সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন বিমা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে। বিশেষত জীবন বিমা। নিজের সঞ্চয় এবং পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে এ দিকে পা বাড়ান অনেকেই। একই ভাবে চড়া চিকিৎসা খরচের কথা মাথায় রেখে এখন অনেকেই স্বাস্থ্য বিমা করতে পিছপা নন। কিন্তু শুধু তাতে তো আর সুরক্ষার বর্ম নিশ্ছিদ্র হয় না। তার জন্য বেশ কিছু সাধারণ বিমারও হাত ধরা জরুরি। তারই কয়েকটি নিয়ে আজকের আলোচনা।
গৃহ বিমা
আপনি কি জানেন যে, মোটা টাকা খরচ না করেও তিল তিল করে জমানো টাকায় কষ্টে কেনা বাড়ি বা ফ্ল্যাটের ভবিষ্যৎ পোক্ত করা সম্ভব? কারণ, তাকে আনা যায় বিমার আওতায়।
করলে সুবিধা
• বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা নির্মাণ সংক্রান্ত ভুলে বাড়ির ক্ষতি হলে, সারাইয়ের জন্য মানিব্যাগে কার্যত হাত ছোঁয়াতে হবে না আপনাকে।
• এক-দু’বছর নয়, তুলনায় কম টাকাতেই প্রায় দু’দশকের জন্য সেই সুরক্ষার সুবিধা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে আপনার সামনে।
একেবারেই অপচয় নয়
আমার প্রথম পরামর্শ, এই খরচকে একেবারেই অপচয় হিসেবে দেখবেন না। মনে রাখবেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলেকয়ে আসে না। চোখের সামনেই তাজা উদাহরণ রয়েছে। গত বর্ষাতেই বন্যায় বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছিল কেরল। প্রচুর মানুষ গৃহহারা হয়েছেন। এটা ঠিক যে, দুর্যোগ থেকে ঘরবাড়িকে বাঁচানো কঠিন। কখনও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে খরচের ধাক্কা, তার থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে দূরদর্শিতা। অর্থাৎ, আগে থেকেই করে রাখা গৃহ বিমা।
মনে রাখবেন
• শুধু বাড়ির মালিক নন, গৃহ বিমার গ্রাহক হতে পারেন ভাড়াটেও।
• বাড়ির কাঠামোর পাশাপাশি, ভিতরের জিনিসপত্রকেও বিমার আওতায় আনা যায়।
• বিমার আওতায় থাকা মূল্যবান পণ্য চুরি গেলেও, হাহুতাশ কম।
প্রিমিয়ামের হিসেব
• বিমার আওতায় কোন কোন সুবিধাকে আনতে চান, তা শুরুতেই ঠিক করুন। প্রিমিয়ামের অঙ্কও ঠিক হবে তার উপর ভিত্তি করে।
• বাড়ির পণ্যকে বিমার আওতায় আনতে চাইলে, তার দামের উপরেও প্রিমিয়াম নির্ভর করবে।
• তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় কিংবা অবহেলার ফলে বাড়ি ও জিনিসপত্রের ক্ষতি হলে, বিমার সুবিধা না-ও পাওয়া যেতে পারে।
ভ্রমণ বিমা
বিদেশ ভ্রমণ কিন্তু এখন অনেকের কাছেই আর তেমন দূরের গ্রহ নয়। কিন্তু অজানা ভূমে গিয়ে যদি অপ্রত্যাশিত বিপদে পড়েন? যেমন, কেউ হয়তো হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বা ব্যাগ হারিয়ে গেল। কী ভাবে করবেন তার সমাধান?
মনে রাখতে হবে, একে বিদেশ ভ্রমণ যথেষ্ট ব্যয়বহুল। তার উপরে আকস্মিক বিপদে সেখানে আটকে পড়লে, তার খরচ সামলানো আরও কঠিন। এই পরিস্থিতিতে রক্ষা করে ভ্রমণ বিমা। কোনও কোনও দেশে এই বিমা ছাড়া ভিসাই মেলে না। এখন আবার দেশে বেড়ানোর জন্যও ভ্রমণ বিমার সুযোগ রয়েছে।
থাকলে স্বস্তি
• বিদেশে গিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে বা অসুস্থ হলে, তার চিকিৎসা খরচ মেলে এতে। বেশ কিছুটা ক্যাশলেস। বাকিটা দেশে ফিরলে মেটায় বিমা সংস্থা। হাসপাতালে ভর্তি হতে না হলেও অনেক সময়ে পাওয়া যায় চিকিৎসার টাকা। দুর্ঘটনায় জখম হলেও মেলে একই সুবিধা।
• বিদেশে থাকার সময়ে অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় বিমাকারীর মৃত্যু হলে, বিমার টাকা পাবে তাঁর পরিবার। পাওয়া যেতে পারে মরদেহ দেশে আনার জন্য খরচও।
• এ ছাড়াও এই বিমার আওতায় রয়েছে পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়া বা কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, বিমানে ‘চেক্ড-ইন’ মালপত্রের নিরাপত্তা, বিমান দেরি করার জন্য গুনতে হওয়া আর্থিক ক্ষতি ইত্যাদি।
• বিমান বদলে গন্তব্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে প্রথমটি দেরি করলে পরেরটি ধরতে না পারার ক্ষতিও অনেক সময়ে পুষিয়ে দেওয়া হতে পারে।
• কোনও কোনও বিমা সংস্থা বিমান ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রেও একটা সীমা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়।
• বিদেশে থাকার সময়ে দেশে বাড়ি বা ফ্ল্যাটে চুরি-ডাকাতি হলে, মেলে ক্ষতিপূরণ। তবে শর্ত হল, বাড়ি বিমাকারীর নামেই হতে হবে।
থাকলে স্বস্তি
আগের কথার সূত্র ধরেই বলি, মনে রাখবেন, সব বিমাতেই কিছু শর্ত থাকে। থাকে ক্ষতিপূরণের সর্বোচ্চ সীমা। দাখিল করতে হয় প্রমাণও। তাই বিমা করানোর আগে শর্তগুলি ভাল করে পড়ে নিন। বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেলেই ভ্রমণ বিমা করান। বিদেশে থাকাকালীন কী ভাবে বিমা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, তা-ও জেনে নিন।
বাড়তি তথ্য
• বেড়াতে গেলে, বিদেশে ছেলে-মেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনের কাছে ঘুরতে গেলে কিংবা পড়াশোনার জন্য ভিন্ দেশে পাড়ি দিলেও এই বিমার সুযোগ মেলে। প্রত্যেক ব্যক্তির নামে আলাদা আলাদা ভাবে করানো যায়। আবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে নিতে পারেন ফ্যামিলি ফ্লোটারের সুবিধাও।
• পরিবারের পাশাপাশি বাইরের কয়েক জনকে নিয়ে বেড়াতে গেলে গোষ্ঠী বিমাও করানো যায়।
• রয়েছে কর্পোরেট ভ্রমণ বিমাও। কোনও সংস্থা অনেক কর্মীকে নিয়ে একসঙ্গে করাতে পারে এই বিমা। • ব্যক্তিগত ভ্রমণ বিমার মেয়াদ সাধারণত ১ দিন থেকে শুরু করে ১৮০ দিন পর্যন্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে সময়সীমা পেরোনোর আগে শর্তসাপেক্ষে তা আরও ১৮০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো যায়। আর বেশির ভাগ কর্পোরেট বিমাই এক বছরের।
বিবাহ বিমা
আমাদের দেশে বিয়ের প্রস্তুতি এবং অনুষ্ঠান বেশ দীর্ঘ। অনুষ্ঠানস্থলের ভাড়া, ফুলের খরচ, কেটারিং পরিষেবা, পরিবহণ থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ কোথায় গিয়ে পৌঁছয়, তার ঠিক নেই। কিন্তু চুরি-ডাকাতি, অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, মৃত্যুর মতো অপ্রত্যাশিত কোনও কারণে বিয়ে স্থগিত বা বাতিল হলে, তাই ক্ষতির অঙ্কও বিপুল। এই ক্ষতি সামাল দিতেও আজকাল এগিয়ে আসছে বিভিন্ন বিমা সংস্থা। বিয়ের মোটামুটি যাবতীয় খরচ এর আওতায় থাকে। প্রিমিয়ামের অঙ্কও নির্ভর করে বিয়ের আনুমানিক খরচের উপরে।
সুবিধা বাতিল
কয়েকটি ক্ষেত্রে বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিতের জন্য ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না। সেগুলি হল—
• দু’পক্ষের সমস্যা।
• সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ।
• বন্যা, ভূমিকম্পের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
• ইচ্ছাকৃত ভাবে ক্ষতি।
গ্যাজেট বিমা
শখ করে হয়তো দামি স্মার্টফোন কিনেছেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই হাত থেকে পড়ে স্ক্রিন গেল ভেঙে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওয়ার্যান্টির আওতায় এই ধরনের সারাই হয় না। তাই বিমার কথা ভাবতে পারেন। তা করা যায় কেনার সময়ে অথবা তার ১৫ দিনের মধ্যে। একই সুবিধা রয়েছে ল্যাপটপ বা বাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সামগ্রীর ক্ষেত্রেও।
মাথায় রাখুন
কয়েকটি জিনিস দেখে নেওয়া ভাল—
• কোন কোন অ্যাকসেসরিজ (ব্যাটারি, হ্যান্ডস-ফ্রি, ডেটা কেবল) বিমার আওতায় পড়ছে না।
• বিমার টাকা দাবি করার জন্য কী কী নথি জমা দিতে হবে? যেমন, চুরি গেলে থানায় করা ডায়েরির নথি, সিম কার্ড ব্লক করার প্রমাণ ইত্যাদি।
• কোন ক্ষেত্রে বিমা পাবেন, আর কোন ক্ষেত্রে পাবেন না, তা শুরুতেই জেনে রাখা ভাল।
ক্রেডিট কার্ড নিরাপত্তা
এটি কার্যত সাধারণ বিমার সমতুল। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, রিটেল বা মেম্বারশিপ কার্ড যাঁরা বেশি ব্যবহার করেন, তাঁদের এই সুরক্ষা নিয়ে রাখা ভাল। এতে কার্ড চুরি করে অপব্যবহার, প্রতারণার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের সুবিধা পাওয়া যায়। এর জন্য অবশ্যই গুনতে হয় বাড়তি খরচ।
কয়েকটি সংস্থা আবার কিছু বাড়তি সুবিধা নিয়ে এসেছে। বিজ্ঞাপনে ছাপানো দামের চেয়ে বেশি খরচ করে যদি আপনাকে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে হয়, তা হলে বাড়তি খরচ মিটিয়ে দেয় তারা।
শেষ পাত
আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলে সাধারণ বিমার আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তা হল গাড়ি বিমা। সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সেগুলি জেনে রাখা ভাল। পরে এক দিন বিস্তারিত আলোচনার জন্য আড্ডাতেও বসা যেতে পারে।
লেখক ব্যাঙ্ক বাজার ডট কমের সিইও (মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy