উপযুক্ত পরিকাঠামো। বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের (সেজ) তকমা। আর কম খরচে পণ্য তৈরির সুযোগ। এই তিন ঢেউয়ের টানে এ বার ভিন্ রাজ্যে বিনিয়োগের হাতছানিতে সাড়া দিচ্ছে রাজ্যের চর্মশিল্প। অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরে কারখানা তৈরির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন বানতলা চর্মনগরীর ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে আগামী মাসে অন্ধ্র সরকারের সঙ্গে আলোচনাতেও বসতে চলেছেন তাঁরা।
একে বিশ্ব বাজারে চাহিদায় ভাটার টান। তার উপরে কম দামের পণ্যে বাজার ছেয়ে দিয়ে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে চিন। এই অবস্থায় হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে এখন সেজের সুবিধার ছাতা খুঁজছেন বানতলার ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘ দিন ধরে চেয়ে আসছেন উপযুক্ত পরিকাঠামো। রাস্তা, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে বর্জ্য শোধনের (কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা সিইটিপি) পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত। কিন্তু সেই বাম জমানা থেকে এখনও পর্যন্ত তা তাঁদের বরাতে জোটেনি।
সেই ‘সুযোগ নিয়ে’ই এখন নেল্লোরে তাঁদের লগ্নি করতে আহ্বান জানিয়েছে অন্ধ্র সরকার। সেখানকার চর্ম শিল্পতালুকে (লেদার ক্লাস্টার) বিনিয়োগ টানতে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আলাদা জুতোর পার্ক থেকে শুরু করে সেজ তকমা পর্যন্ত সব সুবিধারই। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের রাজধানী বেঙ্গালুরু যে ভাবে এ রাজ্যের মেধাসম্পদকে চুটিয়ে ব্যবহার করেছে, অনেকটা সে ভাবেই দেশে চর্মশিল্পের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করতে চাইছে চন্দ্রবাবু নায়ডুর রাজ্য।
রাজ্যের অবশ্য দাবি, বানতলার পরিকাঠামো তৈরির কাজ এগোচ্ছে জোর কদমে। ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতরের সচিব রাজীব সিংহ জানান, বর্জ্য শোধন ব্যবস্থা তৈরির বিষয়টি সম্পূর্ণ করতে কাজ হচ্ছে। বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করছে কেএমডিএ।
তবে এত দিন রাজ্যের কাছে বহু বার দরবার করেও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো না-পাওয়ার ক্ষোভের সুযোগ যে অন্ধ্র নিয়েছে, তা স্পষ্ট বানতলার ব্যবসায়ীদের কথাতেই। সেখানকার চর্ম ব্যবসায়ীদের সংগঠন কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিএলসিটিএ) দাবি, অন্ধ্র সরকারের শিল্প অধিকর্তা আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে— তৈরি পরিকাঠামো, সেজ তকমা, কম দামে জমি এবং কিস্তিতে তা কেনার সুবিধা। ব্যবসায়ীদের ধারণা, এই সমস্ত সুবিধা পেলে কম খরচে পণ্য তৈরি করা যাবে। চিনের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে যার জন্য মরিয়া তাঁরা।
সিএলসিটিএ-র অন্যতম কর্তা জিয়া নাফিসের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে দামের কারণে চিনের কাছে মার খাচ্ছে ভারতের চর্মশিল্প। যেমন, দামের লড়াইয়ে পেরে ওঠা কঠিন হচ্ছে চিনা জুতোর সঙ্গে। ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০১৫-’১৬ সালে জুতো রফতানি কমেছে প্রায় ৫৫%। তাঁর অভিযোগ, দাম চোকাতে হচ্ছে নিম্ন মানের পরিকাঠামোর। নাফিসা বলেন, ‘‘বানতলা চর্ম শিল্পের বর্জ্য পদার্থ ফেলতে আলাদা জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছিল। তা আজও তৈরি হয়নি। ওই বর্জ্য সরাতেই বছরে দু’ কোটি টাকা খরচ হয়।’’
আসলে গোড়া থেকেই বানতলা চর্মনগরীকে তাড়া করে ফিরছে দূষণের ভূত। বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছে বর্জ্য শোধন ব্যবস্থা। চর্ম ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিইটিপি-র ছ’টি মডিউল তৈরির কথা ছিল। কিন্তু মাত্র চারটি তৈরি করেছে নির্মাণ সংস্থা এম এল ডালমিয়া। যে কারণে এখন ২ কোটি লিটার বর্জ্য শোধন করা হয়। যেখানে তার পরিমাণ ৩ কোটি লিটার। ফলে ঘাটতি থেকেই গিয়েছে। চর্মশিল্পের ক্ষোভ, পরিকাঠামোর অভাবের অভিযোগ তুলে রাজ্যের দ্বারস্থ হলেও প্রশাসনিক উদাসীনতায় সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। বরং সময়ে পরিকাঠামো না-পাওয়া নিয়ে দফায় দফায় রাজ্যের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছে সিএলসিটিএ।
আর পরিকাঠামোয় এই ঘাটতির কারণে বিনিয়োগও আটকে রয়েছে চর্ম শিল্পে। ফাঁকা জমি রয়েছে। আগ্রহী লগ্নিকারী মজুত। তবুও বানতলায় নতুন কারখানা তৈরি করা যাচ্ছে না। সিএলসিটিএ-র সাধারণ সম্পাদক ইমরান আহমেদ খানের অভিযোগ, বর্জ্য ব্যবস্থার অভাবে নতুন প্রকল্পে ছাড়পত্র দিচ্ছে না রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। ফলে আটকে রয়েছে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও অন্তত দেড় লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান।
তার উপর হালে আবার জমি নিয়ে আদালতে গিয়েছে বানতলার চর্মশিল্প। অভিযোগ, তাদের থেকে ১২০ একর আগেই দেওয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে। তার উপর আবার আরও ৪০ একর তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। এর বিরুদ্ধেই আইনের দরজায় কড়া নেড়েছে তারা।
চর্ম ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, দেশ ও বিদেশের বাজারে চামড়ার জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় জুতো। মোট বাজারের ৫২%। তাই শুধুমাত্র জুতো তৈরির জন্য একটি পার্ক তৈরির প্রস্তাব রাজ্যকে দিয়েছিলেন চর্ম ব্যবসায়ীরা। এ বছরের গোড়ায় বিনিয়োগ টানার সম্মেলন ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর মঞ্চে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু তারপরে তা আর এগোয়নি। সেখানে লগ্নি টানতে ও তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে নেল্লোর লেদার ক্লাস্টারে জুতোর পার্ক থেকে শুরু করে সেজ তকমা পর্যন্ত সব সুবিধাই অন্ধ্র সরকার দিতে চেয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy