Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গজীবন ও সংস্কৃতির সহজপাঠ

কৈশোরের শুরুর চোখ দিয়ে এ পার বাংলায় দেখা বিমূঢ় দৃশ্যে— এক জনের বাঁকে ন্যুব্জ বৃদ্ধ এক দিকের ঝুড়িতে, অন্য দিকের ঝুড়িতে ভাঙা গৃহস্থালির কত জিনিস!

দীপঙ্কর ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা (৬৪ খণ্ড)
প্রধান সম্পাদক: শামসুজ্জামান খান
খণ্ডভিত্তিক বিভিন্ন মূল্য
বাংলা একাডেমি, ঢাকা

আমাদের কাছে দেশকাল আর ইতিহাসের টানাপড়েনের মেদুরতায় ভর করে আছে বাংলাদেশ। মনে পড়ে, ইছামতি পেরিয়ে পাটখেতের মাঝের রাস্তা ধরে চলেছে অবিরাম মানুষের সারি। নিঃশব্দে, অবসন্ন শরীরগুলো অনির্দিষ্ট পথে এগিয়ে আসছে। গাঙ পেরিয়ে আসা সেই পুব বাংলার মানুষ আর তাঁদের হাহাকারের স্মৃতিও কখনও উতলা হয়ে ওঠে। কৈশোরের শুরুর চোখ দিয়ে এ পার বাংলায় দেখা বিমূঢ় দৃশ্যে— এক জনের বাঁকে ন্যুব্জ বৃদ্ধ এক দিকের ঝুড়িতে, অন্য দিকের ঝুড়িতে ভাঙা গৃহস্থালির কত জিনিস! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বৃত্তান্তে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জাতিসত্তার বয়ান। লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালার খণ্ডে খণ্ডে জেলা পরিচিতিতেও সেই অভিঘাত আর গৌরবগাথার স্পর্শ। কিন্তু এই লোকজ সংস্কৃতি শুধু বর্ষ-দশক সময়কালের হিসাব নয়— জীবনসংস্কৃতির আবহমানের বিচিত্রতার রূপও। তা বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অন্দর-বাহিরেরই এক বাস্তব কাহিনি।

যেমন, পল্লিশিল্পের কথা বলতে গিয়ে, জসীমউদ্‌দীন ফরিদপুরের প্রান্তবর্তী অঞ্চলের একটা খড়ের ঘরের সুনিপুণ গঠনের কথা বলেছিলেন। তা প্রায় একশো বছর আগের দৃশ্য। সে সময়ে তিন-চার দিনের পথ পেরিয়ে লোক গামছায় চাল-চিঁড়ে বেঁধে এই ঘর দেখার জন্য আসত। কৃৎকৌশলী মন আর কৌতূহলও বাঙালির আবহমানের। ‘মলুয়া’ পালার গীতেও মিশে আছে চাষির ঘরের বর্ণনা— ‘‘শীতলপাটি দিয়া বিনোদ ঘরের দিল বেড়া,/ উলু ছোনে ছাইল ঘর দেখতে মনোহরা।’’ সৃষ্টি আর রূপান্তরের নিত্য পথে জেগে থাকে আমাদের লোকায়ত জীবন। কিন্তু, মাঠ নদী খাল বিল পাহাড় জঙ্গলের প্রকৃতিতে মেশা বাংলাদেশের জীবন-আঙিনায় কেমন সেই অন্তর্লীন যাপন? জীবনধারণের রকমফেরে, ভাষার আঞ্চলিকতার মধ্যেই আছে বাঙালির রীতি-আচার, পুজো-পার্বণ, মেলা-উৎসব, সুর-ছন্দ আর দৈনন্দিন শিল্পের অবয়ব। লোকজ জীবনের যে ছায়াপথ— তা কুটির, খাটপালঙ্ক, নকশি কাঁথা, রান্নাবান্না, খেলাধুলো, ছড়া-প্রবাদের মতো অজস্র বিষয়-উপাদানের এক অখণ্ড জীবন-প্রণালী। লোকশিল্পের বিস্তারে, কিংবদন্তির বিস্ময়ে, লোকপুরাণের কল্পসৃষ্টির মধ্যেও বাঙালি সমাজের চলমানতা। হিন্দু-মুসলমানের সমাজরীতির ধর্মীয় বিভাজনের ভিতরেও থাকে বাংলা ভাষা ও কৃষিসংস্কৃতির যোগসূত্রের উত্তরাধিকার। তাই লোকজ সংস্কৃতির বিচিত্রতায় বহুলাংশেই ফিকে হয়ে যায় ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতা। প্রাত্যহিক যাপনের পরম্পরা এই মহানুভব শিক্ষারও বাহন।

বাংলাদেশের জেলায় জেলায় এই সার্বিক লোকজ সংস্কৃতির তথ্য উন্মোচন— সংগ্রাহক ও সমন্বয়কারী মিলিয়ে তিন শতাধিক গবেষকের অন্বেষণে সম্ভব হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় বাংলা একাডেমির উদ্যোগে রূপায়িত হয়েছে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের এই নিবন্ধীকরণ। এই দশকের শুরুতে যে প্রকল্পের সূচনা হয় তা এক দশকের আগেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। সার্বিক রূপায়ণের এই অভীপ্সা শিক্ষণীয়। জেলার পরিচিতি-সহ লোকসাহিত্য, বস্তুগত লোকসংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, লোকস্থাপত্য, লোকসঙ্গীত, লোকবাদ্যযন্ত্র, লোকউৎসব, লোকাচার, লোকখাদ্য, লোকনৃত্য, লোকনাট্য, লোকক্রীড়া, লোকপেশাজীবী গোষ্ঠী, লোকচিকিৎসা ও তন্ত্রমন্ত্র, ধাঁধাঁ, প্রবাদ-প্রবচন, লোকছড়া, লোকবিশ্বাস ও সংস্কার, লোকপ্রযুক্তি ইত্যাদি বহু বিচিত্র বিষয়ধারা উদ্ঘাটিত হয়েছে। বিশেষ বিশেষ জায়গার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে কোনও কোনও আঙ্গিক মেলা উৎসব লোকশিল্প এমনকী মিষ্টিও। সাতক্ষীরা-খুলনার মাইচাম্পা, ঝিনাইদহের পাগলা কানাইয়ের গান, নেত্রকোণার লম্বা কিচ্ছা, চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার অনুষ্ঠান— নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরেও এ সবের প্রতিসরণ ঘটেছে। গাজির গান, বাউলের মতো বহু আঙ্গিক আবার বিভিন্ন জেলাব্যাপী দেখা যায়। ঠাকুরগাঁর নেকমর্দের মেলা, চট্টগ্রামের মহামুনি বৌদ্ধমেলা, মানিকগঞ্জের সিদ্ধাবাড়ির শোভাযাত্রা, ধামরাইয়ের রথযাত্রার মতো বড় মাপের আয়োজন-সহ আছে কত শত মেলা-উৎসবের দীর্ঘকালীন রীতি। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডা, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বগুড়ার দই যেমন জায়গার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। চলনবিলের নামের সঙ্গে অদূরবর্তী তাড়াশের দইমেলারও খ্যাতি। এই এলাকাতেই চৈত্র মাসের প্রথম শুক্রবারের ওরশ শরিফের পরের দু’দিন হয় বউমেলা। বঙ্গসমাজের এমন কত অন্তর্বাহী রূপ ছড়িয়ে আছে খণ্ডে খণ্ডে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে কাঁঠাল পাতার উপরে নকশি পিঠে যেমন, আবার আত্মীয়বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় অনিষ্টকারী কিছু যাতে সঙ্গে না যায় তাই পিঠের সঙ্গে থাকে কয়লা, শুকনো পাটপাতা, কাঁচা হলুদ! অঞ্চল ভেদে কত নিয়ম। বাংলাদেশের পুব প্রান্তের চট্টগ্রামের কথ্য ভাষা যেমন পশ্চিমের যশোরের সঙ্গে মেলে না। আবার মুসলিম সংস্কৃতির রীতি-বৈচিত্রের নানা দিক যেমন; আছে হিন্দু জমিদারদের অতীত গৌরবগাথার তথ্য, অট্টালিকা-দেবালয়ের স্থাপত্য। আরও প্রাচীনত্বের ধাত্রীভূমি হয়ে আছে বগুড়ার মহাস্থান, নওগাঁর পাহাড়পুর বা কুমিল্লার ময়নামতির মতো প্রত্নকাঠামো। লোকায়ত জীবন এই ইতিহাসের পথ ধরেই বহমান।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বৃহত্তর বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্রান্সিস বুকাননের মতো বিদেশিরা সমীক্ষায় প্রয়াসী হলেও, লৌকিক জীবনাচরণের তথ্য সংগ্রহে জেলাভিত্তিক কোনও কাজ হয়নি। তবে এই ভূখণ্ডে ১৮৬১ সালে প্রথম কালীকমল সার্বভৌম বাংলায় বগুড়া নিয়ে ইতিহাস রচনা করেন। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের মধ্যেই আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বিক্রমপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, রাজশাহি, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল, যশোর-খুলনার স্থানিক ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে। এ সবই ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগ। বর্তমানের এই সংগঠিত সমন্বয়ী প্রয়াসে জীবন ও জনপদের লৌকিক বয়ানের প্রকাশ ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে যেখানে চৈত্র-অষ্টমীতে স্নানের বিপুল সমারোহ হয়, সেখানে অন্য সময় গেলে ব্রহ্মপুত্র নদের ক্ষীণ ধারার সঙ্গে মেলানো যায় না। আবার অন্য দিকে মনে পড়ে যায় বগুড়ার দুর্গোৎসবে মাটির খেলনাপুতুল নিয়ে বসা উলিপুরের মৃৎশিল্পীদের কথা। সমসাময়িক এমন ধারার বহু ছবিও গ্রন্থমালার খণ্ডে খণ্ডে আছে, যা মুদ্রণে বাড়তি যত্ন নিলে মূল্যবান নথি হতে পারত। আজও দেশভাগে ভারতভূমির এ পার বাংলা তো বটেই— অসম, ত্রিপুরার মতো সীমান্ত-রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বাঙালির কাছে, সমাজ-রাজনীতির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে ভিটেমাটি ছেড়ে আসা কত বেদনাবহ হয়ে আছে। পোড়ামাটির কাজ, বাঁশের ঝুড়ি, ঢেঁকি, পাল্কি, পানের বাটা, জাঁতা, হুঁকো, মাছ ধরার সরঞ্জাম, হাটবাজার, মেলা-পরবের কত উপাদান আর আত্মীয় পড়শির স্মৃতিখোঁজা মন আর্দ্র হবেই। আদি খুলনার অনাদিজ্ঞান সরকার পশ্চিমবঙ্গের বাড়িতে এসে থিতু হতে পারতেন না। বার বার চলে যেতেন বাংলাদেশে। প্রখ্যাত কবিয়াল বিজয় সরকারের পাল্লাদার হননি শুধু, কবিগানে তাঁর ছিল সমৃদ্ধ পারিবারিক ধারা। এ পারের বাড়িতে বছর কুড়ি আগে কথায় কথায় বলছিলেন, ‘‘সরস মন নিয়ে থাকতে গেলে এখনও বাংলাদেশই ভাল।’’

জেলায় জেলায় এ সব বিষয়ের তথ্য সংগ্রহে সংগ্রাহক ভেদে তারতম্য স্বাভাবিক। তবে, এলাকাভিত্তিতে জনজাতীয় গোষ্ঠীর আলোচনায় আদিবাসী সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতির তাত্ত্বিক বিভাজন হতেই পারত। লোকনাট্য ও লোকসঙ্গীতের রীতিকাঠামোয় কোনও ক্ষেত্রে কবিগান, গাজির গান লোকনাট্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আবার লোকভাষার স্বতন্ত্র আলোচনা নেই। চারুশিল্প, কারুশিল্প, কুটিরশিল্প, লোকশিল্পের সুনির্দিষ্ট পৃথক পরিচয়ও বহুলাংশেই অস্পষ্ট। এ সবে বিতর্কের অবকাশ থেকে যায়।

তবে এ সব প্রশ্ন বৃহত্তর পটভূমিতে থিতিয়ে যায়। দেশব্যাপী এই কাজ শুধু প্রবহমান লোকজ সংস্কৃতিকে দেখা, তথ্য নিবন্ধীকরণ বা পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা নয়— বাংলাদেশে ফোকলোর আলোচনাকে যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর প্রয়াসের অঙ্গীকার আছে এই প্রকল্পে। তাই প্রতিটি খণ্ডের প্রসঙ্গ-কথায় সমঝদারি ঘোষণা— ‘‘‘লোকসাহিত্য’ বলেই ফোকলোরের সব উপাদানকে চালিয়ে দেওয়ার একটি ধরতাই প্রবণতা দেখা যায়।’’ এই অসঙ্গতি থেকে উত্তরণেরও আন্তরিক প্রয়াস আছে এখানে। এই কাজ দেখলে, এ পার বাংলার লোকসাহিত্যে লালিত প্রাতিষ্ঠানিক বা পাঠক্রমিক লোকসংস্কৃতি চর্চা-গবেষণার অপুষ্ট ধাঁচ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চা দীর্ঘ দিন যাবৎ যে ভারসাম্য রক্ষায় ব্রতী তা এই বড় পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠা পেল। যে পরিকল্পনায় রূপায়িত হয়েছে ঢাকা, রাজশাহি, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলিতে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, কপোতাক্ষ, রূপসা, পদ্মার মতো শত-নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আবিষ্ট জীবন-অন্বেষণ। সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে সরাচিত্র ও পাল্কি বা ঢাকার বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে হাতপাখায় সুচসুতোর কাজে যখন লেখা দেখি— ‘‘দিন যায় কথা থাকে’’, তখন সুচারু বঙ্গসমাজ ও সংস্কৃতির কথাই মনে পড়ে যায়। জেলাভিত্তিক গ্রন্থমালায় সে সবেরই উৎখনন ঘটেছে। এই সূত্রে লালন ফকির, দুদ্দু শাহ, হাছন রাজার মতো মহাজনদের লৌকিক সঙ্গীতধারা আর গৌণধর্মের আকরভূমিরও খোঁজ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ গীতিকার আদি চর্চাভূমি আজ জেলাবিন্যাসে নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ হলেও, বা জেলা-উপজেলার সাবেক চৌহদ্দির পরিবর্তন ঘটলেও উৎসারিতের মায়ামেদুরতা থেকেই যাবে। লোকজীবনের অমিত উপলব্ধির টান দেশকালের আঙিনাতেই প্রতিষ্ঠা পায়।

এই বিদ্যা চর্চা পরিচয়ের ব্যঞ্জনা দেখতে দেখতে বার বার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশব্যাপী এই সমীক্ষা-তথ্য বাঙালি জাতির আত্মবৈভবকেই পরখ করা। এই খোঁজে কিছু অসম্পূর্ণতা থাকলেও, ভাবীকাল স্মৃতিসত্তায় মগ্ন হবে— থাকবে অনুভবী গবেষণার রসদও। জেলা থেকে জেলার জনপদকথার এই বর্ণিল রূপ বঙ্গজীবন ও সংস্কৃতির সহজপাঠ। এটাই জাত্যভিমান— ভালবাসা আর একাত্মতার নিবিড় টানেই রূপায়িত হতে পারে এমন সার্বিক ভাবনা। বাঙালি জীবনের লোকজ ধারার বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ধরা রইল এই সারস্বত অন্বেষণে।

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy