মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)
এক তীব্র, আর্ত, ক্রুদ্ধ ও বিকীর্ণ জীবন, কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়ে যা আমাদের স্তব্ধবাক করে, তা মূলত তাঁর সদা-জাগরূক আত্মসচেতনতা। ‘আড়াই বছর বয়স থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস আমি মোটামুটি জেনেছি।’ এমন ঔদ্ধত্য আন্তর্জাতিক স্তরেও খুব নজরে পড়ে না, কিন্তু অহঙ্কারের এই জড়োয়া গয়না মানিকবাবুর কণ্ঠে কেমন স্বাভাবিক ভাবেই ঝলমল করে ওঠে। সম্পাদক শুভময় মণ্ডল ও মানিক-তনয় সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ যে, এই প্রথম গল্প-উপন্যাস-কবিতা ব্যতিরেকে বিশ শতকের এক মহত্তম প্রতিভার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত নিবন্ধলোকে ভ্রমণের ছাড়পত্র পেলাম তাঁদের যুগ্ম সৌজন্যে।
সমগ্র প্রবন্ধ এবং, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্পাদনা শুভময় মণ্ডল, সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। দীপ প্রকাশন, ৩০০.০০
অবিশ্বাস্য মনে হয় অনুত্তর পঞ্চবিংশতি কোনও নবীন লেখক শরৎচন্দ্র প্রসঙ্গে লেখেন— ‘উপন্যাসের চরিত্র পাঠকের ইচ্ছা ও ভালোলাগাকেই সমীহ করে পরিণতির দিকে চলবে না। তার গতির মধ্যে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে, এমনকি লেখকের ব্যক্তিত্বের প্রভাব পর্যন্ত এড়িয়ে নিজের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলবে।’ কবিতায় তবু এলিয়ট পাঠের প্রভাবে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘কাব্যের মুক্তি’-র মতো প্রবন্ধ লিখেছিলেন, কিন্তু তিরিশ দশকের শুরুতে আধুনিকতা বিষয়ে এই মৌলিক মন্তব্য বাংলা গদ্যে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। আসলে ইতিহাস যাঁকে পুতুলনাচের ইতিকথা রচনার দায়িত্ব দিয়েছে, তিনি যে লেখকের নৈর্ব্যক্তিকতা সম্বন্ধে রক্তে ও মর্মে অবহিত থাকতে বাধ্য! এই বইয়ের অন্যতম সম্পদ মার্কসীয় সাহিত্যচর্চা বিষয়ে তাঁর রচনাগুলি। এ কথা ঠিক, যখন মানিকবাবু এই সব তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন, তখন ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ নামের এক সোনার পাথরবাটিতে প্রগতি সংস্কৃতি পরিবেশিত হত, ঝানভ তত্ত্বকে সাহিত্য বিচারের কাঁটা-কম্পাস মনে করার রেওয়াজও ছিল, তখন স্তালিন যুগ। এমনকি ভারতীয় সাম্যবাদীরাও, তাঁদের দুই সাধারণ সম্পাদক জোশী ও রণদিভে যুগে নীতি-বদলের যে লড়াই দেখা যায়, তাতে বেশ কিছুটা বিমূঢ়, অন্তত বিহ্বল বোধ করেছিলেন। গণনাট্য সংঘের ইতিহাস সেই উত্থান-পতনের বিবরণ দিতে পারে। মার্কসবাদ তো কোনও অজর, অনড় নারায়ণ-শিলা নয়, সুতরাং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিষ্ণু দে-র কিছু কিছু মন্তব্য আজ একদেশদর্শী মনে হতে পারে। সে যুগের অনেক নির্দেশিকাকেই আজ যান্ত্রিক ও মতান্ধ মনে হয়। আর মানিকবাবু নিজেও তা জানতেন। তার মার্কসবাদ এক দার্শনিক অনুসন্ধান, স্তাবকতা ও দলীয় আনুগত্য দিয়ে তার থই পাওয়া যাবে না। না হলে তিনি একদা লিখবেন কেন যে ‘অনেক অকৃত্রিম মার্কসবাদীর ঘরের তাক মার্কসবাদের বইয়ে এবং মাথা মার্কসবাদের সঠিক জ্ঞানে বোঝাই হয়ে থাকা সত্ত্বেও এ দেশে তবে এরকম মারাত্মক ঐতিহাসিক ভুল কি করে সম্ভব হল?’ ‘মহামানব স্তালিন’ যে তিনি লেখেন— এ ভুল তাঁর একার নয়, পিকাসো, নেরুদা, ব্রেশট, শলোকভ সবাই এই যুগের ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। কিন্তু যে-সব প্রজ্ঞানময় বাক্য মাঝেমধ্যেই ঝলসে ওঠে আমিষাশী তরোয়ালের মতো, তাকে উপেক্ষা করার জো নেই। যেমন ‘যৌন বিপর্যয়েরও একটা বিপ্লবাত্মক সত্য থাকে— বিপ্লবটা বাদ দিলে যা অর্থহীন।’ বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে শরৎচন্দ্র আর তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্রাজ্য— এর মধ্যে তথাকথিত কল্লোল যুগ, আজ বুঝতে পারি, যে একটি হাইফেনের অতিরিক্ত মর্যাদা পেল না তার কী প্রগাঢ় সমীক্ষা মানিকবাবুর কলমে— ‘বাংলা সাহিত্যে এই আধুনিকতা একটা বিপ্লবের তোড়জোড় বেঁধেই এসেছিল কিন্তু বিপ্লব হয় নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না— সাহিত্যের চলতি সংস্কার ও প্রথার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত তারুণ্যের বিক্ষোভ বিপ্লব এনে দিতে পারে না।’ কেন সাহিত্যের বাঁক বদলায়, কী ভাবে তার মর্জি পাল্টায়, তা নিয়ে মানিক বাবুর দেখার চোখই অন্য রকম। এ সব রচনা খুব আবেগসর্বস্ব আত্মকথন নয়, আর শুধু সাহিত্য তো নয়ই, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চিন্তার বহুস্বর ও বহুস্তরকে ধারণ করে থাকেন। তিনি যখন দেহের বসন্ত অটুট থাকার কথা ভাবেন, মানুষের সংস্কার নিয়ে অনুপুঙ্খে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চান, তখন বুঝি। মানিকবাবুর প্রগতি চিন্তা কিছু নিরবয়বী কথার বিস্তার নয়। ‘যৌনজীবন’ প্রবন্ধটি তো আমাদের সংস্কৃতিতে একটি আলোরেখা। লেখকের জিজ্ঞাসা যে কত গভীর, তা বোঝা যায় তিনি বিচ্ছিন্ন ভাবে সমাজ-প্রতিক্রিয়াকে দেখেন না, নানা রকম দৃষ্টি সংহত করে মার্কস ও ফ্রয়েডের মধ্যে একটি সাঁকো গড়ার রোমাঞ্চকর অভিযান শুরু করতে চান। সংশ্লিষ্ট বইটিতে দেখি ওয়াকারের ‘যৌনতার শরীরতত্ত্ব’ বইটি থেকে মানিকবাবু ‘নোটস’ নিচ্ছেন যে ঘ্রাণ সবচেয়ে কম উপলব্ধ হয়েছে ও আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বহীন ভাবে আলোচিত হয়েছে। আমাদের সাহিত্যে প্রেমের নামে যে টুংটাং জলতরঙ্গ বাজে সেখানে এ সব কথা আজও আগুনের ডালপালা। ‘নতুন জীবন’ জাতীয় যৌনবিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকার প্রকাশকে অভিনন্দিত করছেন বলেই নয়, ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাসে বিবসনা সরসীকে রাজকুমার যে-চোখে দেখে, তা এক সত্যদ্রষ্টার চোখ। তিনি মৃগীরোগ নিয়ে যে গবেষণা চালিয়েছেন, তার ভিত্তিতে বলা যায়, ফ্রয়েডকে সাক্ষী রেখে দস্তয়েভস্কির সঙ্গে মানিকবাবুর রক্তের নৈকট্য খুঁজে পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। দুর্ভাগ্য যে, মানিকবাবুর তুলনায় তাঁর আলোচকরা অনেক পিছিয়ে আছেন।
নতুন নাগরিকতার উন্মেষকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েকটি টুকরো লেখায় খেয়াল করতে চেয়েছেন। ‘হাওড়া ব্রিজ’ বিষয়ে তাঁর ছোট দুটি লেখা আধুনিকতার স্বপক্ষে একটি অনিবার্য ইস্তাহার। বিশেষত ‘রাজধানী’ লেখাটি পড়লে ‘অযান্ত্রিক’ জাতীয় ছায়াছবির পশ্চাৎপট খানিকটা হলেও বোধগম্য হয়। স্বল্পায়ু জীবনে লেখকের পেশা থেকে বন্দিমুক্তি কত-না বিচিত্র বিষয়ে তিনি চিন্তাকে নিযুক্ত রাখতে পেরেছেন। বইটির পাতা থেকে পাতায় পর্যটনের সময় আবার মনে হল নশ্বরতাকে ফাঁকি দিতে মানিকবাবু হাতে একটিই আমলকি রেখেছিলেন, তা মেধার ঐশ্বর্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy