৯২ সালের ডিসেম্বরে ‘লজ্জা’ লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভাল হবে। অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ ফেরত আসবে। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান আবার একসঙ্গে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারবে। আবার গাইতে পারবে সেই গান, ‘…আমরা খ্রিস্টান, আমরা বৌদ্ধ, আমরা হিন্দু, আমরা মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’। কে জানত, আমার ‘লজ্জা’ আসলে মানুষকে লজ্জা দেবে না। নিষিদ্ধ করার আগে পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। নিষিদ্ধ হওয়ার পর জাল বইয়ে ছেয়ে গিয়েছিল দেশ, শুধু দেশ নয়, পাশের দেশও। ইউরোপ আমেরিকার প্রকাশকরা রীতিমতো উত্তেজিত ছিল ‘লজ্জা’ প্রকাশের অনুমতি পাওয়ার জন্য। প্রায় তিরিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ‘লজ্জা’। কী লাভ হয়েছে ‘লজ্জা’ লিখে, প্রকাশ করে, বিক্রি করে? মানুষের কী লাভ হয়েছে ‘লজ্জা’ পড়ে? যে ‘লজ্জা’ লেখার জন্য সাম্প্রদায়িক লোকদের ছুড়ে দেওয়া ঘৃণা পেয়েছি, যে ‘লজ্জা’ লিখে সরকারের চক্ষুশূল হয়েছি, যে ‘লজ্জা’ লিখে নিষিদ্ধ লেখক হিসেবে একঘরে হয়েছি, যে ‘লজ্জা’ লিখে বইমেলায় মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছি, যে ‘লজ্জা’ লিখে হিন্দু মৌলবাদীদের স্বার্থরক্ষা করেছি— এই মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছি, সেই ‘লজ্জা’ পড়ে অসাম্প্রদায়িক মানুষের এতটুকু বোধোদয় হয়নি। ‘লজ্জা’ পড়ে লজ্জা হয়নি হিন্দু-বিদ্বেষী মুসলমানদের। যা ছিল তারা, তাই আছে। বরং আরও ভয়ংকর হয়েছে। সরকার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াবার ভান করতো তখন, এখন ওই ভানটুকু করার প্রয়োজনও বোধ করে না।
সত্য কথা অকপটে বলার অপরাধে আজ ২২ বছর নির্বাসনদণ্ড ভোগ করছি। এই নির্বাসনে বাস করেও দেশ থেকে অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন হলে উৎসব করি। মানবতার পক্ষে কোনও মানববন্ধন হলে আনন্দ পাই। ইদানীং যা খবর পাচ্ছি তা আমাকে ভীষণই উদ্বিগ্ন করছে। আশার যত ছিটেফোঁটা আলো ছিল, একটু একটু করে সব নিভে গেছে। মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী ব্লগার-লেখকদের কুপিয়ে মারা হচ্ছে দেশে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। ক’দিন আগে ঝিনাইদহে সত্তর বছর বয়সী হিন্দুপুরোহিত অনন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে কুপিয়ে মেরেছে তিন মুসলিম সন্ত্রাসী। মোটরসাইকেল থেকে নেমে খুনিরা কুপিয়েছে তাঁকে। সকাল সাড়ে ন’টার দিকে সাইকেলে চড়ে অনন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ি থেকে নলডাঙা বাজারের মন্দিরে যাচ্ছিলেন পুজো করতে। তাঁর আর নলডাঙা পৌঁছোনো সম্ভব হয়নি। অনন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায় নাস্তিক ছিলেন না। ইসলামের সমালোচনা করে তিনি ব্লগ লিখতেন না বা বইও লিখতেন না। কিন্তু, তাঁকে কেন খুন করা হল? তাঁকে খুন করার একটিই কারণ, তিনি হিন্দু। সে দিন পাবনার হেমায়েতপুরে অনুকুল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রমের এক সেবায়েৎকে সকালবেলা কুপিয়ে মেরে ফেলা হল। সেবায়েৎ নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে ইসলামের নিন্দে করেননি। তাঁর অপরাধ তবে কী ছিল? তাঁর অপরাধ ওই একটিই, তিনি হিন্দু ছিলেন। নিখিলচন্দ্র জোয়ারদার নামের এক হিন্দু দরজিকেও কিছু দিন আগে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। মোটরসাইকেল চালিয়ে এই খুনিও এসেছিল। শুধু হিন্দু নয়, সুনীল গোমেজ নামের এক খ্রিস্টান মুদির দোকানিকেও কুপিয়ে মেরেছে খুব বেশি দিন হয়নি। বৌদ্ধ এক ভিক্ষুকেও তো মেরে ফেলল। কিছু বিদেশিকে মেরেছে। এক জাপানি লোক, এক ইতালিয়ান লোক। যাকেই পেয়েছে। সুন্নি সন্ত্রাসীরা সেই মুসলিমদের কুপিয়ে মেরেছে, যাদের তারা মুসলিম বলে মনে করে না। সুফি, শিয়া, আহমদিয়া কাউকে রেহাই দেয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতেই তো পঞ্চগড়ের এক হিন্দু পুরোহিতকে গ্রেনেড ছুড়ে, গুলি করে, গলা কেটে মারল মোটরসাইকেলে আসা আততায়ীরা। হিন্দুরা নিরাপত্তার অভাবে গোপনে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ঘরবাড়ি জমিজমা ত্যাগ করে শুধু জবাই হওয়া থেকে বাঁচার জন্য চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। হিন্দুদের ভিটেমাটি দখল করার লোভ অনেক মুসলমানের। ভিটেমাটির লোভেই হিন্দুর উপর অত্যাচার করতে থাকে, যত ক্ষণ না তারা সব ছেড়েছুড়ে বিদেয় হয়।
লজ্জা উপন্যাসে সুরঞ্জন ঠিক যে ভাবে চলে গিয়েছিল, সে ভাবে আজও হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। ভারত ভাগের সময় থেকেই দেশ ছাড়ছে হিন্দুরা। আদমসুমারি অনুযায়ী ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ ভাগ, ১৯৫১ সালে হিন্দুর সংখ্যা ছিল শতকরা ২২.০৫ ভাগ, ১৯৬১ সালে শতকরা ১৮.৫ ভাগ, ১৯৭৪ সালে ছিল শতকরা ১৩.৫ ভাগ, ১৯৮১ সালে শতকরা ১২.১৩ ভাগ, ১৯৯১ সালে ১১.৬২ ভাগ, ২০০১এ শতকরা ৯.২ ভাগ, ২০১১ এ শতকরা ৮.৫ ভাগ। ২০১৬-তে এখন সেটি সম্ভবত আরও অনেক কম। বাংলাদেশে জিহাদিদের সন্ত্রাস যে-হারে বাড়ছে, যে হারে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চলছে এবং সরকার যে ভাবে চুপচাপ বসে আছে, তাতে মনে হয় না বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে হিন্দুরা আদৌ বাংলাদেশে থাকবে। হিন্দুর সংখ্যা ক্রমে শূন্যতে এসে ঠেকবে। এ দেশে শুধু জিহাদি এবং জিহাদিদের যারা সমর্থন করে, তারাই থাকবে। তারাই দেশে শরিয়া আইন বা আল্লাহর আইন নিয়ে আসবে। মানবাধিকার বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। নারী আর মানুষ হিসেবে গণ্য হবে না। যৌনবস্তু হিসেবে নারীকে দেখা হবে। বাক-স্বাধীনতা বলে কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না।
ক্ষমতায় যে রাজনৈতিক দলটি এখন আছে, এই দলটিকে চিরকালই ‘সেক্যুলার’ দল হিসেবে মানুষ ভেবে আসছে। এই দলটি নাকি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু এই দলটি যখন ক্ষমতায়, তখন হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়ানো, মন্দির ভাঙা, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করা, হিন্দুদের খুন করা, তাদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করার ঘটনা কিছু কম ঘটেনি। হিন্দুর নিরাপত্তা আসলে কোনও সরকারের আমলেই নেই বাংলাদেশে।
এই দেশ জিহাদিরা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে, জিহাদিদের হাত থেকে রক্ষা না করলে দেশটার মৃত্যু হবে। জিহাদিরা দিনে দুপুরে রাস্তাঘাটে এমনকী বাড়িতে ঢুকে সবার চোখের সামনে কুপিয়ে মেরে ফেলছে মুক্তমনা লেখক-ব্লগার, মেরে ফেলছে দেশের সংস্কৃতিমনা ছাত্র-শিক্ষক, মেরে ফেলছে সম্পাদক-প্রকাশক, প্রগতিশীল মুসলমান, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এই খুনখারাবি রোধ না করে, দেশ এবং দেশের মানুষকে না বাঁচিয়ে তিনি আল্লাহর ঘর বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা করে এসেছেন সৌদি আরবের বাদশাহের কাছে। এমনিতে সৌদি আরবের টাকায় বাংলাদেশে প্রচুর মৌলবাদী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যে সব প্রতিষ্ঠান অগুনতি জিহাদি তৈরি করছে। কিন্ডাগার্টেন থেকে শুরু করে হাসপাতাল, ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় কী নেই মৌলবাদীদের! আজকাল মগজধোলাই-এর জন্য মাদ্রাসার প্রয়োজন নেই, মৌলবাদীদের টাকায় প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেনেই ভালো মগজধোলাই-এর কাজ চলছে। শেষ হাসিনা আরও সৌদি অর্থ বিনিয়োগ পেতে মুখিয়ে আছেন। এ নিয়ে ক’দিন আগে বাদশাহের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তিনি বোধহয় বাংলাদেশটাকে হালের ইরাক বা সিরিয়া না বানিয়ে ছাড়বেন না।
বাংলাদেশে আজকাল নৃশংস ভাবে কুপিয়ে মানুষ মেরে আইসিস বা ইসলামিক স্টেট থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে তারা মেরেছে। এক একটা হিন্দু মারছে, আর বুক ফুলিয়ে অপকর্মটি তারাই করেছে বলে গর্ব করছে। তাদের এতটুকু ভয় নেই অপকর্ম করতে। কারণ এই অপকর্ম করার জন্য তাদের কোনও শাস্তি পেতে হয় না। দেশের সরকার ইসলামের নামে যে খুনগুলো করছে জিহাদিরা, নিজগুণে তাদের ক্ষমা করে দিচ্ছেন। খুনিদের অপরাধী বলে মনে করেন না দেশের সরকার। তাই এই যে প্রায় প্রতি মাসে, বা আজকাল প্রতি সপ্তাহে যে খুন করছে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা অর্থাৎ জিহাদিরা, এই খুনের বিরুদ্ধে সরকার থেকে কোনও অসন্তোষ প্রকাশ করা হচ্ছে না, কোনও বিবৃতি নেই, কোনও হুমকি নেই। যে হুমকি এ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে তা লেখকদের বিরুদ্ধে। ভিকটিমদের বিরুদ্ধে। ভিকটিমদেরই দোষী সাব্যস্ত করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। সাবধান করে দিয়েছেন ইসলামের কোনও সমালোচনা যেন তারা না করে, যদি করে, তা হলে তাদের জেলে ভরবেন, শাস্তি দেবেন। দেশে ৫৭ আইসিটি অ্যাক্ট নামের একটি আইন আছে, এই আইনে ফাঁসাচ্ছেন মুক্তচিন্তকদের। কিন্তু, জিহাদি খুনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নতুন কোনও আইন তৈরি করেননি। খুনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য যে আইন আছে দেশে, সেটিকেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করছেন না।
হিন্দু সংখ্যা এত কমে গেছে যে হিন্দুরা কোনও দলেরই আর ভোট ব্যাঙ্ক নয়। হিন্দুদের এমনিতেও ভোট দেওয়ার অধিকার নেই। হিন্দুরা আওয়ামি লিগকে ভোট দেয়, কারণ আওয়ামি লিগ সেক্যুলার দল, এই দলটি হিন্দুদের নিরাপত্তা দেয়— এ রকম একটি বিশ্বাস প্রায় সকলের। ভোটের সময় আওয়ামি লিগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে যায়, ভোট দিলে তাদের আর রক্ষে নেই, কেউ যেন ভোটের দিন বাড়ি থেকে বের না হয়। অধিকাংশ হিন্দুই ভয়ে ভোট দেয় না। হিন্দু মরলে তাই কারও কিছু যায় আসে না। না খালেদা জিয়ার, না শেখ হাসিনার। না অন্য কোনও দলের।
আমার আর লজ্জা হয় না দেশটির করুণ অবস্থা দেখে, আমার ভয় হয়।
সৌজন্যে বাংলা ট্রিবিউন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy