পয়লা এপ্রিল চলে গিয়েছে অনেক দিন আগে, কিন্তু হোম লোন বা বাড়ির জন্যে ঋণ দেওয়ার সময় ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা গ্রাহকদের বোকা বানাতে ছাড়ছেন না। বাড়ির ব্যাপারে আমরা খুব অনুভূতিশীল। তার উপর, নিজের বাড়ি কেনা মানে আপনার সামাজিক অবস্থার উন্নতি— ভাড়াটে থেকে একেবারে বাড়িওয়ালা! ফ্ল্যাটের যা দাম হয়েছে, লোন ছাড়া কিনতে পারে শুধু টাটা, বিড়লা এবং অম্বানী। কিন্তু হোম লোন যতই হিসেব করে কম সুদ দিয়ে নিতে যান না কেন, ব্যাঙ্কের লোক আজে বাজে অনেক প্রোডাক্ট আপনাকে গছাতে চাইবে। না কিনলে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আপনাকে এক প্রকার জোর করবে। খুব সাবধান। ভারতের আইনে কোথাও লেখা নেই যে, বাড়ির লোন নেওয়ার সময় জীবন বিমা কিংবা অন্য কিছু কেনা আবশ্যক। আসুন দেখা যাক কী ভাবে হচ্ছে এই ছলনা এবং কী ভাবে করতে পারেন এর প্রতিকার।
হোম লোনের ব্যাপারে জ্ঞান কম বলে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা গ্রাহকদের বছরের পর বছর বোকা বানাচ্ছে। এই প্রতারণা কী ভাবে হচ্ছে সেটা আপনাদের বুঝতে হবে।
ধরুন, আপনি এবং আপনার পরিবারের লোক ব্যাঙ্কে গেলেন হোম লোন নিতে। বাড়ি পছন্দ হয়েছে বলেই আপনারা হয়ত খুব অধীর। কিন্তু আপনাদের হড়বড় দেখেই ব্যাঙ্কের লোক ঠিক করে নেয় আপনাকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাবে।
আপনি হোম লোনের জন্য দরখাস্ত করলেন, সব নথিপত্র দিলেন, নিজের আয় দেখিয়ে লোন ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা বোঝালেন, এবং তারপর অপেক্ষা করছেন। ফ্ল্যাট প্রোমোটার রোজ তাগাদা দিচ্ছে। হঠাৎ একদিন ব্যাঙ্কের লোক ফোন করে ডাকবে। বোঝাবে যে লোন আপনি পেয়ে গেছেন কিন্তু একটা লাস্ট-মিনিট কাজ করতে হবে, জীবন বিমা কিনতে হবে। মিষ্টি কথা বলে গ্রাহককে বোঝানো হয় যে এই পলিসি আপনার পরিবারের জন্য। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন কী ভাবে জীবম বিমা পলিসি হোম লোনের জন্য আবশ্যক, তখন বলবে যে আপনি লোনের টাকা পুরো ফেরত না দিয়ে মারা গেলে, এই পলিসি ব্যাঙ্ককে টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। আপনি যদি বলেন যে আপনার কাছে ইতিমধ্যে অনেক বিমা করা আছে, ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা মানবে না। বলবে হোম লোন নিতে হলে এই 'হোম ক্রেডিট শিল্ড' পলিসি নিতেই হবে। হয়ত বলবেন, "এটাই ব্যাঙ্কের নিয়ম। নিয়ম মানতেই হবে।
আরও পড়ুন: লোন চাই? জীবন বিমা পলিসি আছে তো? চিন্তা নেই...
বিক্রি করতে চায় অতিরিক্ত পলিসি
অনেকেই হোম লোন কেনার সময় একটা উটকো পলিসি কিনতে চান না। এর কারণ হল এই পলিসির সব প্রিমিয়াম একবারেই দিতে বলবে ব্যাঙ্কের লোক। অন্য সব পলিসির বার্ষিক প্রিমিয়াম কিন্তু এ ক্ষেত্রে অন্য নিয়ম কেন? আসল কথা হল আপনার হোম লোনের কথা শুনে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা বেশি কমিশন কামাবার ফন্দি এঁটেছে।
আপনি যদি ৫০ লাখ টাকার লোন নেন, তা হলে এই পলিসি হবে লোনের পরিমাণ, অর্থাত্ ৫০ লাখ টাকার। এক সঙ্গে প্রায় ২০ বছরের প্রিমিয়াম নিয়ে নেওয়া হয়, যা মোটামুটি ১-১.৫ লাখ টাকা! ইনসিওরেন্স কোম্পানি এই ধরনের পলিসির জন্যে ব্যাঙ্ককে খুব কম কমিশন দেয় কিন্তু এক সাঙ্গে ২০ বছরের প্রিমিয়াম দিলে, কমিশনের পরিমাণ অনেক বেশি। এই অনাবশ্যক পলিসি যে বিক্রি করতে পারে, সেই পাবে ওই জ্যাকপট!
আপনার কাছে টাকা নেই বলেই আপনি গিয়েছিলেন ব্যাঙ্ক লোন নিতে। এ বার এই ১-১.৫ লাখ টাকা প্রিমিয়াম কোথা থেকে দেবেন? তখনই ব্যাঙ্কের লোক আপনাকে বলবে, চিন্তা করবেন না, ব্যাঙ্কই দেবে টাকা। সত্যিই কি ব্যাঙ্ক দেবে? শেষ পর্যন্ত আপনিই দেবেন। এই পলিসির প্রিমিয়ামের টাকা হোম লোনের পরিমাণের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হয়। ব্যাঙ্কের এই কীর্তির ফলে মূল প্রিমিয়াম এবং তার উপর ৮-৯% সুদ চাপিয়ে পুরো টাকাটাই আপনাকে দিতে হবে। বিমা পলিসি কিনতে কেউ লোন দেয় না, কিন্তু ব্যাঙ্কের প্রতিবিধিরা আপনার হোম লোনে ওই প্রিমিয়াম ঢুকিয়ে দেবেন। এটাই হল প্রতারণার একটা বড় অংশ।
কী ভাবে প্রতিকার চাইবেন
প্রথম কথা হল হোম লোন নেওয়ার জন্য কোনও জীবন বিমা নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এই নিয়ে খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কোনও দিন বলেনি যে পলিসি নিতে হবে। কিন্তু কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক প্রতিনিধিরা এই নিয়ে নানা মিথ্যা কথা বলে। অনেকে ঋণ পাওয়ার আশায় প্রশ্ন করে না। তারা ভাবে, এই ক্ষুদ্র ঝামেলার কারণে হোম লোন পেতে দেরি হয়ে যাবে, বা দুর্ভাগ্য হলে আটকেই যাবে।
দ্বিতীয়ত, হোম লোনে বছরে সুদ ৮-৯%। পলিসি প্রিমিয়াম হোম লোনের পরিমাণে ঢোকা মনে আপনার ই.এম.আই বেড়ে যাওয়া। বাইরে থেকে একটা পলিসি কিনলে বছর বছর আপনি প্রিমিয়াম দিতে পারতেন। কিন্তু ব্যাঙ্কের খপ্পরে পরে কুড়ি বছরের লোনে মানুষ এমনিতেই দু’গুণ টাকা ব্যাঙ্ককে ফেরত দেয়। এর উপর যদি নতুন বিমা পলিসির টাকা লোনে যোগ হলে, আপনাকে এই অঙ্কটিও দু’গুণ দিতে হবে।
আপনি যদি ৪০ লাখ টাকার ২০ বছরের লোন নেন ৮.৪% বার্ষিক সুদে, তা হলে আপনাকে মাসে দিতে হবে ৩৪, ৫০০ টাকা বা সব মিলিয়ে ৮৩ লাখ টাকা। ১.৫ লাখ টাকার পলিসি যদি যোগ হয় লোনের সঙ্গে তা হলে ৪১.৫ লাখ টাকার জন্যে মাসিক দিতে হবে ৩৫,৬০০ টাকা বা কুড়ি বছরে সব মিলিয়ে প্রায় ৮৬ লাখ টাকা!
তৃতীয়ত, অনেক ফ্ল্যাট আইসসিয়েসন 'ক্রেডিট শিল্ড' পলিসি নেয়। আপনি যদি এমন কোনও প্রোজেক্টে ফ্ল্যাট বা বাড়ি নিয়ে থাকেন, তা হলে আলাদা করে পলিসি কেনার কোনও মানে নেই। ফ্ল্যাট আইসসিয়েসন 'ক্রেডিট শিল্ড' পলিসিতেই আপনার বিমা কেনার উদ্দেশ্য মিটিয়ে দিয়েছে।
চতুর্থত, বাড়ির লোন হোক বা না হোক তার জন্যে জীবন বিমা কেনা বা না কেনা আপনার ব্যাক্তিগত পছন্দ। বাড়ির জন্যে প্রপারটি ইনসিওরেন্স কেনা বা না কেনা এই নিয়েও কোন আইন নেই। উদাহরণস্বরূপ, কিছু বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক এটা বলে যে অনেক বেশি টাকা হোম লোন নিলে ঋণের সমপরিমাণ গ্যারান্টির জীবন বিমা জমা দিতে। কিন্তু একটু কথা বললেই কর্তৃপক্ষ এরকম দাবি সরিয়ে নেন। দয়া করে ব্যাঙ্কের হোম লোন স্কিমের নিয়ম-কানুন পড়ুন এবং ব্যাখ্যা চান।
সর্বশেষে, যদি ব্যাঙ্ক কার্যনির্বাহকরা কোনও কথা না শোনেন, তা হলে বাধ্য হয়ে জীবন বিমা কিনুন কিন্তু বিমা কোম্পানির কাগজ হাতে পেলেই ১৫ দিনের মধ্যে পলিসি ফেরত দিন। হ্যাঁ, যে কোনও জীবন বিমা পলিসি কিনে পলিসি নথির প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে আপনি সংস্থাকে জানালে, তাঁরা আপনার লিখিত চিঠির উপর ভিত্তি করে পলিসি বাতিল করবে। আপনাকে প্রিমিয়াম রিফান্ড দিয়ে দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy