জননায়ক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ছবি।
মহাকালের তর্জনী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিবেদিত কবিতা
সম্পা: কামাল চৌধুরী
৮০০.০০ বাংলাদেশি টাকা
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা
বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি
পঙ্কজ সাহা
২৫০.০০
সপ্তর্ষি প্রকাশন
দেশ বা রাষ্ট্রনেতাদের নিয়ে কবিতায় কিছু সমস্যার দিক থাকে। তা অনেক সময়েই সভাকবির ফরমায়েশি স্তুতি মনে হয়। স্বতঃস্ফূর্ততায় ঘাটতিও চোখে পড়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বাঙালির কাব্যচর্চা এক দীর্ঘ পথপরিক্রমা। তিনি জনতার হৃদয়ের নায়ক হয়েও রাষ্ট্রনেতা রাতারাতি হননি। নিজের দেশ, পড়শি ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে আবেগের সিংহাসনে বসেও ইতিহাসের দুর্বিপাকে ফের ‘নিষিদ্ধ স্বর’ হয়ে গিয়েছিলেন। আজকের বাংলাদেশ অন্তত দেড় দশক ধরে বঙ্গবন্ধুময়। তবু দীর্ঘ সময় নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমানদের লেখনীতে শেখ মুজিব যেন প্রতিস্পর্ধার পরোয়ানা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন সময়ের কবিতা তাই বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেরও এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতার সঙ্কলন মহাকালের তর্জনী বইটিতে সেই ঐতিহাসিক তাৎপর্যও নিহিত রয়েছে।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও কূটনীতিক কামাল চৌধুরী এই দিকটি নিয়ে সজাগ থেকেছেন। বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটিরও প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। তাই কবিতা সঙ্কলনটিতে কামালের লেখা ভূমিকাটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাহিত্য বা কবিতার আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধু চর্চার একটি ঠাসবুনোট ইতিহাসও সেখানে ধরা পড়েছে।
সঙ্কলনে জসীমউদ্দিনের কবিতাটি একদা মুক্তিকামী পুব বাংলা তথা মুক্ত বাংলাদেশে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। পশ্চিমবঙ্গবাসী বা ভারতীয় হিসেবে তার একটি দীর্ঘ স্তবকের উদ্ধৃতির লোভ সামলানো কঠিন। “এই বাংলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ,/ সন্ন্যাসী বেশে দেশবন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক।/ শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী জীবন করিয়া দান,/ মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।/ তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর/জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাংলার।/ তোমার হুকুমে রেল-জাহাজের চাকা যে চলেনি আর।/ হাইকোর্টের বন্ধ দরজা খুলিবে সাধ্য কার।/ সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত-ত্রাস!/ কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস।/ তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়,/ আমরা বাঙালি মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।”
দেশবন্ধু বা মহাত্মা গান্ধীর পথ ধরে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনে বঙ্গবন্ধুর অবদান কবিতায় ধরার ইতিহাসচেতনা আমাদের রোমাঞ্চিত করে। সেই সঙ্গে খানসেনাদের হারিয়ে বিজয়লাভের কয়েক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পরিণতির কথা ভেবে বিষাদগ্রস্ত হই। কামাল জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতা এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যবর্তী পর্বে ১৬ মার্চ ঢাকা বেতারে কবিতাটি পড়েন জসীমউদ্দিন। বেতারকর্মী বা আধিকারিকরাও তখন পশ্চিম পাকিস্তানের আনুগত্য ভুলে মুজিবময় হয়ে উঠেছেন।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের বহুলপরিচিত ‘যত কাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার, শেখ মুজিবুর রহমান’-এর বদলে এ সঙ্কলন তুলে ধরছে ১৫ অগস্ট, ১৯৭৫ মুজিব-হত্যার পরেই লেখা অন্নদাশঙ্করের কবিতা। হাহাকারময় কবিতাটির মর্মভেদী শেষ দু’টি লাইন যেন বাংলাদেশের চেতনার গোড়া ধরে টান দেয়। “বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো নাকো নীরব দর্শক/ ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক!” সঙ্কলনে দুই বাংলার এ কাল-সে কালের বিশিষ্ট কবিরা অনেকেই উপস্থিত। মুজিব-শতবর্ষেও কয়েক জনের থেকে কবিতা সংগ্রহের কথা বলেছেন সম্পাদক। সাম্প্রতিক কবিতাগুলির কয়েকটি কিন্তু উৎকর্ষে পূর্বসূরিদের থেকে খানিকটা পিছিয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনেও এক আশ্চর্য সৃষ্টিশীল সময়। তার কিছু মুহূর্ত উঠে এসেছে সেই সময়ে আকাশবাণীর যুববাণীর তরুণ কর্মী পঙ্কজ সাহার স্মৃতিকথাতেও। অংশুমান রায়ের কণ্ঠে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘শোন একটি মুজিবরের’ গানটি ‘সংবাদ বিচিত্রা’য় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার সঙ্গে মিলিয়ে মন্তাজের ঢঙে পরিবেশন করেন প্রযোজক উপেন তরফদার। লেখক লিখেছেন আকাশবাণীর সেই অবিস্মরণীয় অনুষ্ঠানের এডিটিং-পর্বে উপেনের সঙ্গী হিসেবে স্টুডিয়োয় থাকার কথা। ঢাকা বেতার থেকে রেকর্ড করা বক্তৃতা সম্প্রচার করলে কর্তৃপক্ষ কী মনে করবেন, সেই আশঙ্কাতেও কিছুটা ঘাবড়েছিলেন তরুণ বেতারকর্মীরা।
১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর সভায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধায় প্রমুখের সঙ্গে ধারাভাষ্যের অভিজ্ঞতাও লিখেছেন লেখক। পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। লেখকের স্মৃতিচারণ, কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর সম্মানে বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ বেতার-অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং-এ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখেরা মুজিবের ভবিষ্যৎ তথা জীবনসঙ্কট নিয়েও নানা আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। ভুল বোঝাবুঝি এড়িয়ে সাবধানি ভাষ্য লিখে বিষয়টা সম্প্রচার করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দুষ্প্রাপ্য ছবি এবং লেখকের লেখা কবিতার মিশেলে বইটি সুবিন্যস্ত। আকাশবাণীর মুক্তিযুদ্ধকালীন সম্প্রচার নিয়ে অন্যত্র বিক্ষিপ্ত ভাবে লিখেছেন বেতারকর্মী প্রণবেশ সেন, উপেন তরফদার প্রমুখ। স্মৃতিনির্ভর এ সব লেখায় কিছু তথ্য পরস্পরবিরোধী। সেই সময়কার কুশীলবেরাও অনেকে প্রয়াত। এই বইটি পড়ে মুক্তিযুদ্ধে কলকাতার ভূমিকা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস-গাথা না থাকার আক্ষেপও কিন্তু ঘনিয়ে ওঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy