বিপদ যে তিথি-নক্ষত্র দেখে বলে কয়ে আসে না, তা বুঝিয়ে দিয়েছে অতিমারি। কাউকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে সারা জীবনের সঞ্চয় এক ধাক্কায় কী ভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে, তা ইদানীং দেখেছে বহু পরিবার। বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিমা না-থাকলে। কোনও কোনও পরিবারের তো আবার একাধিক সদস্যকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। অনেককে চিকিৎসার খরচের বকেয়া মেটাতে হাত পাততে হয়েছে নিকট আত্মীয়দের কাছে। সামাজিক মাধ্যমে আবেদন জানাতে হয়েছে সাহায্যের জন্য। এই অবস্থায় একটা বিষয় জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সবার সামনে। পুরুষ-মহিলা, শিশু-বয়স্ক— সকলের ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য বিমা কার্যত বাধ্যতামূলক। বস্তুত, আজকের দিনে সেটা না-থাকার অর্থ রক্ষণভাগের খেলোয়াড় ছাড়াই বড় ম্যাচ খেলতে নামা।
আর্থিক পরামর্শদাতারা স্বাস্থ্য বিমার প্রয়োজনীয়তার কথা কিন্তু কম দিন ধরে বলছেন না। এই বিমা যেমন চিকিৎসার খরচ নিশ্চিত করে, তেমনই কমায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে সঞ্চয় পুরোপুরি ক্ষয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এখন দেরিতে হলেও অনেকে দরকারটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। তাই আজ ফের স্বাস্থ্য বিমার টুকিটাকি এক বার মনে করিয়ে দেওয়া।
গোড়ার কথা
সংগঠিত ক্ষেত্রে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের একটা বড় অংশ নিয়োগকারীর মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা পেয়ে থাকেন। আওতায় পড়েন কর্মী নিজে, স্বামী/স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা। তবে মনে রাখতে হবে, এর বাইরেও পরিবারের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী আলাদা একটি পলিসি থাকা দরকার। কেন?
• নিয়োগকারী যে স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা দেয়, তা গ্রুপ মেডিক্লেমের আওতায় পড়ে। সুযোগ-সুবিধা সীমিত।
• চাকরি ছেড়ে দিলে বা কোনও কারণে কাজ না-থাকলে ওই বিমার সুবিধা পাওয়া আর সম্ভব নয়।
• একই সমস্যা তৈরি হতে পারে অবসরের পরে। আর ওই বয়সে তো নতুন করে স্বাস্থ্য বিমার পলিসি কেনাও কঠিন। কারণ, তখন প্রিমিয়াম গুনতে হবে বিপুল।
• আর যাঁদের কোনও রকম স্বাস্থ্য বিমা নেই! তাঁদের কেনা উচিত আজই।
ঠিক সে কারণেই আমাদের আজকের আলোচনা সাধারণ স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে। আর্থিক ক্ষমতা অনুযায়ী কী ভাবে পলিসির কভারেজ বাড়ানো যায়, জেনে রাখা দরকার সেটাও।
বেসিক পলিসি
রোজগার শুরুর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাস্থ্য বিমার পলিসি কেনা উচিত, এ কথা আগেও অনেক বার বলেছি। তাতে কম অঙ্কের প্রিমিয়ামে বিমার সুবিধা পাওয়া যায়। বয়স বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পলিসির খরচ বাড়তে থাকে। চাপতে থাকে শারীরিক পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন রকম শর্ত। এমনকি, আগে থেকে থাকা অসুখের জন্য (প্রি-এগ্জ়িস্টিং হেলথ কন্ডিশন) হয়তো বিমা সংস্থাও পলিসি করাতে রাজি না হতে পারে। সে আপনি যত উঁচু অঙ্কের প্রিমিয়ামই দিতে রাজি থাকুন না কেন।
• তাই প্রথমেই কিনতে হবে মূল পলিসি (বেসিক পলিসি)। জুড়ে নিতে হবে পরিবারের নির্ভরশীল সদস্যদের।
• ৩০ বছর বয়সি (ধূমপান করেন না) ব্যক্তির ৫ লক্ষ টাকার সাধারণ স্বাস্থ্য বিমা পলিসির প্রিমিয়াম শুরু হয় মোটামুটি ৪৭০০ টাকা থেকে। বয়স এবং সংস্থা অনুযায়ী প্রিমিয়ামের অঙ্ক ও শর্ত বদল হতে পারে।
সাম অ্যাশিয়োর্ড
অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হলে বিমা সংস্থা বার্ষিক সর্বোচ্চ যে অঙ্ক চিকিৎসার খরচ হিসেবে বহন করে। ধরা যাক, বিমাকৃত কোনও রোগীর অস্ত্রোপচারে খরচ হল ৬ লক্ষ টাকা। অথচ বিমা করানো রয়েছে ৫ লক্ষ টাকার। তা হলে কিন্তু বিমা সংস্থা ওই ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্তই খরচ দেবে (সংশ্লিষ্ট শর্ত এবং চিকিৎসার বিভিন্ন খাতে সর্বোচ্চ খরচের হিসেব কষে)। সেটাই সাম অ্যাশিয়োর্ড। বাকি খরচ বহন করতে হবে নিজেদের।
কত টাকার পলিসি
স্বাস্থ্য বিমাও এক ধরনের আর্থিক প্রকল্প। যা আপনার চিকিৎসা খরচকে সুরক্ষিত করে। প্রিমিয়ামের অঙ্কের উপরে মেলে কর ছাড়ের সুবিধাও।
তা হলে কত টাকার পলিসি কেনা উচিত? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া কিন্তু বেশ কঠিন। স্বাস্থ্য বিমা এক বার কিনলে বছরের পর বছর সেই পলিসি ধরে রাখতে হয়। দিতে হয় প্রিমিয়াম। সুতরাং আর্থিক সক্ষমতার একটা প্রশ্ন এখানে জড়িয়ে রয়েছে। তার উপরে প্রত্যেক বছর চিকিৎসা ব্যবস্থার খরচ বাড়ে। এবং তা মাথা তোলে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে কিছুটা বেশি হারেই। যে চিকিৎসার খরচ আজ ৫ লাখ, ১০ বছর পরে নিশ্চিত ভাবেই তা অনেকটা বেড়ে যাবে। সুতরাং, আর্থিক অবস্থা বুঝে, পরিবারের সদস্য সংখ্যার বিচারে যতটা সম্ভব বেশি অঙ্কের পলিসি কেনাই ভাল।
দেখে নিন শর্ত
প্রত্যেক স্বাস্থ্য বিমা পলিসিতেই কিছু না কিছু শর্ত থাকে। হয়তো কোনও পলিসি সব রোগের চিকিৎসার খরচ দেয় না। অথবা হয়তো পলিসি কেনার নির্দিষ্ট একটি সময় পর থেকে সেই সুবিধা পাওয়া যায়। অনেক সময়ে আগে থেকে থাকা রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ পাওয়া যায় পলিসি কেনার এক থেকে চার বছরের পর থেকে। আবার এমন কিছু অসুখ রয়েছে যেগুলির চিকিৎসা খরচ অধিকাংশ পলিসিতেই পাওয়া যায় না। যেমন, এডস। অথবা আত্মহননকারী কার্যকলাপের মাধ্যমে শারীরিক ক্ষতি। অতএব পলিসি কেনার আগে তার সমস্ত শর্ত ভাল করে পড়ে ও বুঝে নিতে হবে।
বাকি খুঁটিনাটি
• স্বাস্থ্য বিমার পলিসি কেনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল নিজের বা পরিবারের সদস্যদের ক্যাশলেস চিকিৎসা করানো। অর্থাৎ, বিমা সংস্থা সরাসরি হাসপাতালকে চিকিৎসার খরচ দিয়ে দেবে। ফলে যে বিমা সংস্থার থেকে আপনি পলিসি কিনবেন, তাদের কোন কোন হাসপাতালের সঙ্গে এই সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে তা আগে থেকে জেনে নেওয়া দরকার।
• দিনে বেড-ভাড়া বাবদ কত টাকা পাওয়া যাবে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে ও পরের খরচ, অ্যাম্বুল্যান্স খরচ, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুবিধা পলিসিতে আছে কি না, থাকলে কতটা— সব কিছুই আগে থেকে জেনে নেওয়া দরকার।
• এই সমস্ত পরিষেবার ক্ষেত্রে এক একটি সংস্থা এক এক ধরনের সুবিধা দেয়। কোনও সংস্থা হয়তো হাসপাতালে ভর্তির আগের ৩০ দিন এবং ছাড়া পাওয়ার পরের ৬০ দিনের চিকিৎসার খরচ দেয়। কেউ হয়তো দু’ক্ষেত্রেই দেয় ৬০ দিনের খরচ। এই সমস্ত তথ্যও জেনে নিতে হবে।
• কোনও কোনও পলিসিতে বাড়তি সুবিধা মেলে। রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা, অল্টারনেটিভ মেডিসিন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ইত্যাদি। তবে তার জন্য প্রিমিয়ামও গুনতে হয় বেশি। আর্থিক ক্ষমতা থাকলে খতিয়ে দেখতে পারেন এই সংক্রান্ত তথ্যও।
টপ-আপ পলিসি
কম খরচে বিমার অঙ্ক বাড়াতে হলে এটি আদর্শ পদ্ধতি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে বেসিক পলিসির কভারেজ শেষ হয়ে গেলে তবেই হাত দেওয়া যায় এই পলিসিতে। ধরা যাক, আপনার ৫ লক্ষ টাকার বেস কভারেজ করানো রয়েছে। আর টপ-আপ কভারেজ রয়েছে আরও ৫ লক্ষ টাকার। হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ দাঁড়াল ৭.৫ লক্ষ টাকা। এ ক্ষেত্রে বেস কভার থেকে আগে ৫ লক্ষ টাকা মেটাতে হবে। তা হলেই অবশিষ্ট খরচ জোগাবে টপ-আপ পলিসি।
• টপ-আপ পলিসির সুবিধা হল, এর সাহায্যে অত্যন্ত কম খরচে স্বাস্থ্য বিমার অঙ্ক বাড়ানো যায়।
• উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৫ লক্ষ টাকার বেসিক পলিসির প্রিমিয়াম যদি ৫০০০ টাকা হয়, তা হলে একই অঙ্কের টপ-আপ পলিসির প্রিমিয়াম হয়তো হবে এর এক-চতুর্থাংশ।
• তবে বেসিক পলিসির শর্ত অনুযায়ী সর্বোচ্চ অঙ্ক খরচ হয়ে যাওয়ার পরেই টপ-আপ পলিসির সুবিধা পাওয়া যায়। উপরের উদাহরণ অনুযায়ী, টপ-আপ পলিসির সুবিধা পেতে হলে আগে প্রথম ৫ লক্ষ টাকা অন্য কোনও বেসিক পলিসির মাধ্যমে কিংবা নগদে মেটাতে হবে।
সুপার টপ-আপ
এক বছরের মধ্যে একাধিক বার হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে টপ-আপ পলিসির সুবিধা অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া মুশকিল। ধরা যাক, দ্বিতীয় বার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ফলে ২ লক্ষ টাকা খরচ হল। কিন্তু বেসিক পলিসির কভারেজ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। শর্ত অনুযায়ী ৫ লক্ষ টাকার বেশি খরচ হলেই টপ-আপের সুবিধা মিলবে। ফলে এ দফার খরচ আর পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সুপার টপ-আপে সাহায্যে তা মিলতে পারে।
অনেক পরিবারের পক্ষেই উঁচু প্রিমিয়াম গুনে স্বাস্থ্য বিমা চালানো সম্ভব নয়। তারা বেসিক পলিসির সঙ্গে টপ-আপ এবং সুপার টপ-আপের সাহায্যে নিজেদের চিকিৎসা খরচকে সুরক্ষিত করতে পারে।
ক্রিটিক্যাল ইলনেস
এই পলিসিতে নথিভুক্ত কোনও রোগে পলিসিহোল্ডার আক্রান্ত হলে তিনি এককালীন ক্ষতিপূরণ পান চিকিৎসার খরচ, রোজগার হারানো ও অন্যান্য খরচ বাবদ। যা তাঁর পরিবারকে কিছুটা হলেও ধাক্কা সামাল দিতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে ক্যানসার-সহ বিভিন্ন কঠিন রোগে যেখানে মাসের পর মাস চিকিৎসার খরচ টানতে হয়, সেখানে এই ধরনের পলিসি কাজে আসে। কার্ডিয়োভাসকুলার ডিজ়িস, কিডনি সংক্রান্ত অসুখ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, পক্ষাঘাত-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে এই বিমা।
লেখক ব্যাঙ্কবাজার ডট কমের সিইও (মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy