একের পর এক ‘দুর্যোগ’! প্রথমে নোটবন্দি। তার প্রভাব সামলে ওঠার আগেই কর ব্যবস্থা বদলে ফেলে জিএসটি চালু। এই দুই ধাক্কা দেশের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) কোমর কার্যত ভেঙে দিয়েছিল। এই শিল্প ক্ষেত্রের একটা বড় অংশের অনুযোগ অন্তত তা-ই। আর এ বার একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত। সারা বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থাকেই থমকে দিল অতিমারির আক্রমণ। শিল্প যখন একটু একটু করে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই এই নির্মম ধাক্কা।
ধাক্কা কী ভাবে
অতিমারির প্রকোপ ঠেকাতে গত ২৪ মার্চ ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। তার পরে সেই মেয়াদ বারবার বেড়েছে। তাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সতর্কতা বেড়েছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু একটা দেশের বেশ কিছু সময়ের জন্য থমকে যাওয়া পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়েছিল গোটা অর্থনীতিকে। বড় শিল্পের পাশাপাশি বিশেষ করে যে সমস্ত সংস্থার পুঁজির বহর ছোট, তাদের সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে বেশি।
ছোট শিল্পের গুরুত্ব
সন্দেহ নেই যে বড় শিল্পের গুরুত্ব সব সময়েই আলাদা। তবে ভারতের মতো শ্রমনিবিড় দেশগুলিতে অর্থনীতির শিরদাঁড়া কিন্তু এমএসএমই। প্রত্যেক বছর আমাদের দেশে যত তরুণ-তরুণী কাজের বাজারে পা রাখছেন, তাঁদের চাকরি দিতে হলে ছোট শিল্প ছাড়া গতি নেই। ভারতে নথিভুক্ত এমএসএমই ইউনিটের সংখ্যা ৬.৩৪ কোটি। উৎপাদন ক্ষেত্রের জিডিপি-তে যাদের অবদান ৬.১১%। আর পরিষেবা ক্ষেত্রের জিডিপি-তে ২৪.৬৩%। এ দেশ থেকে যা রফতানি হয় তার মধ্যে ৪৫ শতাংশই করে ছোট-মাঝারি সংস্থা। এই ক্ষেত্রে প্রায় ১২ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত।
এখন উপায়?
অতিমারিতে আক্রান্ত অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাতে শেষ পর্যন্ত মে মাসে প্রায় ২১ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে কেন্দ্র। প্যাকেজের প্রকৃত অঙ্ক বা কার্যকারিতা সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও, এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্ক রাখা হয়েছে এমএসএমই-র জন্য। সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে পুঁজি জোগাতে প্রায় ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকা। সঙ্গে আরও বেশ কিছু সুবিধা। দেখা যাক সেগুলি কী কী।
সংজ্ঞা বদল
ত্রাণ প্যাকেজের শুরুতেই যেটা করা হয়েছে, তা হল এমএসএমই-র সংজ্ঞা বদল। আগে এই ক্ষেত্রে উৎপাদন এবং পরিষেবা সংস্থাগুলিতে কারখানা ও যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা আলাদা ছিল। পুঁজির পরিমাণের দিক থেকে এই দুই ক্ষেত্রের মধ্যে আর কোনও পার্থক্য আর রাখা হয়নি। সেই সঙ্গে নতুন করে যোগ করা হয়েছে বার্ষিক ব্যবসার অঙ্কের হিসেব। এর ফলে এমন বহু সংস্থা এমএসএমই-র সংজ্ঞায় ঢুকে পড়ছে যেগুলি আগে এই ক্ষেত্রের অংশ ছিল না।
• ক্ষুদ্র সংস্থা: কারখানা ও যন্ত্রপাতিতে লগ্নি ১ কোটি টাকার বেশি নয়। বছরে ব্যবসার সর্বোচ্চ অঙ্ক ৫ কোটি টাকা।
• ছোট সংস্থা: বিনিয়োগ ১ কোটি টাকার বেশি থেকে ১০ কোটি টাকা। বছরে ব্যবসার অঙ্ক ৫০ কোটি পর্যন্ত।
• মাঝারি সংস্থা: সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ৫০ কোটি। ব্যবসা ২৫০ কোটি পর্যন্ত।
বন্ধকহীন ঋণ
এই এমএসএমইগুলিকে ৩ লক্ষ কোটি টাকার বন্ধকহীন ঋণ পুঁজি হিসেবে জোগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ঋণ দেওয়া হচ্ছে ব্যাঙ্ক এবং এনবিএফসি-র মাধ্যমে।
• গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে বকেয়া ঋণের উপর ২০% পর্যন্ত বন্ধকহীন ঋণ হিসেবে পেতে পারে সংস্থাগুলি।
• যে সমস্ত সংস্থার বকেয়া ঋণ ২৫ কোটি টাকার মধ্যে এবং বছরে ব্যবসার অঙ্ক ১০০ কোটি টাকার মধ্যে, এই ঋণের সুবিধা তাদের জন্য।
• ঋণের মেয়াদ চার বছর। ঋণের আসল অঙ্কের উপরে ১২ মাসের কিস্তি স্থগিতের (মোরাটোরিয়াম) সুযোগ মিলবে। অর্থাৎ, সুদের কিস্তি কিন্তু শুরু থেকেই গুনতে হবে।
• সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ব্যাঙ্ক বা এনবিএফসিগুলি তার চেয়ে বেশি হারে সুদ দাবি করতে পারবে না।
• আসল ও সুদের উপরে ঋণদাতাকে ১০০% গ্যারান্টি দিচ্ছে সরকার।
• এই ঋণের জন্য গ্যারান্টি ফি বা বন্ধকের প্রয়োজন নেই।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে, ৩১ অক্টোবর বন্ধ করে দেওয়া হবে এই ঋণ প্রকল্পটি। কিন্তু সরকার যতটা প্রত্যাশা করেছিল ততটা সাড়া মেলেনি। কেন্দ্রের হিসেব, এখনও পর্যন্ত ৬০.৬৭ লক্ষ সংস্থার জন্য ২.০৩ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। অর্থাৎ, মোট প্রকল্পের ৬৫%। আর বিলি হয়েছে ১.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা। সে কারণে প্রকল্পের মেয়াদ এক মাস বাড়িয়ে সময়সীমা ৩০ নভেম্বর করা হয়েছে। তবে এখন আশার কথা, শিল্প ক্ষেত্র ও অর্থনীতির কিছু কিছু সূচক সম্প্রতি সাড়া দিতে শুরু করেছে। করোনা পরিস্থিতির ঠিক পরে যে অবস্থা হয়েছিল, তার তুলনায় বিক্রিবাটার পরিস্থিতি এখন ভাল। ফলে যারা সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের সুযোগ এখনও নেয়নি, তারা এই আড়াই সপ্তাহে নেওয়ার কথা ভাবতে পারে।
এনপিএ-র জন্য
• এই ঋণ প্রকল্পের অঙ্ক ২০,০০০ কোটি টাকা।
• যে সমস্ত এমএসএমই সঙ্কটে রয়েছে বা ঋণ অনুৎপাদক সম্পদে (এনপিএ) পরিণত হয়েছে তাদের ঘুরিয়ে দাঁড় করাতে এই প্রকল্প।
• এই প্রকল্পে সরকার ‘ক্রেডিট গ্যারান্টি ফান্ড ট্রাস্ট ফর মাইক্রো অ্যান্ড স্মল এন্টারপ্রাইজ়েস’কে (সিজিটিএমএসই) ৪০০০ কোটি টাকার পুঁজি দিয়েছে। এই পুঁজির সাহায্যে সিজিটিএমএসই বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণের উপরে আংশিক গ্যারান্টি দিচ্ছে।
• ব্যাঙ্কের মাধ্যমে প্রোমোটারদের দেওয়া ঋণ অংশীদারি হিসেবে ঢালতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থায়।
• সরকারের আশা, এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় দু’লক্ষ সংস্থা উপকৃত হতে পারে। বন্ধ হওয়া ঝাঁপ তুলে দাঁড়াতে পারে ঘুরে। তৈরি হতে পারে নতুন কর্মসংস্থান।
পুঁজি জোগানো
• সম্ভাবনাময় এমএসএমইগুলিকে পুঁজি জোগাতে ঢালা হচ্ছে আরও ৫০,০০০ কোটি টাকা।
• এই তহবিল দেওয়া হচ্ছে ‘ফান্ড অব ফান্ডস’-এর মাধ্যমে।
• লক্ষ্য, পুঁজি জুগিয়ে সম্ভাবনাময় সংস্থাকে বড় হতে সাহায্য করা। যাতে পরে শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত হতে সুবিধা হয় তাদের।
দরপত্রে সুবিধা
শুধু করোনাকালে নয়, এমএসএমইগুলিকে শক্তিশালী করার জন্য অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন পদক্ষেপ শুরু করেছে কেন্দ্র। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির কাঁচামালের একটা অংশের জোগান যাতে এই সংস্থাগুলির থেকে আসে, তা আগেই নিশ্চিত করা হয়েছে। অতিমারির পরে সেই সুযোগ সংস্থাগুলির সামনে আরও বেশি করে খুলে গিয়েছে।
• সরকার বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বরাতের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র চাওয়া হবে না। তার বদলে সেই দরপত্র সীমাবদ্ধ রাখা হবে এমএসএমই ক্ষেত্রের মধ্যে। যার ফলে সংস্থাগুলির ব্যবসা বাড়াতে সুবিধা হবে।
বকেয়া মেটানো
• এমএসএমইগুলির বকেয়া আটকে রাখার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই উঠছে সরকার, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং বড় সংস্থার বিরুদ্ধে। তা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্র বহুদিন ধরেই তাগদা দিচ্ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক, দফতর এবং সংস্থাগুলিকে। করোনা সংক্রমণের পরে তাকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। এখন থেকে সরকার এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে এমএসএমই-র বকেয়া মিটিয়ে দিতে হবে ৪৫ দিনের মধ্যে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy