লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চড়েছে সোনা বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার হিড়িক। এতটাই যে, অবিলম্বে ওই ঋণে রাশ টানার কথা ভাবছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। দেশের প্রায় সমস্ত ব্যাঙ্ক এবং ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক সংস্থা (এনবিএফসি) স্বর্ণঋণ দেয়। সে ক্ষেত্রে সকলের জন্যই কড়াকড়ির নির্দেশ জারি হতে পারে বলে ইঙ্গিত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের। কারণ শীর্ষ ব্যাঙ্ক মনে করছে, স্বর্ণঋণের হাত ধরে বাড়ছে অনৈতিক কার্যকলাপও। যে সোনা বন্ধক রাখা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা সেগুলির আসল মালিক নয় বলে অভিযোগ। আবার কিছু ক্ষেত্রে নালিশ রয়েছে সোনার মূল্য নির্ধারণ এবং তা জমা রাখা নিয়ে।
মহিলাদের মধ্যে ঘরের সোনা দিয়ে ধার নেওয়ার ঝোঁক বেড়েছে দাবি করে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে বিরোধী শিবির। বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, সোনা বংশ পরম্পরায় জমানো সম্পদ। মূল্যবৃদ্ধির এই জমানায় বাড়ির বিয়ের
জন্য অনেকে তা ভাঙাতে বাধ্য হচ্ছেন। ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে বা
চিকিৎসার খরচ সামলাতে গিয়ে বিপাকে পড়া বহু মানুষ সোনাকেই আঁকড়ে ধরছেন। বিক্রির বদলে বেশির ভাগ স্বর্ণঋণের পথে হাঁটছেন সোনার দর বিপুল চড়ায়। বিশেষত কোভিডের পরে যাঁদের আয় তেমন বাড়েনি, অথচ খরচ চড়েছে বিপুল।
মার্চেন্টস চেম্বারের ব্যাঙ্কিং ও অর্থনীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান স্মরজিৎ মিত্রের দাবি, স্বর্ণঋণের মতো ভয়ঙ্কর জিনিস খুব কম আছে। অত্যন্ত সহজে পাওয়া যায়। ব্যাঙ্ক-এনবিএফসিগুলি তা দিতে খুব আগ্রহী।
কারণ সব সময় এই সম্পদ বিক্রি করে নগদ মেলে ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার দাম চড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের স্বর্ণঋণের থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে থাকা উচিত বলেই মনে করেন তিনি। বলেন, ‘‘সবচেয়ে আপত্তিজনক হল, সোনার মান নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ঋণদাতারা। বিভিন্ন মান অনুযায়ী যে ঋণ দেওয়া হয়, সেটা আজকের বাজার দরের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের উপরে কখনওই ওঠে না। অথচ ওই সোনা প্রায় দ্বিগুণ দামের। সেটা রয়ে যায়। এর উপরে থাকে সুদ। তা কেউ দিতে না পারলে বা দেরি হলেই চাপে পেনাল ইন্টারেস্ট বা জরিমানার সুদ। সুতরাং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদটা বাড়তে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, গ্রাহক সোনা ফেরত পাননি এবং এই যে সোনা ঋণদাতার কাছে রয়ে গেল, তার বাজারমূল্য ও যে ঋণ দেওয়া হয়েছে তার ফারাক হিসাবে যেটা থাকল, সেটা ওই সংস্থার বাড়তি লাভ।’’
গত এক বছরে কলকাতায় প্রতি ১০ গ্রাম পাকা সোনার (২৪ ক্যারাট) দাম ২০,৭০০ টাকা বেড়ে গিয়েছে। গয়নার সোনা চড়েছে ১৯,৬৫০ টাকা। স্বর্ণঋণ সংস্থা আইআইএফএলের আঞ্চলিক কর্তা নিলয় ঘোষ জানান, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী দামের ৭৫% পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যেতে পারে। দাম এতটাই বেড়েছে যে, একই পরিমাণ সোনা দিয়ে আগের থেকে অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, নিলয়ের দাবি, আগে যাঁরা স্বর্ণঋণ নিয়েছেন তাঁদের অনেকে নতুন করে সোনা বন্ধক না দিয়ে, আগের বন্ধকীর ভিত্তিতেই বাড়তি টাকা ঋণ নিচ্ছেন। তাঁদের সংস্থায় স্বর্ণঋণের পরিমাণ প্রায় ৪০% বেড়েছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের উপরে ভিত্তি করে সংবাদ সংস্থার খবর, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক চায় সোনা বন্ধক রেখে যাঁরা ঋণের আবেদন করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে ভাল করে খোঁজখবর করার পরে যেন তা মঞ্জুর করা হয়। বন্ধক রাখা সোনার মালিকানাও ভাল করে যাচাই করে দেখার পক্ষপাতী তারা। উদ্দেশ্য, দেশে অনৈতিক ভাবে ঋণদানের প্রবণতা যাতে না বাড়তে পারে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা যেন বজায় থাকে। এর পাশাপাশি স্বর্ণঋণ মঞ্জুরে নিয়ম মানার ব্যাপারে বেশ কিছু গফিলতি আরবিআইয়ের নজরে এসেছে। সোনার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঠিক নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতাকে না জানিয়েই বন্ধকী সোনা নিলাম করা হচ্ছে। গত ১২-১৬ মাসের অডিটে চিহ্নিত হয়েছে, বেশ কিছু এনবিএফসি ঋণ দেওয়ার পরে সেই টাকা কী ভাবে ঋণগ্রহীতা খরচ করছেন, তাতে নজরদারি করেনি। বহু আর্থিক প্রযুক্তি সংস্থা গ্রাহকের থেকে সোনা সংগ্রহ করছে, ওজন করছে এবং নিজেদের হেফাজতে রাখছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ওই সব কাজ ঋণদাতা সংস্থার করার কথা।
বন্ধকহীন ঋণের ক্ষেত্রে আগেই কড়াকড়ি করেছে আরবিআই। সূত্রের দাবি, এর ফলেও স্বর্ণঋণ নেওয়ার প্রবণতা দ্রুত বেড়েছে। এর পরিমাণ আরও মাত্রা ছাড়ানোর আগে তাতে লাগাম পরাতে চায় তারা। নিশ্চিত করতে চায়, ওই ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক-সহ সমস্ত ঋণদাতা সংস্থা যেন একই নিয়ম অনুসরণ করে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)