Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

নিজেরাই ইতিহাসের এক-এক জন বন্দি

বিদেশ-বিভুঁই গিয়ে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ সৈন্য ইংরেজের হয়ে দু-দুটো মহাযুদ্ধ লড়লেন। তাদের মধ্যে কিছু কিছু বিক্ষুব্ধ সেনাকে নিয়ে পরে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি হল। একটা প্রশ্ন এইখানে উঠে আসে। আইএনএ-তে যোগ দিলেন যে সেনারা, তাঁরা নিশ্চয়ই আগে থেকেই বিক্ষুব্ধ ছিলেন! নেতাজির মতো নেতারা যত ভাল বক্তৃতাই দিন না কেন, সেনাদের মগজধোলাই তাঁরা নিশ্চয়ই করেননি। ভাইসরয় ওয়াভেল অবশ্য বলেছিলেন, হতচকিত বিভ্রান্ত (bewildered and confused) সেনাদের ভুলভাল বুঝিয়ে আইএনএ-তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

• ইন্ডিয়ান ভয়েসেস অব দ্য গ্রেট ওয়ার/
সোলজার্স লেটার্স, ১৯১৪-১৮
, সম্পা: ডেভিড ওমিসি। পেঙ্গুইন/ভাইকিং, ৫৯৯.০০

• দ্য টেস্টিমনিজ অব ইন্ডিয়ান সোলজার্স অ্যান্ড দ্য টু ওয়ার্ল্ড ওয়ার্স/
বিটুইন সেলফ অ্যান্ড সিপয়
, গজেন্দ্র সিংহ। ব্লুমসবেরি, ৫৯৯.০০

• ১৯১৪-১৯১৮/ ইন্ডিয়ান ট্রুপস ইন ইউরোপ, শান্তনু দাস। মাপিন, ১৮৫০.০০

বিদেশ-বিভুঁই গিয়ে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ সৈন্য ইংরেজের হয়ে দু-দুটো মহাযুদ্ধ লড়লেন। তাদের মধ্যে কিছু কিছু বিক্ষুব্ধ সেনাকে নিয়ে পরে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি হল। একটা প্রশ্ন এইখানে উঠে আসে। আইএনএ-তে যোগ দিলেন যে সেনারা, তাঁরা নিশ্চয়ই আগে থেকেই বিক্ষুব্ধ ছিলেন! নেতাজির মতো নেতারা যত ভাল বক্তৃতাই দিন না কেন, সেনাদের মগজধোলাই তাঁরা নিশ্চয়ই করেননি। ভাইসরয় ওয়াভেল অবশ্য বলেছিলেন, হতচকিত বিভ্রান্ত (bewildered and confused) সেনাদের ভুলভাল বুঝিয়ে আইএনএ-তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঔপনিবেশিক কর্তাদের যুক্তি সেটাই বলবে, আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু এত মানুষকে ‘ভুলভাল’ বোঝানো কি সত্যিই সম্ভব? বিক্ষোভ নিশ্চয়ই জমা ছিল এঁদের মনে। তা হলে কি এই বিক্ষোভটা নিয়েই তাঁরা এত দিন ইংরেজদের যুদ্ধে জান-প্রাণ দিচ্ছিলেন? কতখানি দীর্ণ ছিলেন তাঁরা ভেতরে ভেতরে? জাতীয়তাবাদের ভাসা-ভাসা আদর্শের কথা যদি-বা বাদ দিই, যে সাহেবরা দেশ শাসনের নামে ঘরে বাইরে অত্যাচারে তাঁদের বিদ্ধ করে যাচ্ছে, সেনাবাহিনীর মধ্যে গায়ের রং-এর ভিত্তিতে টাকাপয়সা-সুযোগসুবিধে দিচ্ছে, তাঁদের উপর রাগ না-হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক! এতখানি ক্ষোভ বা রাগ ভেতরে পুষে আবার সেই সাহেবদের হয়েই জীবন উৎসর্গ করে দেওয়াটা কঠিন নয়?

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির মনোজগতের এই জটিল ইতিহাসটা বহু দিন উপেক্ষিত ছিল। ব্রিটিশ আর্মির ইতিহাস লেখা হয়েছে, তার মধ্যে ভারতীয় বাহিনীর কথাও যে আসেনি তা নয়। কিন্তু সে সবই মূলত বাহিনীর অভিযান-মাহাত্ম্যের ইতিহাস, তথ্যপরিসংখ্যানে লেখা একটা বাইরের ছবি। সিপাহিদের মানসিক দ্বন্দ্ব বিষয়ে আমরা কমই জানতে পেরেছি। সে দিক দিয়ে ডেভিড অমিসি এবং গজেন্দ্র সিংহ-এর দুটি বই-ই মূল্যবান। মজার ব্যাপার, দুটি বই দুটি আলাদা দিক থেকে সিপাহিদের গল্প বলে। দুটি আলাদা বক্তব্য তুলে ধরে। অথচ দুই জনই একই ধরনের উপাদানের উপর জোর দেন: সিপাহিদের চিঠিপত্র।

অমিসি-র প্রধান বক্তব্য, শত বিপর্যয় ও বিপদের সামনেও ঔপনিবেশিক মানুষের বীরত্ব, তাঁদের অদম্য স্পিরিট, তাঁদের দুর্মর আশাবাদিতার উপর ভর করেই ব্রিটিশ শক্তি ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল এবং ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে একের পর এক সামরিক সাফল্যের ধ্বজা তুলতে পেরেছিল। এত কম খাবার বা ওষুধ, এত অপ্রতুল চিকিৎসার ব্যবস্থা, পান থেকে চুন খসলেই উদ্‌ভ্রান্ত বেত্রাঘাত, বরফঢাকা শীত, আগুন-ঢালা গরম, সব কিছুর মধ্যে লড়াই চালাবার সামর্থ্য ইউরোপীয় সেনাদের হত কী? অনুন্নত দেশের মানুষ যেন উন্নত দেশের মানুষের তুলনায় এই জায়গাটায় জিতে বেরিয়ে যায়, সব রকমের অসুবিধে মানিয়ে নিয়ে পরিশ্রম করে যাওয়ার ক্ষমতায়। অমিসি-র বইতে বিশ্লেষণের পরিসর কম, বিবরণের পরিমাণ বেশি। প্রায় সাড়ে ছশো চিঠির নানা অংশ ব্যবহার করেছেন, অনেক সময়ই খুব দীর্ঘ বয়ান সরাসরি তুলে দিয়েছেন। বড় বড় উদ্ধৃতি এই বই-এর একটা দুর্বলতা বলে গণ্য হতেও পারে। তবে ইতিহাসবিদ যা-ই বলুন, ইতিহাস-উৎসাহী পাঠক কিন্তু পড়তে গিয়ে খুশি হন। কেননা, এ সব চিঠির মধ্যে অসংখ্য মানবিক গল্প লুকিয়ে। এমনকী অনেক বৃহত্তর আখ্যানও লুকিয়ে, যে জানো সন্ধান। এই যেমন: যুদ্ধের সাফল্যে প্রীত সম্রাট পঞ্চম জর্জ সুবেদার মীর দস্ত-কে ডেকে পাঠিয়েছেন পুরস্কারের জন্য। কী চান মীর দস্ত? ভাবতে সময় লাগল না বেশি। তিনি চান একটি প্রতিশ্রুতি: আহত সৈন্যদের যেন কোনও ভাবেই আর ট্রেঞ্চে না ফেরানো হয়। ট্রেঞ্চে কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, এমনকী আহত সৈন্যদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের বন্দোবস্তও নেই। এইটুকুর মধ্যে দিয়েই ফুটে ওঠে একটা বড় ছবি, বড় ক্ষোভের ছবি। কত ভাবে, কত পথে নিজেদের বঞ্চনার কথা জানানোর চেষ্টা করতেন এঁরা, তার একটা ধারণা হয়।

এই সব চেষ্টায় বিশেষ লাভ হত না, বলাই বাহুল্য। সিপাহিদের ক্ষোভের কথা জেনে বঞ্চনার প্রতিকার হয়েছে, ব্রিটিশ বাহিনীতে এরকম দৃষ্টান্ত প্রায় অনুপস্থিত। সিপাহিরাও সেটা জানতেন। এই অবরুদ্ধ ক্ষোভ নিয়ে কী করতেন তাঁরা? অন্য কোনও ভাবে এর প্রকাশ ঘটত কি? এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় গজেন্দ্র সিংহের গবেষণা। তিনি মনে করেন, সৈন্যদের এই অবরুদ্ধ আবেগের প্রকাশের মাধ্যম ছিল তাঁদের চিঠিপত্র। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আপনজনদের যখন নিজেদের কথা লিখতেন তাঁরা, তাতে এই কষ্টের প্রতিফলন ঘটত। কিন্তু কী ভাবেই-বা সেটা সম্ভব? প্রতি চিঠিই তো সেন্সর-এর মাধ্যমে ছাড়া হত। আপত্তিজনক কিছু থাকলে সেই চিঠি তৎক্ষণাৎ বাতিল তো বটেই, চিঠিলেখকের ভবিষ্যৎও করুণ। গজেন্দ্র-র মতে, এই দ্বন্দ্বের সামনে পড়ে এঁরা যা কিছু লিখতেন, তার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্নতা থাকত, অর্থাৎ উপরিতলে যা বলা হচ্ছে, তা ছাড়াও ভেতরে ভেতরে আরও কিছু বলা হত। গজেন্দ্র একে বলবেন, ইতিহাসের প্রচ্ছন্ন উপাদান, ‘হিড্ন ট্রান্সক্রিপ্ট’। চিঠিপত্র পড়ে সেই হিড্ন ট্রান্সক্রিপ্ট খুঁজে বার করাই গবেষকের একটা প্রধান কাজ, মনে করেন তিনি। তাই চিঠির ভাষায় ‘বীরত্ব সাফল্যের জয়জয়কার’-এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব শ্রান্তি ক্লান্তি খেদ। কিংবা আদালতের বিচারের বিবরণে পাওয়া সম্ভব একটা দ্বিতীয় ভাষ্য, ভাষার অলঙ্কার বা বিশিষ্টতায় যা লুকিয়ে থাকত। সেন্সর-এর কাজে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের পক্ষে ভাষার এই খুঁটিনাটি ভেদ করা সব সময় সম্ভব হত না বলেই এই ট্রান্সক্রিপ্ট ‘হিড্ন’ বা গোপন থেকে যেতে পারত।

অর্থাৎ, কমলাকান্তের কথা মনে পড়াবেই গজেন্দ্র সিংহের বই। প্রসন্ন গোয়ালিনীর গরু-চুরির মামলায় কমলাকান্তের সাক্ষ্য তো ঠিক এই ভাবেই বয়ানের মধ্যে বয়ান দিয়ে আখ্যানের মধ্যে আখ্যান তৈরি করেছিল। তবে একটা কথা না বললেই নয়। সাহিত্য ও ইতিহাসের মধ্যে সংযোগটি তীব্র হলেও একেবারে একাকার নয়। সাব-অলটার্ন স্টাডিজ-এর অভিজ্ঞতার পর এই গবেষণা পদ্ধতিকে নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠবে নিশ্চয়ই। গবেষক যে আখ্যান খুঁজতে চান, শেষ পর্যন্ত সেটারই অবধারিত প্রতিচ্ছবি তাঁর খোঁজার মধ্যে পড়তে থাকে, এমন সংশয় বাতিল করা যায় না। তাই ‘হিড্ন ট্রান্সক্রিপ্ট’-এর কতটা পুনরুদ্ধার সম্ভব, আর যেটুকু পুনরুদ্ধার সম্ভব, তা কতটা যথার্থ, এই অস্বস্তি গজেন্দ্র সিংহের বই আগাগোড়া জাগিয়ে রাখে। তার মধ্যেই খেয়াল করতে হয় যে অমিসি যেমন বীরত্বের কাহিনি বোনেন, গজেন্দ্র দেন ক্ষোভ-বিক্ষোভের ধারাভাষ্য। দুই আলাদা গবেষণা পদ্ধতির জন্যই তাঁরা একই সূত্র ব্যবহার করেও দুই আলাদা ছবিতে পৌঁছে যান।

কেবল সিপাহিদের ক্ষোভ নয়, ব্রিটিশ ভারতের সামরিক ইতিহাস সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুতর বিষয়ে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন গজেন্দ্র। যেমন, সামরিক জাতি হিসেবে ব্রিটিশরা যাদের চিহ্নিত করেছিল, সেই পঞ্জাবি, পাঠান কিংবা ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে যে ‘অ্যানাল’ বা বিবরণীগুলি প্রকাশিত হয়— সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বক্তব্য পাল্টাতে থাকে, কেননা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সব জাতির সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্কও পাল্টাতে থাকে। তাই ‘বীর’ পঞ্জাবিরা হয়ে যান ‘রাজদ্রোহী’, ‘দুর্দান্ত’ পাঠানরা হয়ে যান ‘বর্বর’, আর ‘মেয়েলি’ ব্রাহ্মণরা ক্রমে হয়ে ওঠেন ‘বিশ্বস্ততা’র শিরোমণি। একটু অগোছালো আলোচনা, অপর্যাপ্ত বিশ্লেষণ, কিন্তু নানা নতুন তথ্যের ইঙ্গিতে গজেন্দ্র সিংহের বইটি তুলনায় অনেকটাই বেশি উল্লেখযোগ্য। অমিসি-র বই-এর ভূমিকায় মার্ক টুলি বলেছেন, এ বার থেকে ‘ব্রিটিশ আর্মি’র বদলে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি’র ইতিহাসের দিকেই মনোযোগ দেওয়া জরুরি, গজেন্দ্র সিংহের বই যেন সরাসরি সেই প্রয়োজনীয়তাবোধেরই ফসল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতপর্ষপূর্তিতে এই সব নতুন প্রাপ্তির মধ্যে শান্তনু দাসের ছবির বইটির কথা কিন্তু না বললেই নয়। দুর্লভ ফোটোগ্রাফের সমাহার এই বই হাতে নিলে চুপ করে যেতে হয়, এতটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে ইতিহাস। ফোটোগ্রাফের সঙ্গে আঁকা ছবিও কম নয়। ফ্রান্সের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও আর্কাইভস্-এর সৌজন্যে পাওয়া ছবিগুলির সঙ্গে উপরি পাওনা ভাষ্যটি, সংক্ষিপ্ত হয়েও ভারী স্পষ্ট, তথ্যবাহী। জানতে পারি, ১৯১৬ সালে জুন মাসে জার্মানিতে মৃত্যুপথযাত্রী গুর্খা সিপাহির একটি কবিতার কথা: ‘আর বিদেশ নয়, স্বদেশে পাঠাও আমায়/ কেননা বাঁচার কোনও লক্ষ্য নেই, মৃত্যুর নেই কোনও জ্ঞান/দেহকে যেতেই হবে, আমাকেও তাই/ ধুতে চাও তুমি? বলো কত ধোবে মৃত্যু-অভিজ্ঞান?’ এই সব ছবি, চিঠি আমাদের কাছে সেই ধুয়ে-ফেলতে-চাওয়া মৃত্যু-অভিজ্ঞানের কথা পৌঁছে দিল আবার। মনে করিয়ে দিল, সে দিনের জয়যাত্রার সিপাহিরা নিজেরাই ছিল ইতিহাসের হাতে এক-এক জন ‘বন্দি’।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE