বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ঢাকায় শুরু হচ্ছে মেট্রোরেলের কাজ। দেশ জুড়ে চলছে একাধিক বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বদলে যাচ্ছে রাজধানীর দৃশ্যপট। বদলে যাচ্ছে গ্রাম। প্রবৃদ্ধি এখন সাতের ঘরে। তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তব। বিচার চলছে যুদ্ধাপরাধীদের। শাস্তি কার্যকর হচ্ছে। জঙ্গি দমনে রয়েছে একের পর এক সাফল্য।
এমন দৃশ্যপটেই বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের তিনটি বছর পূর্ণ হল আজ। তৃতীয় বছরেও প্রথম দু'বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারা গেছে, এমনটাই মনে করছে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এর মাঝে টানাপড়েন ছিল। পথ চলতে হোঁচটও খেতে হয়েছে। ছিল জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর ছোবল। সেই চ্যালেঞ্জ ভালভাবেই মোকাবেলা করছে সরকার। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। দেশের সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন ধারা বেগবানই থেকেছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে থাকলেও এখনও বিরাজ করছে বড় কিছু অস্বস্তি। এই অস্বস্তি দূর না হওয়ায় সরকারকে সমালোচনার মুখোমুখিও হতে হচ্ছে।
সরকারের তৃতীয় বছরে হরতাল ও অবরোধের মতো বৈরী বাস্তবতা ছিল না। সন্ত্রাসবাদের আঘাত এলেও দ্রুত তা সামলাতে পেরেছে সরকার, প্রশাসন। পরপর প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক, ব্লগার হত্যার মতো ঘটনা থেমেছে। সরকারের গর্ব করার মতো সাফল্যের পুরোভাগে আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির রায় কার্যকর। দেশি-বিদেশি সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী আলবদর বাহিনীর নেতা, চট্টগ্রামের মির কাসেম আলির ফাঁসি এ সময়েই কার্যকর হয়েছে। গত তিন বছরে নারী ও যুবশক্তির নব অভ্যুদয় ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন। এ কারণে বিনিয়োগেও গতি এসেছে। বিনিয়োগের পরিমাণ এখন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। ব্যক্তিগত খাতে ঋণপ্রবাহের পরিমাণ ৬ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। গতকালই বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের জাতীয় উত্পাদনে (জিডিপি) তেজি ভাব অব্যাহত থাকবে, যা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি।
খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩৯০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। কৃষিঋণ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মাথা পিছু আয়ের পরিমাণ ১,৪৬৫ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৭২)। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ হাজার ৯৮০ মেগাওয়াট। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকারের মনোযোগ ছিল নজরে পড়ার মতো। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভাল ভূমিকা রাখছে।
তৃতীয় বছরে বিদেশে সাত লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। রফতানির পরিমাণ এখন ৩,৪২০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৮০০)। আমদানির পরিমাণ ৪০০০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৫)। প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১,৪৯০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৪৪)। রাজস্ব আয় ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। দারিদ্রের হার ২৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। সাক্ষরতার হার ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৯ লাখ (জনসংখ্যা ১৫.৬৬ কোটি, ২০১৩র হিসাব অনুযায়ী)।
বর্তমান সরকারের তিন বছরে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। বিগত মহাজোট সরকারের আমলে নেওয়া পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় গত তিন বছরে প্রায় ৫০ হাজার তরুণকে তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ-সহ উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রযুক্তির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা নিজেদের অবস্থান বেশ শক্ত করেছেন। আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তি বাজার থেকে তরুণ উদ্যোক্তাদের আয়ই হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় শক্তি।\
আরও পড়ুন, বাংলাদেশে স্কুল পাঠ্য কাণ্ডে তদন্ত কমিটি, সাসপেন্ড দুই কর্তা
আজকের বাংলাদেশ আত্মপ্রত্যয়ী, দেশবাসীর উদ্দেশে হাসিনা
ইউনিয়ন পরিষদ তথ্যকেন্দ্রগুলো ডিজিটাল সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে। সারা দেশে স্কুল-কলেজে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম তৈরি করা হয়েছে। সফটওয়্যার রফতানি শিল্পে আয় বেড়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। জেলা ই-সেবা কেন্দ্র চালুর ফলে জমির দলিল, বিভিন্ন সেবা খাতের লাইসেন্স প্রদান ও গ্রহণ পদ্ধতি অনেকটাই দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক, কারওয়ান বাজারে সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও ১১টি হাইটেক পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে যাচাইয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের সিমকার্ড নিবন্ধন হচ্ছে। ফলে মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধানও সহজ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কথা রয়েছে। এ বছরই বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল-এও যুক্ত হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটককে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তোলার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এত সব ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি কিন্তু এমন অনেক কিছুও রয়ে গেছে, যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বরং অগ্রগতির এই ঢেউকে ধরে রাখতে গেলে এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, “অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে বেড়েছে। জনকল্যাণমুখী সামাজিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে ১০ টাকার চাল নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা বড্ড বেমানান।” তিনি আরও বলেন, “দেশে মানবাধিকার-সহ মত প্রকাশের বিষয় সংকুচিত হয়েছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (রাষ্ট্রীয়) রয়েছে। নারী ও শিশু অধিকারের বিষয়টা এখনও উদ্বেগজনক।”
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ রাজনীতিতে অস্থিরতা না থাকলেও, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা কিন্তু যথেষ্ট মাত্রায় গড়ে ওঠেনি। ২০১৪ সালে আওয়ামি লিগের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার অঙ্গীকার থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায়নি। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সংলাপের তাগিদ থাকলেও সরকারের কাজে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। তবে বছর শেষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দলগুলোর নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনা সবার নজর কেড়েছে।
বিদ্যুৎ-গ্যাসের সুনিশ্চিত সরবরাহ না থাকায় শিল্প খাতে আশানুরূপ গতি আসছে না। কিছু পদক্ষেপ করা হলেও সার্বিকভাবে দুর্নীতি কমছে না। এখনও ন্যায়পাল নিয়োগ হয়নি। তবে জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি নাগালের মধ্যে রয়েছে। শিক্ষাবর্ষ শুরুর দিনেই বিনামূল্যে বই পৌঁছে দিয়ে সরকার আবারও সাধুবাদ কুড়িয়েছে। যদিও ভুলের ছড়াছড়ি সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ছিল নানা পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, অপরাজনীতি, দলীয়করণ কমেনি। কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র লিগের অন্তর্কোন্দলে অস্থির।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সব মিলিয়ে স্বস্তিদায়ক নয়। সম্প্রতি একজন সংসদ সদস্যকে বাড়িতে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গুম-হত্যার ঘটনা ঘটছে।
গুলশানের রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ইদের নামাজের আগে সন্ত্রাসী হামলার পরিস্থিতি সরকার সফলভাবে সামাল দিলেও, কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ড সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সংখ্যালঘুদের উপর হামলা এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল উচ্ছেদের ঘটনাও সরকারের জন্য সুখকর ছিল না।
তৃতীয় বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনাও সরকারকে চাপে ফেলেছিল। তবে সেই তদন্ত এগিয়েছে। পুরো টাকা উদ্ধারের আশাও আছে।
সাংগঠনিক দুর্বলতায় বিএনপি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় রাজনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা নেই। তবে দেশে রাজনীতির পরিবেশ নেই বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামি লিগ দেশ শাসনের নামে নির্যাতনের শাসন অব্যাহত রেখেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। গণমাধ্যম শৃঙ্খলিত।
আরও পড়ুন, পড়ার উপযোগী করে লিখতে হবে প্রেসক্রিপশন, নির্দেশ বাংলাদেশের আদালতের
বিএনপির এমন বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন আওয়ামি লিগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক পরিবেশে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র উন্নয়নের সুবাতাস বইছে। আইনের শাসন কার্যকর হচ্ছে। মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করছেন। গণমাধ্যমও স্বাধীনতা ভোগ করছে।”
ক’মাস আগে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। শি জিনপিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে এক নতুন মাইলফলক তৈরি হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে চিনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ছে। পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলি টানেলের মতো বড় প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে চিন। বহির্বিশ্বে অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়েছে।
তবে সংসদ নিষ্প্রাণ থেকেছে সরকারের তৃতীয় বছরেও। সংসদে সত্যিকার বিরোধী দল অনুপস্থিত। কারণ বিএনপি গত নির্বাচন বয়কট করেছিল। নানা ছুতোয় সংসদ বর্জন না করার বিষয়টি ইতিবাচক হলেও সরকারের সুরে কথা বলায় বিরোধী দলের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
তবে এত কিছুর পরও সামগ্রিক বিবেচনায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথেই রয়েছে বাংলাদেশ। এখনও এই সরকারের সামনে আরও দুটি বছর রয়েছে। গঠনমূলক সমালোচকদের আশা, যে সব গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিগুলো রয়ে যাচ্ছে তার দিকে এ বার বিশেষ নজর দেবে সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy