অলোক রায়ের পরিচয় বিবিধ। আইনজীবী, শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ, আইনের শিক্ষক, এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। পত্রপত্রিকা ও পেশাগত জার্নালে প্রকাশিত তাঁর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইন বিষয়ক প্রবন্ধগুলি পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের পর এই গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে।
আইন বলতে মানুষের চোখে মামলা-মকদ্দমার এক দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়া ফুটে ওঠে। ‘ঘরে মামলা লাগা’ এক অভিশাপ বলেই চিরকাল পরিচিত। কিন্তু এই আইনের উন্নয়নশীল বহুত্ববাদী কল্যাণকামী রাষ্ট্রে, আধুনিক সমাজ গঠনে এবং অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিতে তার এক বহুধাবিচিত্র মঙ্গলময় রূপ ছ’টি অধ্যায়ে বিভক্ত ও ৩৪টি প্রবন্ধে বিন্যস্ত এই সঙ্কলনগ্রন্থে ফুটে উঠেছে। লেখক মনে করেন যে, ১৯৯০-এর দশক থেকে ভারতে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের হাত ধরে যে নয়া অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়েছে, তার লক্ষ্য হল এক আত্মনির্ভর, ন্যায্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম এক অর্থনীতি সৃষ্টি করা। আইনকেই সর্ব অর্থে আধুনিক এই সমাজ ও অর্থনীতি সৃষ্টির এক অমিত ক্ষমতাশালী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যাকে লেখক দেখেছেন সর্বব্যাপী বিপ্লবের প্রতিস্পর্ধা হিসেবে।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের ১২টি প্রবন্ধের বিষয়সূচির মধ্যে আছে শ্রম আইন সংস্কার, সরকারি শিল্পোদ্যোগগুলির শৃঙ্খলিত ও পরবর্তী কালের বিলগ্নিকৃত অবস্থা, এই সব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আইনি জটিলতার পরিবর্তে সমঝোতার ব্যবস্থা (আরবিট্রেশন অ্যান্ড কনসিলিয়েশন অ্যাক্ট, ১৯৯৬), পূর্ববর্তী শিল্প শ্রমিক আইনগুলির বদলে ‘কোড অন ওয়েজেস, ২০১৯’, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সংক্রান্ত আইনকানুন ইত্যাদি। এ ছাড়া ই-গভর্ন্যান্স, ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি, সরকারি বনাম জাতীয় ছুটি সংক্রান্ত তিনটি ছোট প্রবন্ধ অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের আটটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর মধ্যে আছে, যে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ভাবে পরিষেবা প্রদান করে, যেমন চিকিৎসক, আইনজীবী ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের প্রতিষ্ঠান, তাদের কথা। বিশেষত, বিশ্বায়নের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষিতে এই পেশাগুলির সামাজিক দায়িত্ব ও আইনি অধিকারের কথা। লেখক সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেন যে, সংশোধিত ক্রেতা সুরক্ষা আইনের (২০১৯) দ্বারা উপভোক্তাদের অধিকার বৃদ্ধি পেয়েছে, আবার বহু ক্ষেত্রে তার অপব্যবহারও হচ্ছে। অন্য দিকে, যাঁরা পরিষেবা দিচ্ছেন তাঁরা যন্ত্র নন, মনুষ্যসুলভ ভুলভ্রান্তি ঘটতেই পারে। তাঁদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখানে আলোচিত হয়েছে। চিকিৎসক ও আইনজীবীদের তুলনায় স্বাধীন পেশাজীবীদের অপর ক্ষেত্র চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের কর্মক্ষেত্রের সমস্যা নিয়ে সচরাচর আলোচনা কম হয়। লেখক এখানে তা বিস্তৃত ভাবে তুলে ধরেছেন। এই পেশাদারদের সর্বভারতীয় সংগঠনগুলির নিয়ন্ত্রণকারী আইনসমূহ, যেমন কোম্পানি সেক্রেটারিজ় অ্যাক্ট (১৯৩০), চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট (১৯৪৯) ইত্যাদি যুগোপযোগী প্রয়োজন ও চাহিদার দিকে তাকিয়ে ২০০৬ সালে সংশোধিত হয়। অনুরূপ ভাবে, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল অ্যাক্ট (১৯৫৬) দ্বারা গঠিত মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার পরিবর্তে মেডিক্যাল শিক্ষা, প্রশাসন ও পরিষেবাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করার লক্ষ্য সামনে রেখে গঠিত হয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন ২০১৯। অসংগঠিত এবং শিল্পবহির্ভূত ক্ষেত্র, যেমন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয়, পেশাদার ফার্ম ইত্যাদিকে সাবেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউটস অ্যাক্ট সংশোধন করে ১৯৮২ সালে ওই আইনের আওতার বাইরে রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৩৮ বছরেও তা রূপায়িত হয়নি। ২০২০ সালের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড-এও প্রাক্-১৯৮২ থেকে চলে আসা স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়ের আটটি প্রবন্ধে মূলত নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা, যেমন শিশুশ্রমিক, বিচারাধীন বন্দি ও আগাম জামিনের ক্ষেত্রে মানবিকতা, নাগরিকত্ব, বহুত্ববাদী সমাজে বিবাহ ও লিভ-ইন সম্পর্ক, তথাকথিত অবৈধ সন্তান, এবং পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইনি ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ের দু’টি প্রবন্ধের একটিতে ধর্ষণের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার এবং প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ডদান, এবং অন্যটিতে সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকে অদ্যাবধি ভারতে আইনের বলে নারীকে কী কী সুবিধা দেওয়া হয়েছে, ও বাস্তবে সেগুলি কতটা কার্যকর হয়েছে, তার আলোচনা।
ল অ্যান্ড দি ইমার্জিং নিউ ইন্ডিয়া
অলোক রায়
৪৯৫.০০, অরুণা প্রকাশন
চতুর্থ ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে অতি সাম্প্রতিক কালের সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৯১ পরবর্তী অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের একচেটিয়া ব্যবসা-বিরোধী আইনের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণমুক্ত অর্থনীতির অনুকূল আইন হিসেবে ‘কম্পিটিশন অ্যাক্ট, ২০০২’ আনার তাৎপর্য আলোচিত হয়েছে। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটকে কেন্দ্র করে উন্নত ও উন্নয়নশীল দুনিয়ায় সংঘাতের কথা উঠে এসেছে। কোভিড-১৯ অতিমারির সুযোগ গ্রহণ করে ভারত রাষ্ট্র শ্রম আইন সংস্কারের নামে শ্রমিক বিরোধী যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে, একটি প্রবন্ধে লেখক তা চিহ্নিত করেছেন। সর্বশেষ প্রবন্ধে, শহর ও গ্রামে যে অজস্র অসংগঠিত শ্রমিক ছড়িয়ে আছেন, অতিমারি-উত্তর কালে তাঁদের স্বার্থ কী ভাবে রক্ষা করা যায় এবং একই সঙ্গে আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলা যায়, তার অনুকূল আইনকানুনের প্রয়োজনীয়তার কথা লেখক বলেছেন।
সামগ্রিক ভাবে দেখলে, গ্রন্থটি নিছক আইনের কেতাব না হয়ে সমকালীন ভারতের আর্থিক ও সামাজিক ইতিহাসের এক দর্শন হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধই তথ্যসমৃদ্ধ, রচনার গুণে আকর্ষক। কিন্তু বিভিন্ন রকমের পত্রপত্রিকায় নানা সময়ে প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হওয়ার কারণে কোনও সাধারণ বন্ধনসূত্র নেই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুনরুক্তি ঘটেছে। তার ফলে এটি সঙ্কলনগ্রন্থই থেকে গিয়েছে, মনোগ্রাফ হয়ে ওঠেনি। যদিও ইঙ্গিত রেখে গিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও গভীর চর্চার সুযোগের, যা বর্তমান লেখকের কাছে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের ভবিষ্যতের এক প্রত্যাশিত চাহিদা হয়ে রইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy