সময়কালটা আরও বিস্তৃত। কাহিনির মুখড়া ১৬৯০-এ জোব চার্নকের সুতানুটি আসা। চলেছে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
কিন্তু সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে জটায়ুর ওই স্বগতোক্তি যে কথাটা আমাদের খেয়াল করায় না, তা হল সেখানে শায়িত কুশীলবদের অনেকেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের যে যন্ত্রটির চালনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, প্রকৃতই ভয়াবহ ছিল। সে যন্ত্র একটা গোটা উপমহাদেশের সচ্ছল ও মোটামুটি শান্তিপ্রিয় মানুষকে সর্বস্বান্ত, রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। এই সায়েবমেমরা যে সূত্রে কলকাতায় এসে ভিড় করলেন, তার অন্তিম পরিণতির একটা দিক ধরা আছে ১৯৪৩-এর ‘মন্বন্তর’ কিংবা ১৯৪৬-এর ‘ক্যালকাটা কিলিংস’-এর হাড়-হিম-করা ছবিগুলোতে। ইন্টারনেটেই মিলবে এন্তার। কেন, কী ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এ কাণ্ড ঘটিয়েছিল, অজস্র গবেষণায় এবং ইতিহাসের বিভিন্ন পাঠে তা সুপ্রতিষ্ঠিত। সায়েবমেম সমাচার সে গোত্রের বই নয়। সেই ভয়ঙ্কর ইতিহাসকে মোটেই অস্বীকার করেননি নিখিলবাবু, বরং মনে হয়েছে যে তার মার্ক্সবাদী পাঠটিকে স্বীকার করে নিয়েই তাঁর কাহিনি শুনিয়েছেন লেখক। কী কাহিনি? এই সাম্রাজ্যবাদের জোয়ারে কলকাতায় আসা সায়েবমেমরাও তো মানুষই ছিলেন— কারও বাবা, মা, সন্তান, প্রিয়তমা, প্রাণের বন্ধু। নিখিলবাবুর বই সেই মানুষগুলোর উপর ফেলা আতশকাচ— যার নীচে ফুটে উঠেছে এক মর্মস্পর্শী ‘হিউম্যান ডকুমেন্ট’, বাংলায় বলা যেতে পারে ‘মনুষ্য হৃদয়ের রোজনামচা’।
কোনও কিছুর উপর আতশকাচ ফেলা মানেই দেখার পরিসরটাকে সুনির্দিষ্ট করে নেওয়া। এ বইয়ের পরিসর কলকাতার সাহেব-সমাজ। ১৬৯০-এর পর থেকে কী ভাবে কলকাতা বিলেতের মানুষের কাছে হয়ে উঠল ‘সৌভাগ্যের খনি’ (পৃ ৩), কী ভাবে এ নগরে বাড়তে থাকল ‘সৌভাগ্যসন্ধানী সায়েবদের’ ভিড়— আঠারো শতকের শেষে কলকাতায় সাহেবদের সংখ্যা হাজারেরও কম, বছর পঞ্চাশেক পরে ৭৫৩৪ (পৃ ২০) ও ১৮৬৬-তে ১১২২৪ জন (পৃ ২৪)— কেমন ছিল সেই মানুষগুলির নৈতিক চরিত্র, দৈনন্দিন জীবন, পারস্পরিক সম্পর্ক, বাড়িঘর, বিনোদনের ব্যবস্থা, ভৃত্যের দল, এবং অবশেষে কী ভাবেই বা সাহেবদের কাছে কমতে থাকল কলকাতার টান, এই বই তারই কাহিনি। প্রাক্কথন ও পরিশিষ্ট বাদ দিয়ে দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। বহু সায়েবমেমের জীবনের ছোট ছোট ঘটনার ছবি দেড়শো বছরের পটে আঁকা। কী অধ্যবসায়ে আঁকা, তা মালুম হয় প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে উল্লিখিত সূত্র-নির্দেশ থেকে।
এই দেড়শো বছরের কলকাত্তাইয়া সাহেব-সমাজের ইতিহাসের কোনও নয়া পাঠ এ বইয়ের লক্ষ্যই নয়। গোড়াতেই খোলসা করেছেন লেখক: “আমি চাই, পাঠক ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে অজানা তথ্য জানুন, ইতিহাস পাঠের আনন্দটুকু উপভোগ করুন…” (নিবেদন)। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অন্তত তার থেকেও অনেক বেশি কিছু পেয়েছি। সেই বেশিটা যে কী, তা বর্ণনা করা দুরূহ। যেমন ‘মেমসায়েবদের মতিগতি’ (পৃ ৭৩-১০৪) অধ্যায় পড়ে জেনেছি, কলকাতা-ফেরতা সাহেবদের ‘ঠাটঠমক’ দেখে বিলেত থেকে দলে দলে মেম এ নগরে আইনি ও বেআইনি পথে হাজির হতেন জীবনসঙ্গীর খোঁজে। তাঁদের আসার উপর কোম্পানির কর্তাদের কড়া নিষেধ, গোড়ায় কলকাত্তাইয়া সাহেবদের সেই মেমদের সঙ্গলাভের মরিয়া চেষ্টা, বহু মেমসায়েবের দাম্পত্য জীবনের হতাশা, বিলাসব্যসন, এ দেশের প্রতি ভালবাসা, বর্ণবিদ্বেষ— জানলাম সে সবও। কিন্তু যখন পেলাম যে, পার্টির পর পার্টিতে রাতভর নাচতে নাচতেই কী ভাবে বহু ভাগ্যান্বেষী যুবতী গোরস্থানে চলে যেতেন, একটি নাটক থেকে নেওয়া তার কাব্যিক বর্ণনা, সে পাওয়া তো শুধু তথ্য নয়, তার থেকে অনেক বেশি কিছু— “হোয়েন ওয়ান নিউজ় স্ট্রেট কেম হাডলিং/ অন অ্যানাদার/ অব ডেথ, অ্যান্ড ডেথ, অ্যান্ড ডেথ স্টিল আই/ ড্যান্সড অন” (পৃ ৯৪)।
এই বই এমনই মনুষ্য হৃৎস্পন্দনে ঠাসা। এই সব হৃদয়ের ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে কিন্তু বইটিকে নিখাদ ‘দাস্তানগোই’ হয়ে উঠতে দেননি লেখক, ধরে রেখেছেন ইতিহাসের সুতো, প্রায় অদৃশ্য কিন্তু তাতেই এই সব ঘুড়ি বাঁধা। আমরা জানতে থাকি, মোটামুটি কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে এ সব ঘটছে। আর তা সুনিশ্চিত করতে গিয়েই নিখিলবাবু দেখিয়েছেন পদে পদে— “কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজ আপাতদৃষ্টিতে শ্রেণিহীন জনসমাজ মনে হলেও… তার মধ্যেও ছিল শ্রেণিবৈষম্য” (পৃ ৫)। সেই বৈষম্যও এখানে বর্ণিত ঘটনাগুলিকে দিয়েছে তার নিজস্ব রং, যাকে এ যুগে কখনও বা মনে হবে অ্যাবসার্ড, প্রায়শই যা মর্মন্তুদ। পরিপাটি বইটির সঙ্গে দেওয়া ঊনবিংশ শতকের রঙিন পেন্টিংগুলিতে তার কিছুটা ধরা পড়ে।
শেষে একটি অভিযোগ, আর একটি অনুযোগ। পার্টি আর অতিথি আপ্যায়নের অনেক ঘটনা এ বইয়ে বিশদে বর্ণিত হয়েছে। রয়েছে মদ্যপান সংক্রান্ত দুরন্ত সব তথ্য আর কিস্সা। আছে ‘বিলিতি, ফরাসি অথবা ডেনিস ক্লারেটের সঙ্গে দারচিনি, লবঙ্গ ও অন্যান্য মশলা মিশিয়ে’ ফুটিয়ে ‘বিশেষ পছন্দের’ ‘বার্ন্ট ওয়াইন’ তৈরির কথা (পৃ ৬২)। শ্যাম্পেন, ক্লারেট, ম্যাদাইরা, পোর্ট, ফরাসি ওয়াইন, ব্র্যান্ডি, শেরি, হল্যান্ডের রাম খেয়ে সায়েবমেমরা কী কাণ্ড ঘটাতেন, আছে তার কথা। আছে পাক্কা হিসেব— উনিশ শতকের গোড়ায়, মানে যখন কলকাতায় সায়েবমেমের সংখ্যা হয়তো মাত্র হাজার ছাড়িয়েছে, তখন বিক্রি হত বছরে ৪০০০ পিপে ম্যাদাইরা, ১০০০০ গ্যালন ব্র্যান্ডি, হল্যান্ডের রাম ও অন্যান্য মদ (পৃ ৬৩)। কিন্তু খানা? এ বড় দুঃখের যে, সে বর্ণনায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত সায়েবমেমদের খাদ্য-সংস্কৃতির কথা। ‘কারি’, ‘কেজরি’, ‘ঝালফ্রেজ়ি’ গোত্রের বিচিত্র স্বাদে রঙিন নানা ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ খানা তৈরির হেঁশেলে কি সে কালের কলকাত্তাইয়া সায়েবমেমদের কোনও ভূমিকাই ছিল না? শুধু জানলাম, আঠারো উনিশ শতকের কলকাতার সায়েবমেমরা ‘লাঞ্চ’ নামক কিছু করতেনই না, কর্নওয়ালিস ‘ডিনার’ করতেন দুপুর দুটোয় (পৃ ১১১)!
আর ছোট্ট অনুযোগটি এই যে, দাস্তানগোই হতে না দিলেও এমন সব কাহিনি শোনানোর সময় নিখিলবাবু যদি নিজের স্বরটিকে দাস্তানগোই-এর মতো কাহিনির মোড় অনুযায়ী একটু ওঠানামা করাতেন, তা হলে ভাল হত। ভাষাটা কেমন যেন একটানা রিডিং পড়ে যাওয়ার মতো হয়ে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy