বিশ্বায়িত: মাদাম তুসো-য় বিশ্বনেতাদের সঙ্গে যোগ দিলেন নরেন্দ্র মোদী। মোমমূর্তিতে চলছে শেষ রূপটান। এপ্রিল ২০১৬। ছবি: গেটি ইমেজেস
দ্য প্যারাডক্সিকাল প্রাইম মিনিস্টার/ নরেন্দ্র মোদী অ্যান্ড হিজ় ইন্ডিয়া
শশী তারুর
৭৯৯.০০
আলেফ বুক কোম্পানি
প্রচ্ছদের কথা উল্লেখ করে সচরাচর কোনও বইয়ের সমালোচনা শুরু হয় না। এই বইটির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করতেই হচ্ছে। মাদাম তুসোর মিউজ়িয়ামে গভীর মনোযোগের সঙ্গে নিজের মূর্তি খুঁটিয়ে দেখছেন তিনি— নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে লেখা কোনও বইয়ের এর চেয়ে ভাল প্রচ্ছদ আর হয় না। প্রচ্ছদশিল্পীর নাম বেনা সারিন। একটা কথাও না বলে নরেন্দ্র মোদী সম্বন্ধে এতগুলো কথা বলে দেওয়া, গোটা বইয়ের মেজাজ প্রচ্ছদে ধরে দেওয়ার কৃতিত্ব অস্বীকার করার নয়।
শশী তারুর সুলেখক। কিন্তু, কংগ্রেসের সাংসদও বটে। ফলে, নরেন্দ্র মোদীর মূল্যায়নে তিনি কতখানি নিরপেক্ষ হবেন, সেই প্রশ্ন থাকেই। নিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে তারুর খুব উতরেছেন, তেমনটাও দাবি করা মুশকিল। বস্তুত, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি কেন কিছু ক্ষেত্রে তাঁর সম্বন্ধে ইতিবাচক কথা বলেছিলেন, বইয়ের প্রথম কয়েকটা পাতা খরচ হয়েছে সেই সাফাই দিতে। কংগ্রেসের অন্দরমহলে তাঁর মোদী-প্রশস্তি যে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ায়নি, তারুর সম্ভবত সেটা মনে রেখেছেন। এই বই মূলত মোদী-ভর্ৎসনার।
প্রায় পাঁচশো পাতার বইয়ে নরেন্দ্র মোদীর গোটা শাসনকালকেই ধরেছেন তারুর। মোট পঞ্চাশটি লেখা, পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। এই জমানার সাড়ে চার বছরে ছোট-বড় যা ঘটেছে, তার প্রায় সবই আছে। যাঁরা মোদী-বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, অথবা ঘরে-বাইরের আলোচনায় তথ্যপ্রমাণ সহ কথা বলতে চান, তাঁদের সুবিধা হবে। এর একটা অসুবিধা, কিছু ক্ষেত্রে ঘটনাক্রমের তালিকাতেই থেমে গিয়েছে আলোচনা, শশী তারুর বিশ্লেষণের তেমন সুযোগ পাননি। তবে, শুধু ঘটনা উল্লেখ করেও বলা যায় অনেক কথাই। একটা উদাহরণ দিই। ২০০৯ সালে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তারুর যখন মন্ত্রী হলেন, তখন তিনি বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। পরামর্শদাতা হিসেবে, পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও। কোনওটির সঙ্গেই টাকাপয়সার লেনদেন ছিল না। তবু, মন্ত্রী হওয়ার পরই ক্যাবিনেট সচিব তাঁকে জানালেন, সেই সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে হবে। না হলে, ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হওয়ার সম্ভাবনা। তারুর লিখেছেন, তিনি আর কথা না বাড়িয়ে সংস্থাগুলিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন পদত্যাগের কথা। ২০১৭ সালে যখন এনডিএ-র চার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, সুরেশ প্রভু, জয়ন্ত সিনহা এবং এম জে আকবরের বিরুদ্ধে একই ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’-এর অভিযোগ উঠল, তার কথা উল্লেখ করেছেন তারুর। তাঁরা কিন্তু মন্ত্রিত্বও ছাড়েননি, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কও নয়। তারুর লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদীর আমলে মন্ত্রীদের জন্য সম্ভবত ভিন্ন নিয়ম প্রযোজ্য।
তারুর এই জমানার যে ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে কয়েকটির তাৎপর্য বিপুল; আবার কিছু ঘটনা নেহাতই হাস্যকর। গণেশের প্লাস্টিক সার্জারির সঙ্গে কি জিএসটি-র তুলনা চলে? আসলে যে চলে, এই কথাটা প্রতিষ্ঠা করাই এই বইয়ের মূল গুরুত্ব। মোদীর শাসনকাল নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনায় একটি প্রসঙ্গ ইদানীং উঠছে— হেজিমনি বা চিন্তা-আধিপত্য। এই জমানার গুরুত্বপূর্ণ এবং হাস্যকর, দুটো দিককেই সেই চিন্তা-আধিপত্য বিস্তারের নিরিখে দেখা প্রয়োজন। তারুর মোদীকে নিয়ে একটা দীর্ঘ আলোচনা করেছেন প্রথম অধ্যায়ে। তিনি মোদীত্বের কথা বলেছেন। বিজেপির চিন্তা-আধিপত্যের সঙ্গে সেই মোদীত্বের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। নরেন্দ্র মোদী নিজেকে এক জন দৃঢ়, বজ্রমুষ্টির শাসক হিসেবে বিপণন করেছিলেন ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে। ভেঙে দেখলে, সেই দৃঢ়তা আসলে কর্তৃত্ববাদী শাসকের, যাঁর কাছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তির অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, কোনওটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর, ক্রমাগত রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেছেন মোদীরা। ডিমনিটাইজ়েশন থেকে সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত, ছাত্রবিক্ষোভ দমন থেকে সাইবার দুনিয়ায় নজরদারি, যে কোনও প্রশ্নকেই তাঁরা রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রশ্ন করে তুলেছেন। এবং, যাঁরা সরকারের অবস্থানে আপত্তি জানিয়েছেন, তাঁদের দেগে দিয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহী বলে।
কঠোর প্রশাসকের হাতে শক্তিশালী রাষ্ট্রের রাশ, এটা বিজেপির চিন্তা-আধিপত্যের একটা দিক। আর অন্য দিকে রয়েছে হিন্দুত্ব। সেই হিন্দুত্বের বিশেষত্ব হল, তা রাষ্ট্রভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। ভারত নামক ভৌগোলিক অস্তিত্বটির একমাত্র ধর্ম— নিদেনপক্ষে, প্রধানতম ধর্ম— যে হিন্দুধর্মই হওয়া বাঞ্ছনীয়, এই প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মনে কোনও দ্বিধা কখনও ছিল না। নরেন্দ্র মোদীর আমলের বিশেষত্ব হল, তাঁরা হিন্দুত্ব আর ভারতীয়ত্বের একের সঙ্গে এক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে অনেক দূর সক্ষম হয়েছেন। এই আমলে হিন্দুরাষ্ট্র মানে হিন্দুধর্মের প্রাধান্যবিশিষ্ট রাষ্ট্র নয়— এখন যা রাষ্ট্র, তা-ই হিন্দু; এবং যা হিন্দু, তা-ই রাষ্ট্র। তার জন্য ইতিহাসকে সাফ করতে হয়। হলদিঘাটির যুদ্ধের ফলাফল বদলে দিতে হয়, পাঠ্যবই থেকে ছেঁটে ফেলতে হয় মুঘল আমলের ইতিহাস। রাস্তা, শহরের নাম পাল্টে যেতে হয় নিরন্তর। বিজ্ঞানকেও ছাড়লে চলে না, কারণ আধুনিক রাষ্ট্র শুধু হিন্দুত্বে এগোবে না। ফলে, বিজ্ঞানকে হিন্দুত্বের মোড়কে নিয়ে আসার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলে। কখনও গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, কখনও পুষ্পক রথকেই প্রথম বিমান বলা, কখনও মহাভারতের যুগে ইন্টারনেটের অস্তিত্ব প্রমাণ— যে সব কথায় এত দিন হাসি পেয়েছে, সেগুলোকে এই হিন্দুরাষ্ট্রের আখ্যানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পাঠ করাই বাঞ্ছনীয়।
প্রশ্ন উঠবে, যে কথায় লোকে মূলত হাসে, সে কথা দিয়ে কি চিন্তা-আধিপত্য তৈরি করা যায়? উত্তর হল, যায়। প্রথমত, গোমূত্র পান করলে রোগব্যাধি সারে, এই কথায় বিশ্বাস করেন কত জন, আর হাসেন কত জন, সেই হিসেব স্পষ্ট নয়। তার চেয়েও বড় কথা, অনুপাতটা কি বিশ্বাসের দিকে হেলে প়ড়ছে ক্রমশ? সেই সংখ্যার হিসেবে আটকে না থেকে আধিপত্যের একটা জরুরি শর্তের কথা স্মরণ করা ভাল— চিন্তা-আধিপত্য যে বিশ্বাসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, তার পরিধিকে ক্রমেই ঠেলে যেতে হয় বাইরের দিকে। জাতীয়তাবাদের গ্রহণযোগ্যতায় ভর করে ঠেলতে হয় হিন্দুত্বের দিকচিহ্নগুলোকে, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার দিকে। তার কতখানি সত্যিই মানুষের মনে ধরল, আর কতটা হাস্যাস্পদই থেকে গেল, মূল কথা তা নয়। হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হবে।
তারুরের বইয়ে বিজেপির সেই চেষ্টার ছবি স্পষ্ট ধরা পড়েছে। কেউ যদি সময় অনুসারে সাজিয়ে নিতেন ঘটনাগুলো, তা হলে আরও স্পষ্ট হত ঘটনাক্রম। তবে, একটা কথা অমীমাংসিতই থেকে গেল। বইয়ের শিরোনামের ধাঁধা। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালের মধ্যে ধাঁধা কোথায়? নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এক রকম ছিল, আর তিনি শাসন করলেন অন্য ভাবে, এটাই কি ধাঁধা? তার সমাধান তো তারুর নিজেই করেছেন, মোদীত্বের চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে। নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে আসলে কোনও ধাঁধা নেই। তিনি কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাসী। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও সেই কর্তৃত্ববাদের কথাই ছিল। ভোটের আগে আর পরে প্রয়োগক্ষেত্র বদলে গিয়েছে, এই যা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy