Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
book review

পলাশি কি কেবল লোভের আখ্যান

ক্লাইভ নামক এক বেপরোয়া কিশোরের অস্থির শৈশব বা আলিবর্দির প্রাত্যহিক দিনযাপন, যুদ্ধের তৈলচিত্রগুলির ব্যাখ্যা।

বিজয়ী: রবার্ট ক্লাইভ ও মিরজাফর, পলাশির যুদ্ধ শেষে। শিল্পী ফ্রান্সিস হেম্যান।

বিজয়ী: রবার্ট ক্লাইভ ও মিরজাফর, পলাশির যুদ্ধ শেষে। শিল্পী ফ্রান্সিস হেম্যান। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্‌স।

শেখর ভৌমিক
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২১ ০৮:০৩
Share: Save:

১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের ১৫০ বছর উদ্‌যাপন কালে প্রকাশিত উইলিয়ম ডালরিম্পলের লেখা দ্য লাস্ট মোগল: দ্য ফল অব আ ডাইন্যাস্টি: দিল্লি, ১৮৫৬ বইটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। চটক, তথ্য দুই-ই ছিল। যে কোনও পপুলার হিস্ট্রি লেখার মুনশিয়ানাই এখানে। সদাসতর্ক থাকতে হয়, আখ্যানটি আবার যেন ঐতিহাসিক উপন্যাস না হয়ে যায়। সেন্ট স্টিফেনস কলেজের ইতিহাসের প্রাক্তনী সুদীপ চক্রবর্তী অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

আমাদের দেশে ইতিহাসের তথ্য, আকর ঘেঁটে পলাশি নিয়ে প্রথম যে ইতিহাসের গল্পটি লেখা হয়, তা হল তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের পলাশির যুদ্ধ। যে যুদ্ধের চেয়ে ছোটখাটো দাঙ্গাতেও ঢের বেশি লোক মরে, লেখকের মতে সেই যুদ্ধ এক সন্ধিক্ষণ— মধ্যযুগের অবসান ও বর্তমান কালের উত্থান। সুদীপের কাছে অবশ্য এই যুদ্ধ আদ্যন্ত এক ‘বেওসা’, যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে মুনশি নবকেষ্টর মতো লোক রাতারাতি মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর হয়ে গেলেন।

তিনটি পর্বে— ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’, ‘বিল্ড-আপ’ আর ‘ব্যাটল’— মোট ২১টি ছোট ছোট অধ্যায়ে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু-পরবর্তী সময় থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত বাংলার রাজনৈতিক বৃত্তান্ত তিনি ধরেছেন। শেষ করেছেন মিরজাফর বংশের সৈয়দ রেজা আলি খানের এই অনুযোগ দিয়ে যে, তাঁদের পরিবার এক ঐতিহাসিক অবিচারের শিকার।

শুরুতেই পরিচয় করিয়েছেন যুদ্ধ সম্পর্কে নানা জনের মতের সঙ্গে। কেউ বলছেন যে, ইংরেজ আর তার দেশীয় শাগরেদদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো সিরাজকে সরানোর জন্যই এ ছিল ইংরেজদের এক চক্রান্ত। ক্রিস্টোফার বেইলির মতো ইতিহাসবিদরা বলেন, দেশীয় অভিজাতদের সমর্থন ছাড়া ষড়যন্ত্র দানাই বাঁধত না। আবার আর এক দল ‘রাজ-বান্ধব’ ইতিহাসবিদদের কথা বলেছেন, যাঁরা মনে করেন ‘গদ্দারি’, ‘বেইমানি’— সবই ছিল এ দেশের দস্তুর। ঔরঙ্গজেবের ভ্রাতৃহত্যা থেকে আলিবর্দি কর্তৃক সরফরাজ হত্যা— সবই তার প্রমাণ। লেখকের বিবেচনায়, এই ঘরানা অনুযায়ী পলাশি গদ্দারদের মিছিল নয়, ‘মার্সি বিজ়নেস অ্যাজ় ইউজুয়াল’। এরই সঙ্গে এসেছে ‘কোম্পানি স্পনসর্ড নিউ বেঙ্গল’-এর প্রতিনিধিদের কথাও, যার মধ্যে আছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর, যাঁর বয়ানে সিরাজ ‘অতি দুরাচার’। তাঁর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করেন ইংরেজরা।

পাশাপাশি, জাতীয় ইতিহাস আর স্বাধীন দেশের নিজস্ব সত্তা নির্মাণের তাড়নায় বাংলাদেশে পলাশি নিয়ে নতুন করে চর্চার কথা বলতে গিয়ে উইলিম ভ্যান সেন্ডেল-এর আ হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ-এর উল্লেখ করেছেন। সঙ্গে দিয়েছেন সিরাজকে নিয়ে সে দেশে বায়োপিক তৈরির বিবরণ, যেখানে বাংলার নবাব থেকে সিরাজ আদ্যন্ত এক বাঙালি নবাবে পরিণত। বাংলাদেশ থেকে বেরনো আবুল কালাম মোহাম্মদ জ়াকারিয়ার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’র কথাও লিখেছেন। এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় কিন্তু ২০০৬-এ। লেখকের উল্লেখ অনুযায়ী ২০১৫-তে নয়। সিরাজের প্রতি জ়াকারিয়ার আবেগের নমুনাস্বরূপ তাঁর সম্পর্কে বার বার ‘হতভাগ্য’ শব্দটি ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন সুদীপ। তবে এর অনেক কাল আগে শ্যামধন মুখোপাধ্যায়ের মুরশিদাবাদের ইতিহাস (১৮৬৪)-এও সিরাজ ‘হতভাগ্য’। এপার বাংলাতেই ১৩৪৫-এ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সিরাজদৌলা নাটকে লিখে গিয়েছিলেন “তাঁর (সিরাজের) পরাজয় বাংলার পরাজয় হলো। তাঁর পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গাঁলী হলো পতিত।”

সিরাজকে নিয়ে বাঙালির আবেগের সূচনা সম্ভবত অক্ষয়কুমার মৈত্রের সিরাজদ্দৌলা থেকেই। সে বইয়ের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ইতিহাসের চিরাপরাধী অপবাদগ্রস্ত দুর্ভাগা সিরাজদ্দৌলার জন্য পাঠকের করুণা উদ্দীপন করিয়া তবে (তিনি) ক্ষান্ত হইয়াছেন।“

পলাশি কি কেবল লোভ, মুনাফা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষায় মজে থাকা কিছু মানুষের ছবি? এটা কি এক অপমানিত ব্যাঙ্কার (জগৎ শেঠ), উচ্চাকাঙ্ক্ষী মাসির (ঘসেটি বেগম) বদলা? যুদ্ধ নামক এই হাতাহাতির জয় কি পূর্বাহ্ণেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল?— এই রকম নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে সূচনায়। প্রথম থেকেই সিরাজকে ইংরেজদের অবহেলার যে কথা জিল বলেছিলেন, সুদীপ তার অনেকটাই উল্লেখ করেছেন। ‘দস্তক’ বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ও বেআইনি ব্যবহার যে ভাবে ইংরেজরা শুরু করেছিল, তা অসহনীয় হয়ে ওঠে সিরাজের কাছে। অনেকে আবার বলেন যে, কুচরিত্রের কারণে সিরাজের প্রতি লোক রুষ্ট হয়ে পড়েছিল। বাজারচলতি কিছু কুৎসার উল্লেখও করেছেন লেখক। তবে এই উল্লেখ থাকলে ভাল লাগত যে, মসনদে বসে সিরাজ নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেন। ঘসেটি বেগমকেও বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাগে আনতে পেরেছিলেন বলে তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহাবতজঙ্গি’তে লিখেছেন ইউসুফ আলি।

একই ভাবে চক্রান্তের অনেকটাই যে ইংরেজের ছক, তা দেখালে গল্প জমে উঠত। ওয়ালশ আর স্ক্র্যাফটনের অনেক নথি দেখলাম। কিন্তু ৯ এপ্রিল লেখা স্ক্র্যাফটনের ওই চিঠি নজরে এল না, যেখানে ওয়ালশকে তিনি লিখছেন একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর কথা। ওয়াটস-কে একটু হাওয়া দিলেই তিনি একটি দল তৈরিতে নেমে পড়বেন, আর ‘মাই ওল্ড ফেভারিট স্কিম’টি সফল হবে। সিলেক্ট কমিটির অনেক নথি থাকলেও নেই ১৭ মে স্ক্র্যাফটনকে দেওয়া তার নির্দেশটি, যেখানে মিরজাফরের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে আমাদের পরিকল্পনাটি কী ভাবে রূপায়িত হবে, তা ঠিক করতে বলা হয়। স্বয়ং জিল সিরাজের দাবিগুলো যথাযথ বলতে দ্বিধা করেননি, সুদীপের বিবেচনায় তাই তো জিল ‘ব্যালান্সড ক্লাসিক্যাল কমেনটেটর’।

বইয়ের কয়েকটি বিষয় বেশ নতুন। ক্লাইভ নামক এক বেপরোয়া কিশোরের অস্থির শৈশব বা আলিবর্দির প্রাত্যহিক দিনযাপন, যুদ্ধের তৈলচিত্রগুলির ব্যাখ্যা। বলছেন, রক্তের দাগহীন তরোয়াল, বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ সেনার ঝকঝকে ইউনিফর্ম— এ সবই নাকি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াকে ‘স্পটলেস’ দেখানোর তাগিদে।যু

দ্ধশেষে দেশীয় চক্রান্তকারীদের মধ্যে সম্পদের অসম বণ্টনের কথা বলেছেন লেখক। কেবল উমিচাঁদ (বইয়ে তাঁকে কেন ‘উমাচাঁদ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা বোঝা গেল না) কেন, ষড়যন্ত্রের অন্য কুশীলবদেরও কী হাল হল, তা বললে আরও জমত। খোজা ওয়াজিদ ইংরেজের কৃপায় জেলে ঢুকল। জলে ডুবে মরবার সময় ঘসেটি বেগম মিরনের মাথায় বজ্রপাতের অভিশাপ দিয়ে যান। খাদিম হোসেনকে ধাওয়া করতে গিয়ে মিরন বজ্রাঘাতেই দেহ রাখেন। আর ওই খাদেম, যে কিনা সিরাজের দেহ তাঁর বাড়ির সামনে আসবার পর শোকে উন্মাদপ্রায় সিরাজ-জননী আমিনা বেগমকে প্রায় মারধর করে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, যাকে নাম না করে সুদীপ ‘ট্রেচারাস নোব্‌ল’ বলছেন, সে তরাইয়ের জঙ্গলে বোধ হয় বাঘের উদরেই গেল। আর ইংরেজের টাকার দাবি মেটাতে কাহিল মিরজাফর তো এক বার জিজ্ঞাসাই করে বসলেন, “আপনারা কি ভাবেন টাকার বৃষ্টি হয়?” মিরজাফরকে ক্লাইভের ‘প্রক্সি’ বললেও গল্পগুলো বাদ দিলেন কেন? তাঁকে তো ক্লাইভের ‘গর্দভ’ই বলা হত। সিরাজের মৃত্যুর পর তাঁর ইঙ্গিতে িমরন যখন লুৎফউন্নিসার কাছে নিকাহ-র প্রস্তাব পাঠান, তার জবাবে বেগমসাহেবা বলে পাঠিয়েছিলেন, যে জন চিরকাল হাতির পিঠে চড়ে বেড়িয়েছে, সে আজ কী করে গাধার পিঠে চড়ে বেড়ায়!

কয়েক জায়গায় মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ে। যেমন, সরফরাজের মসনদে বসার তারিখ ১৭৩৯-এর পরিবর্তে ১৯৩৯ ছাপা হয়েছে (পৃ ৪৭)। কিছু অনুবাদও বিভ্রান্তিকর। রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন, “কেবল একটি বিষয়ে তিনি ইতিহাস-নীতি লঙ্ঘন করিয়াছেন”, সেই ‘বিষয়ের’ অনুবাদ দাঁড়িয়েছে ‘ডিপার্টমেন্ট’। এত প্রাথমিক সূত্র ব্যবহার করলেন, কিন্তু ঠিক গল্প বলার মতো হল না।

একটি কথা না বললেই নয়, যে যুদ্ধ থেকে এ দেশে ঔপনিবেশিকতার সূচনা, সে ইতিহাস পড়তে গিয়ে যদি উপনিবেশের ভাষার দাপটেই পাঠককে বার বার হোঁচট খেতে হয়, তা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক ঠেকে। বড় বড় বাক্য, তৎসহ বহুবিধ তুলনায় অপরিচিত কঠিন শব্দ— একটু সহজ করে বলাই যেত। তবে ইংরেজি ভাষায় যে হেতু নির্দিষ্ট করে পলাশির যুদ্ধ নিয়ে এ রকম পপুলার হিস্ট্রি আগে তেমন লেখা হয়নি, সে অর্থে এই বই অবশ্যই গুরুত্ব দাবি করে। ছবিগুলোর উপস্থাপনও বেশ চমকপ্রদ।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy