শিল্পী: দ্বিজেন গুপ্ত
বাংলার আধুনিক চিত্র-ভাস্কর্যে নানা প্রবণতার মধ্যে দুটি প্রবণতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। একটি প্রতিবাদীচেতনা। আর একটি অধ্যাত্মচেতনা। প্রতিবাদীচেতনায় শিল্পী স্বাভাবিকতাকে বিশ্লিষ্ট করে বাস্তবের নানা সংকটকে উন্মীলিত করেন। অধ্যাত্মচেতনা-অন্বিত শিল্পে সেই বাস্তবতারই অন্তর থেকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বাস্তবাতীত কোনও মায়া। লৌকিকের ভিতরই আভাসিত হয় অলৌকিক। সেই অলৌকিক পুরাণকল্প-সম্পৃক্তও হতে পারে, বাস্তবতার গভীর থেকেও জাগতে পারে, আবার নিরবয়বের তন্ময়তা থেকেও উৎসারিত হতে পারে। নব্য-ভারতীয় ঘরানা যখন সন্ধান করছিল ঐতিহ্যগত আত্মপরিচয়, তখন নানা উৎসে বিস্তৃত হয়েছিল সন্ধান। তার মধ্যে পুরাণকল্পের কল্পনা যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রবহমান জীবনের নানা অনুষঙ্গও। পরবর্তী কালের আধুনিকতার বিস্তারে সেই উৎস নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর সঙ্গে মিশেছে সময়ের নানা জটিল বুনন। রূপান্তরিত সেই অধ্যাত্মভাবনা এখনও নানাভাবে পরিস্ফুট হচ্ছে আমাদের চিত্র-ভাস্কর্যে।
এরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচয় পাওয়া গেল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সম্মেলক প্রদর্শনীতে। আইটিসি সোনার-এর উদ্যোগে তাঁদের ‘ওয়েলকাম আর্ট গ্যালারি’তে দেখানো হল দু’জন চিত্রী ও দু’জন ভাস্করের কাজ। চিত্রী দু’জন : দ্বিজেন গুপ্ত ও রাম থোরাট। আর ভাস্কর ছিলেন রামকুমার মান্না আর উমা রায়চোধুরী। খুব যে সুপরিকল্পিত ছিল এই প্রদর্শনী তা বলা যায় না। কোন সূত্রে এই চারজনকে তাঁরা একত্রিত করেছেন সে কথা প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে বলা হয়নি কোথাও। কোনও তথ্যপঞ্জি তৈরি করারও প্রয়োজন বোধ করেননি উদ্যোক্তারা। তা সত্ত্বেও কাজগুলি নিজের আলোতেই দীপ্যমান হয়ে উঠেছিল।
দ্বিজেন গুপ্তের ছবির কেন্দ্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে সুস্পষ্ট এক মানবীভাবনা। আমাদের এই সমাজে নারীর প্রতি অবহেলা ও বঞ্চনা তাঁকে ব্যথিত করে। সেখান থেকেই উঠে আসে প্রতিবাদীচেতনা। এই প্রতিবাদীচেতনাই ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনায়। সেখানে নারী আর প্রকৃতি একাত্ম হয়ে যায়। বৃক্ষই মানবীর রূপ পায়। এ ধরনের ছবিতে তিনি বিশেষ এক রীতির কল্পরূপ আরোপ করেন, যে কল্পরূপে বাস্তব-অতিক্রান্ত সত্যের কিছু আভাস থাকে। এই প্রদর্শনীতে তাঁর সেরকম ছবি কয়েকটি ছিল। এখানে অন্তত তিনটি ছবিতে তিনি যেভাবে নারীর স্বাধীন সত্তাকে অভিব্যক্ত করেছেন, ভাবনা ও আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলি বিশেষভাবে স্পর্শ করে। ‘ওয়ারিয়র’ ‘দ্য কিং অ্যান্ড দ্য সিঙ্গার’ এবং ‘মারমেড’ – এই তিনটি ছবিতেই পরোক্ষভাবে পুরাণকল্পের কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে। তা থেকেই শিল্পী উন্মীলিত করেছেন আধ্যাত্মিক আবহ। তসর কাপড়ের উপর জলরং মাধ্যমকে নিপুণ দক্ষতায় তিনি ব্যবহার করেছেন দ্বিতীয় ছবিটিতে।
রাম থোরাট তেলরঙের ক্যানভাসে পুরাণকল্পমূলক বিষয় নিয়ে চিত্রপ্রতিমা গড়ে তোলেন সামগ্রিক এক আধ্যাত্মিক উন্মীলনের জন্যই। তার ‘তৎ-ত্বম-অসি’ ও ‘বুদ্ধ’ এই দুটি ছবিই সাংকেতিক ভাষায় বিমূর্তায়নের মধ্য দিয়ে সেই আধ্যাত্মিক উন্মীলনের অসামান্য দৃষ্টান্ত।
টেরাকোটা-ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না একজন সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী। লৌকিক চেতনা থেকে পৌরাণিক দেবদেবীর প্রতিমাকল্পের মধ্য দিয়ে তিনি যে আধ্যাত্মিকতার উন্মীলন ঘটান, তাতে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিই নানাভাবে আলোকিত হয়। প্রদর্শনীতে তিনি টেরাকোটা ছাড়া কয়েকটি ব্রোঞ্জও করেছেন। ‘মিউজিশিয়ান’ শীর্ষক দুটি রচনা আছে। টেরাকোটায় তিনি বাঁশি-হাতে কৃষ্ণকে উদ্ভাসিত করেছেন। দণ্ডায়মান কৃষ্ণের শরীরে পত্রমঞ্জরির অলঙ্করণ। আর তাঁর পায়ের কাছে ভূমিতলে রয়েছে কয়েকটি পাখি। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তারা। ব্রোঞ্জটিতে বীণা হাতে সরস্বতী মূর্তি। ‘দুর্গা’ শিরোনামে একটি আবক্ষ মানবীমূর্তিও রয়েছে। মানবীই এখানে দেবীতে উত্তীর্ণা হয়েছেন।
উমা রায়চৌধুরী তাঁর ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্যে ততটা ধ্রুপদী লৌকিক সারল্য ব্যবহার করেননি, যতটা করেছেন অভিব্যক্তিবাদী অনুষঙ্গ। নারীর বদ্ধতা তাঁরও রচনার বিষয়। সেই প্রতিবাদীচেতনা থেকেই তিনি পরোক্ষে নারীর মুক্তির ইঙ্গিতও এনেছেন, যেখান থেকে আধ্যাত্মিকতারও বিচ্ছুরণ ঘটেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy