সুরজিৎ বসু (৩৫)। ইঞ্জিনিয়ার। বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। পরিশ্রমী হিসেবে সুনামও আছে। পেশার সঙ্গে যুক্ত গত ন’বছর।
সুরজিতের পরিবারে স্ত্রী, পাঁচ বছরের কন্যা এবং বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছেন। পরিবার সুরজিতের উপরে নির্ভরশীল। তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনে একটু হাত-পা ছড়ানোর ইচ্ছে তাঁর অনেক দিনের। আর স্বপ্ন পূরণের আদর্শ সময় তো এটাই! অনেক দেখেশুনে গড়িয়ায় মনের মতো একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন সুরজিৎ। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে হয়েছে ৩৫ লক্ষ টাকা। ডাউন পেমেন্টও বিপুল। সঞ্চয়ের বড় অংশই ভাঙিয়ে ফেলতে হয়েছে এই খাতে টাকা জোগানোর জন্য। পাশাপাশি, বেতনের প্রায় অর্ধেক বেরিয়ে যাচ্ছে ইএমআই দিতে। তবু তো ব্যস্ত শহরের বুকে নিজের বাড়ি! তাই সব কিছু ভালই চলছিল।
উৎকণ্ঠার শুরু মাসকয়েক আগে। অফিসে গুঞ্জন শুরু হয়, ব্যবসা ভাল চলছে না। ঋণের অঙ্ক বিপুল। কোম্পানিকে বাঁচাতে কর্মীদের ঘাড়ে কোপ পড়তে পারে। উদ্বেগ হচ্ছিল না এমন নয়। কিন্তু সুরজিতের বিশ্বাস ছিল, এই খাড়া নিশ্চয়ই তাঁর উপরে পড়বে না। হাজার হোক, দক্ষ পেশাদার হিসেবে বরাবরই অফিসে প্রশংসিত তিনি।
সুরজিতের সেই হিসেব মেলেনি। এক সকালে বস ফোন করে বললেন, কোম্পানি তাঁদের ডিপার্টমেন্টটিই বন্ধ করে দিচ্ছে।
বাজ পড়ল সুরজিতের মাথায়। এ বার নতুন চাকরির খোঁজ করতে হবে। বাজারের যা হাল তাতে নতুন কাজ জোগাড় করাও তো শক্ত। অন্তত সময়সাপেক্ষ তো বটেই। কিন্তু তত দিন ইএমআই, পরিবারের খরচ সামাল দেওয়া যাবে কী ভাবে?
সুরজিতের চরিত্র কাল্পনিক। কিন্তু সেই চরিত্রের অভিজ্ঞতা যে মোটেই কাল্পনিক নয় সে সম্পর্কে আপনারা নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল। খোদ সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে দেশে বেকারত্বের হার হয়েছে গত সাড়ে চার দশকের সর্বোচ্চ। চাকরির অফার লেটার হাতে পেলে যেমন খুশিতে মন ভরে ওঠে, তেমনই উল্টো অভিজ্ঞতাও যে কারও হয় না এমন তো নয়! ফলে তেমন কিছু ঘটলে যাতে শুরুতেই অকূল পাথারে পড়তে না-হয় তার জন্য তৈরি থাকতে হবে প্রতি মুহূর্তে। কী ভাবে? তা নিয়েই কয়েকটি কথা।
প্রস্তুতির অ-আ-ক-খ
রক্ষণ সামলে তবেই পা বাড়ানো— যে কোনও খেলার শাশ্বত স্ট্র্যাটেজি এটাই। রোজগারের টাকা খরচের ক্ষেত্রেও যদি একই কৌশল নেওয়া যায়, তা হলে কিন্তু লাভ বৈ ক্ষতি নেই। বিপদের দিনের জন্য তৈরি থাকতেও তাতে সুবিধা হয়। দুর্গ সামাল দেওয়ার প্রথম ধাপ অবশ্যই খরচে কিছুটা লাগাম টানা। তৈরি করে ফেলা একটি সমান্তরাল তহবিল, যাতে বিপদ এলে সেই মজুত কাজে লাগানো যায়।
মাসের বাজেট মাসে: এমন কিছু খরচ থাকে যা কমানো কখনওই সম্ভব নয়। যেমন, ঋণের কিস্তি, বিদ্যুৎ, ফোন, বিমার প্রিমিয়াম, সম্পত্তি কর-সহ হরেক রকম বিল। আবার কিছু ব্যয় আছে যেগুলির সঙ্গে আপস অসম্ভব। এই তালিকার শুরুতেই থাকবে সন্তানের পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসা। এই সমস্ত অত্যাবশ্যক খরচকে মাথায় রেখেই বলছি, চেষ্টা করুন প্রত্যেক মাসের শুরুতেই সেই মাসের বাজেট তৈরি করতে। খরচগুলি লিখে ফেলুন দু’টি ভাগে ভেঙে। ১) অত্যাবশ্যক। ২) অন্যান্য।
এ বার ভাল করে ভেবে দেখুন, যে সমস্ত খরচ অত্যাবশ্যক নয়, তার মধ্যে কোনওটিকে বাতিল করা অথবা পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না। এই সমস্ত হিসেব কষার পরে যে উদ্বৃত্ত থাকবে তার একটি অংশ দিয়ে আপৎকালীন খরচ সামলানোর তহবিল তৈরি করতে হবে। বাকিটা লগ্নির কাজে ব্যবহার করুন। আপৎকালীন খরচের তহবিল যেন অন্তত ছ’মাসের বেতনের সমান হয়। মনে রাখতে হবে, খুব বিপদে না-পড়লে লগ্নির টাকাকে ওই কাজে খরচ করা যাবে না।
ডিজিটাল খরচে রাশ: আর্থিক লেনদেনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। সরকার নিজেও চাইছে নগদে লেনদেন কমাতে। এই অবধি সব কিছু ঠিকঠাক। দৌড়ঝাঁপ কমিয়ে বাড়িতে বসে বিভিন্ন খরচ মেটানোর মতো ভাল ব্যাপার আর কী হতে পারে? কিন্তু একটা সমস্যা এখানে আছে। প্রযুক্তি নির্ভর লেনদেন সহজ হয়ে যাওয়ায় বেহিসেবি খরচের প্রবণতাও তৈরি হচ্ছে মানুষের মধ্যে। অতএব এ ব্যাপের সতর্ক থাকতে হবে। ক্রেডিট কার্ড থাকলে তার দেনাও ঠিক সময়ে মিটিয়ে দিন। কোনও বিলের ক্ষেত্রেই যেন বাড়তি সুদ কিংবা দেরির জন্য জরিমানা গুনতে না-হয়।
বড় খরচ নয়: প্রার্থনা করি, আপনার পেশাগত জীবন মসৃণ হোক। কিন্তু যদি কখনও শোনেন অফিসে ডামাডোল শুরু হয়েছে? কিংবা সামগ্রিক ভাবে ধাক্কা খেয়েছে আপনার পেশার ক্ষেত্রটিই? তা হলে প্রথম কাজই হবে যাবতীয় বড় ও শখের খরচ ছেঁটে ফেলা। যেমন, লম্বা ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া। দামি মোবাইল ফোন, বৈদ্যুতিন পণ্য কেনা।
লগ্নি ভাঙানো বন্ধ: বহু হিসেবি মানুষেরও এই বদভ্যাসটা আছে। তা হল, উৎসবের মরসুমের আগে মেয়াদি আমানত ভাঙানো কিংবা এসআইপি থেকে টাকা তোলা। আমি এমন অনেক মানুষ দেখেছি, যাঁরা বাড়ি বানানো কিংবা মেরামতির জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা তুলেছেন। এই প্রবণতা কিন্তু মারাত্মক! ওই তহবিল গড়ে তোলা হয় সন্তানের লেখাপড়া, অবসর জীবনের খরচ কিংবা বিপদের সময়ের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। অতএব এই পথ একেবারে নয়।
রক্ষণ সামলে ঋণ: কেরিয়ারের শুরুতে একটা সমস্যা অনেকেরই হয়। হাতে হঠাৎ বাড়তি টাকা। স্বপ্নপূরণের স্বাদ। তাই দেদার খরচ। আর ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি-গাড়ি কেনা তো আছেই। এখানেও শেষ নয়। মাথার উপরে ছাদ থাকা সত্ত্বেও অনেকে দ্বিতীয় একটি বাড়ি কেনেন। সেটাও আবার ঋণ নিয়ে। শুধু মাত্র সম্পদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। এতে যে বিপদ হয় তা হল, পেশার শুরু থেকেই ঋণের সমুদ্রে ডুব দিতে হয়। তাই যে কোনও ঋণ নেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, বিপদের দিনে পরিবারকে আড়াল করার আর্থিক ঢালটা তৈরি রেখেছেন তো? সেটাই কিন্তু সবার আগে। জীবনটাকে একটু সহজ করতে গেলে শখ-আহ্লাদ মেটানো অবশ্যই জরুরি। কিন্তু ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে নয়।
উপার্জনের একাধিক উৎস: স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই যদি রোজগেরে হন তা হলে পরিবারের আর্থিক ঝুঁকি কমে। অনেক পরিবারে দু’জন রোজগেরের পাশাপাশি পেনশনভোগী প্রবীণ নাগরিকও থাকেন। এক জন সদস্যের পেশা যদি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তা হলেও লড়াইয়ের পুঁজির সরবরাহটা বন্ধ হয় না। পরিবারের মোট উপার্জন কমে যাওয়াটাও সমস্যার। কিন্তু শুরু থেকেই আতান্তরে পড়তে হয় না। আমার পরামর্শ, আপনার পরিবারে যদি একাধিক রোজগেরে সদস্য থাকেন তা হলে সঞ্চয় এবং লগ্নির ক্ষেত্রে সেই সুযোগটা নিন। একটু বেশি করেই না হয় টাকা রাখুন ওই দুই খাতে। আবার আপনি যদি পরিবারের একমাত্র রোজগেরে হন, তা হলেও চেষ্টা করতে পারেন দ্বিতীয় একটি আয়ের উৎস তৈরি করতে।
শুরু থেকেই লগ্নি: একটু আগেই যেটা বলছিলাম। পেশাগত জীবনের শুরুতে হাতে কিছুটা বাড়তি টাকা থাকে। কয়েক বছর পর থেকে বাড়তে থাকে দায়দায়িত্ব। ফলে যতটা সম্ভব আগে থেকে সঞ্চয় এবং লগ্নি শুরু করুন। কারণ, লগ্নির মেয়াদ যত বেশি হবে তহবিল বেড়ে ওঠার সম্ভাবনাও ততই বাড়বে। তবে মনে রাখবেন, সেই পুঁজিকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাতে ঝুঁকি কমে। আর একটি ব্যাপার মাথায় রাখবেন। লগ্নি করতে হবে সময় ও লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে। বয়সের ঝুঁকি মেনে। যেমন, বয়স যত বাড়বে শেয়ার নির্ভর প্রকল্পে লগ্নির অঙ্ক কমাতে হবে। বাড়াতে হবে কম ঝুঁকির প্রকল্পে। বয়স অল্প হলে আবার লগ্নির কৌশল হবে এর ঠিক উল্টো।
তৈরি করুন নিজেকে: এই বিষয়টি হয়তো সরাসরি খরচ বা সঞ্চয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু মাথায় রাখা জরুরি। স্কুলে আমাদের প্রত্যেককেই শেখানো হত রোজকার পড়া রোজ করতে। না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। আবার সারা বছর খেলা না-থাকলেও খেলোয়াড়েরা গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সব সময়ে নিয়ম মেনে অনুশীলন করেন। যাতে দক্ষতায় মরচে না-পড়ে। সাধারণ পেশার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা আলাদা কিছু নয়। কাজের বাজারে যাতে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা যায় তার জন্যও দরকার কঠোর অনুশীলন। নিজেকে তৈরি রাখা। কঠোর প্রতিযোগিতার বাজারে সেটাই দস্তুর। কোনও সমস্যা হলে সে ক্ষেত্রে অন্য কাজ পেতেও সুবিধা হবে।
বিমার ছাতা: নিজের জন্য জীবন বিমার টার্ম প্ল্যান এবং পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বিমা— এই দু’টি করে রাখতেই হবে। ঠিক সময়ে প্রিমিয়াম মিটিয়ে দিতেও যেন ভুল না-হয়। আপনার অফিস পরিবারের স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা দিতেই পারে। কিন্তু কোনও দিন সেই চাকরি না-থাকলে বা চাকরি ছাড়লে পরিবারের মাথায় সুরক্ষার ছাতা ধরবে কে? অতএব আলাদা ভাবে এগুলি করতেই হবে।
যখন সঙ্গী নয় পেশা
এতক্ষণ তো গেল বিপদের দিনের জন্য যাবতীয় আর্থিক পরিকল্পনা। কিন্তু এ বার যদি সত্যিই ধাক্কা লাগে রোজগারে? তার জন্য মাথায় রাখুন কয়েকটি বিষয়।
• আপৎকালীন খরচের জন্য যে তহবিল তৈরি করেছেন, এ বার হাত দিতে হবে সেখানে। আগেই বলেছি, তহবিল তৈরির সময়ে লক্ষ্য থাকবে সঞ্চয়ের পরিমাণ যেন অন্তত ছ’মাসের রোজগারের সমান হয়। কিন্তু এখানে আরও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যদি কাঁধে বড় অঙ্কের ঋণ থাকে? সে ক্ষেত্রে তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা বাঁধুন এক বছর।
• মাসের বাজেট তৈরি করতে হবে পুরোপুরি অন্য ভাবে। খরচ ছাঁটতে হবে বিভিন্ন খাতে। অবশ্যই নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী। ক্রেডিট কার্ডের মতো ধার করে খরচ বন্ধ করতে হবে।
• সন্তানের খরচের সঙ্গে কিছুতেই আপস করা যাবে না। তার উচ্চশিক্ষার তহবিল তৈরির জন্য যে লগ্নি চলছে, তা-ও চলবে। পরিবারের খরচের হিসেব কষতে হবে সেটিকে ধরেই।
• পেশায় উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনা। দরকারে সংশ্লিষ্ট কোর্স করা। এগুলিও বন্ধ করা যাবে না।
• বিপদ জানান দিয়ে আসে না। কাজের বাজারের সমস্যার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে যদি যথেষ্ট তহবিল গড়ে তোলা না-যায়? সে ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই ভাঙাতে হতে পারে মিউচুয়াল ফান্ডের মতো সম্পদ। মেয়াদি আমানত, পিপিএফ, বিমা, সোনা বন্ধক রেখে ঋণও নেওয়া যায়। কিন্তু উঁচু সুদের ব্যক্তিগত ঋণের দিকে না এগোনোই উচিত। আর অবসরকালীন তহবিলে তো একেবারেই হাত দেওয়া নয়।
• নতুন চাকরি তো খুঁজতেই হবে। কিন্তু অস্থায়ী কাজ হাতে চলে এলে ঠেলে দেওয়া নয়। খরচের একাংশ তুলতে কিছু দিন সেই কাজই করুন।
• যে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছেন তাদের সঙ্গে সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করুন। জিজ্ঞাসা করুন, কয়েক মাসের জন্য ঋণ থেকে রেহাই (লোন হলিডে) পাওয়া সম্ভব কি না।
এর বাইরেও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখলে ভাল। পেশায় সমস্যা হলে কোন বয়সে হচ্ছে সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, পরিবার তৈরি না-হলে ঝুঁকি তুলনায় কম। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য হাতে সময়ও থাকে বেশি। আবার বেশি বয়সে পেশার সমস্যা হলে ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ কম। তখন তহবিলে একটু বেশি নগদ থাকলে ভাল। অতএব খরচ এবং লগ্নির হিসেবও কষতে হবে এগুলিকে মাথায় রেখে। যাঁর যে রকম।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy