অরুণ জেটলি
বিশ্ব জুড়ে টালমাটাল শেয়ার বাজারের ঝাপটা এড়ানোর উপায় হয়তো নেই। রাস্তা নেই চিনা অর্থনীতির অস্থিরতা কিংবা মার্কিন মুলুকে সুদ বাড়ার সম্ভাবনার আঁচ পুরোপুরি গায়ে লাগতে না-দেওয়ার। কিন্তু দেশের অর্থনীতির চাকায় গতি জোগাতে ঘরের মাঠে যেটুকু করা সম্ভব, সেটুকু অন্তত করুক কেন্দ্র। শুধু অর্থনীতির ভিত পোক্ত থাকার বুলি বারবার না-আওড়ে জোর দিক থমকে থাকা সংস্কার প্রক্রিয়া চালু করায়। দুনিয়া জুড়ে অস্থির অর্থনীতির চোখরাঙানির মধ্যে এই দাবি ক্রমশ জোরদার হচ্ছে দেশের শিল্পমহলের মধ্যে। তাদের মতে, প্রতিশ্রুতি অনেক হল। অর্থনীতির মোড় এ বার সত্যিই ঘুরিয়ে দেখাক কেন্দ্র।
কিন্তু সমস্যা হল, পৃথিবী জুড়ে এই অস্থির অবস্থায় যেন কিছুটা দিশেহারা নরেন্দ্র মোদী সরকার। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। মঙ্গলবারও অর্থমন্ত্রী কথা বলেন নিজের দফতরের কর্তাদের সঙ্গে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেন তাল কাটছে কোথাও। যার ইঙ্গিত মিলছে অনেক সময়েই দুই মন্ত্রক বা দফতর থেকে আসা পরস্পরবিরোধী বয়ানে। এমনকী অর্থ মন্ত্রকেরই মুখ্য উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম এ দিন বলেন, ‘‘বৃদ্ধিকে ঠেলে তুলতে গোটা প্রশাসন যন্ত্রকেই সচল করতে হবে।’’
সোমবার ভারতের বাজারে বেনজির ধসের পরে সব দোষই কার্যত চিনের ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। এ দিনও তাঁর দাবি, ‘‘গত কাল বিশ্ব বাজারের ধস বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বরং চিনা অর্থনীতির দুর্বলতা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে ভারতের সামনে। এই অবস্থায় সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে, বিশ্ব বাণিজ্যের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে ভারত।’’ একই রকম দাবি প্রধানমন্ত্রীরও। তিনিও মনে করেন, চিনের দৌড় ঢিমে হওয়ায় আরও লগ্নি আসতে পারে এ দেশে।
কিন্তু সেই সরকারেরই মুখ্য উপদেষ্টা বলছেন, ‘‘পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে হলে, দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে সরকারকে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘সব উন্নয়নশীল দেশই লগ্নি টানার চেষ্টা করছে। তাই তা পেতে হলে সেই প্রতিযোগিতায় জিততে হবে। দেখাতে হবে এ দেশের অর্থনীতি কোথায় আলাদা। একই ছন্দে কাজ করতে হবে কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে।’’ অথচ সুদ কমানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে জেটলির অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে রঘুরাম রাজনের নেতৃত্বাধীন শীর্ষ ব্যাঙ্কের সংঘাত সম্প্রতি খবরের শিরোনামে এসেছে বারবারই।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চিনকে ছাপিয়ে বিশ্বে দ্রুততম আর্থিক বৃদ্ধির দেশ এখন ভারতই। তা মনে করিয়ে মোদী-জেটলি জুটির দাবি, রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে। লক্ষ্যমাত্রার থেকেও নীচে চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন ঘাটতি। মাথাচাড়া দেয়নি মূল্যবৃদ্ধি। ধীরে হলেও আসছে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। উপচে পড়ছে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার। সব মিলিয়ে, অর্থনীতির ভিত যথেষ্ট পোক্ত, দাবি কেন্দ্রে। কিন্তু শিল্পমহলের দাবি, শুধু পরিসংখ্যান আর প্রতিশ্রুতিতে চিঁড়ে ভিজবে না। সংস্কারে গতি ফেরাতেই হবে সরকারকে।
এই প্রবল চাপের মুখে পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) বিল পাশ করাতে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার ইচ্ছা এ দিন ফের প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। চেষ্টা করছে এ নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে ঐকমত্য তৈরির। তারা মনে করে, একা জিএসটি-ই বেশ কিছুটা গতি বাড়াবে বৃদ্ধির। সুব্রহ্মণ্যমের মতে, ‘‘জিএসটি বিল পাশ হলে দেখানো যাবে, সরকার সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’ কিন্তু এ বিষয়ে কংগ্রেস এখনও প্রকাশ্যে অনড় থাকায় সেই উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু এ দিন সকালেই কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে দাবি করেন, জিএসটি পাশ করাতে কংগ্রেসের আপত্তি নেই। অথচ খাড়্গে বলেন, তার জন্য আগে বিলের খসড়া দেখাক কেন্দ্র।
শুধু বিরোধী দল নয়, কথার অমিল দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যেও। বাণিজ্য মন্ত্রক মনে করছে, চিনা অর্থনীতির ঢিলেমিতে ভারতের সে ভাবে সমস্যা হবে না। কারণ চিনে রফতানি করে মূলত ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, চিলি, পেরু, ইন্দোনেশিয়া। অথচ সেখানে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, অনেক ভারতীয় সংস্থা ব্রাজিলের মতো দেশে লগ্নি করেছে। তাই তারা মার খেলে, ক্ষতি এ দেশের অর্থনীতিরও।
বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তাদের যুক্তি, বিশ্ব বাজারে পণ্যের দাম কমলে, ভারতের আমদানি খরচ কমবে। এমনকী ডলারে টাকার দাম বেশ কিছুটা নেমে যাওয়া নিয়েও তেমন চিন্তিত নন তাঁরা। তাঁদের দাবি, টাকার দর একটু বেশিই ছিল। তা কিছুটা কমায় বরং রফতানিতে সুবিধা হবে। অথচ সেখানে আর্থিক উপদেষ্টা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতি শ্লথ অব্যাহত থাকলে, ভারতের রফতানিও ধাক্কা খাবে।
একই ভাবে শিল্পের জমি অধিগ্রহণের রাস্তা মসৃণ করতে বিল পাশ করাতে ব্যর্থ তারা। কয়েক মাস ধরে শুধু অধ্যাদেশের উপরেই তা টিকে রয়েছে। ৩১ অগস্ট শেষ হচ্ছে সেই অধ্যাদেশের মেয়াদ। এ দিকে, মূলত জিএসটি-কে পাখির চোখ করে সংসদের বাদল অধিবেশন খাতায়-কলমে জিইয়ে রাখা হয়েছে। তাই নতুন করে অধ্যাদেশ আনা যাবে না। সরকারও চাইছে, বিহার ভোটের আগে আর নতুন অধ্যাদেশ না-এনে রাজ্যগুলিকে নিজের মতো বিল পাশ করতে বলতে। ফলে জমি-বিল বিশ বাঁও জলে।
সব মিলিয়ে, এই পরিস্থিতিতে চিনের দুর্বলতার সুযোগ ভারত কী ভাবে তুলবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শিল্প। সেই কারণেই শুধু কথা নয়, এ বার কাজ চাইছে তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy