একটি সহজ সত্যি বুঝতে না পেরেই গুরুতর বিপদে পড়েছিলেন শিবানুজ মহর্ষি ভৃঙ্গী। তার পরিণতি যে কী হয়েছিল, তা শুনলেও অবাক হতে হয়।
সেটি কী? বলি। তার আগে বলি, কালী মায়ের পাশে শৃগাল থাকলেও মায়ের বাহন কিন্তু শৃগাল নয়, তারা আদতে শাবক ও সহচর। মা হলেন শবারূঢ়া অর্থাৎ বাহন হলেন শব, শিবরূপ শব। অর্থাৎ শিব-শক্তি হলেন নারী ও পুরুষ তথা এই সমগ্র জগত-সংসার। তারা অবিচ্ছিন্ন; একে অপরের পরিপূরক।
শিব আছেন স্থির ধাত্র হয়ে আর মা সৃষ্টি করে চলেছেন।
এটিই বুঝতে না পেরে সঙ্কটে পড়েছিলেন শিবানুজ মহর্ষি ভৃঙ্গী।
ব্যাপারটি কী রকম? আসা যাক সেই কাহিনিতে।
একদা মহর্ষি ভৃঙ্গী শিব এবং শক্তিকে এক সঙ্গে দেখে বললেন যে, দেবী শক্তি যেন পাশে দাঁড়ান। তিনি তাঁর আরাধ্য মহাদেবকে প্রদক্ষিণ এবং আরাধনা করবেন। স্ত্রী-র এহেন অপমানে দেবাদিদেব ক্রোধী হলেন। কিন্তু মহর্ষির ভক্তি ও সেবার কথা স্মরণ করে, আরেক বার পরস্পরের অভিন্নতা বোঝানোর জন্য তাঁরা অর্ধনারীশ্বর রূপ পরিগ্রহ করলেন।
সে এক অপূর্ব রূপের ছটা! এক দিকে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা দেবী গৌরী আর অপর দিকে দুগ্ধ ফেনার ন্যায় শ্বেতশুভ্র মহেশ্বর!
এমন দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু শিবানুচর মহর্ষি তখন আপন ভক্তি ও জেদের দ্বারা আচ্ছন্ন। শক্তি আর শিব যে একই, তাঁরা যে পরিপূরক, তা তিনি কিছুতেই মানবেন না। তিনি পুরুষকারে অর্থাৎ শিবেই অটল। কেবলমাত্র মহেশ্বর-ই তাঁর আরাধ্য। তাঁকেই পূজা করবেন তিনি, মা’কে নয়।
তখন মা বললেন, ‘‘বেশ তুমি তা হলে আমাদের মধ্যে থেকে কেবল মহাদেবকে প্রদক্ষিণ করে দেখাও। এ অর্ধনারীশ্বর শরীর ভেদ করে দেখাও।’’
মহর্ষি তৎক্ষনাৎ ভৃঙ্গ অর্থাৎ ভ্রমরের রূপ নিলেন। কিন্তু তাঁরা যে অভেদ্য! ভ্রমর বারবার আঘাত করতে লাগল অর্ধনারীশ্বর দেহে কিন্তু তাকে ভেদ করা সম্ভব হল না।
তখন ক্রুদ্ধ দেবী শক্তি তাঁকে অভিশাপ দিলেন। মাতৃত্বের প্রতি যদি তাঁর এতই অবজ্ঞা, তা হলে মায়ের থেকে পাওয়া যে সমস্ত পেশি, স্নেহ তিনি নিয়েছিলেন, তা মা তাঁর থেকে হরণ করে নিলেন। বললেন, ‘‘বরং পিতার হতে পাওয়া হাড়, স্নায়ু নিয়ে সে বেঁচে থাকুক।’’
তৎক্ষণাৎ মহর্ষি ভৃঙ্গীর দেহ পতিত হল ভূমিতে, অঝোর ধারায় ঝরল অশ্রু।
কিন্তু ওই যে মায়ের মন! কু-সন্তান হতে পারে কিন্তু কুমাতা কখনওই নয়। এ দিকে দেওয়া শাপ তো আর ফেরানো যায় না। মা বললেন, ‘‘বেশ তৃতীয় পদ দিলাম। এই তৃতীয় পদ নিয়ে তুমি ভৃঙ্গী হয়ে সারা জীবন দাঁড়িয়ে থেকো।’’ সে ভাবেই তিনি পূজিতা হন, নটরাজ মূর্তিতে।
তবে কথিত, শিবানুজদের কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে বলতে হয় নন্দী মহারাজের কথা। নন্দী মহারাজ হলেন গণাধিপতি অর্থাৎ সমগ্র গণের অধিপতি, তাই তিনি মহারাজ।
কোন এক কালে স্ত্রী হীন মহর্ষি শিলাদ আপন সন্তান লাভের ইচ্ছায় দেবরাজ ইন্দ্রের তপস্যারত হন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দিলে তিনি স্বয়ম্ভু (আপন হতেই সৃষ্ট) পুত্র সন্তানের বর চাইলেন। ইন্দ্র পড়লেন মহা ফাঁপরে। স্বয়ম্ভূ পুত্র সন্তান এ তাবড় সংসারে একমাত্র মহাদেব। দ্বিতীয় একটি মহাদেবের বর তো তিনি দিতে পারেন না।
অতএব তিনি মহর্ষি শিলদাকে মহাদেবের তপস্যা করতে বললেন। সে কঠিন তপস্যায় মহর্ষি একটি উইপোকার ঢিবিতে পরিণত হয়েছিলেন শোনা যায়। এমন তপস্যা ইতপূর্বে কেউ করেননি। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব শিলদাকে আপন গুণসম্পন্ন পুত্র বা নিজেই তার পুত্র রূপে জন্মানোর বর প্রদান করলেন।
তিন চোখ, চার হাত ও দিব্য জ্যোতি সম্পন্ন পুত্র আবির্ভূত হলে তার নাম রাখা হয় নন্দী। কাল গড়ায় সেই সমস্ত দৈবীভাব সরিয়ে রেখে, মানুষের মতো বড় হতে থাকেন নন্দী।
বেদ শাস্ত্র অঙ্গ উপাঙ্গ সমস্ত কিছু অধ্যয়নের শেষে মিত্র-বরুণ তাঁকে নিয়ে যান বাকি অধ্যয়ন দেবার জন্য। সেখানেই তাঁরা ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, এই পুত্র ক্ষণজন্মা। মহর্ষি শিলদা আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি অনেক তপস্যা করেই ঈশ্বরকে আপন পুত্র রূপে লাভ করেছেন যে!
পিতার দুঃখে কাতর হয়ে নন্দী আবার মহাদেবের ধ্যানে বসেন। কোটি বার রুদ্রনাম জপের পর মহাদেব এবং দেবী পার্বতী তাঁকে দেখা দেন এবং মহাদেব তাঁকে নিশ্চিত করেন, তিনিই হলেন মহাদেবের অংশ। তিনি অজর এবং অমর। এবং তিনি হবেন সমগ্র গণের অধিপতি। মহাদেবের জটার পদ্মমালা নন্দীর কন্ঠে পরিয়ে পঞ্চ নদীর জল দিয়ে তিনি তাঁকে আশীর্বাদ করেন।
নন্দী মহারাজও করজোড়ে মহাদেবের কাছে এই প্রার্থনা করে নেন, তিনি যেন সারা জীবন মহাদেবের ভার বহন করতে পারেন। আর মায়ের কাছে আবদার করেন তার পরিবারের অংশ হওয়ার!
সেই থেকে নন্দী মহারাজ মহাদেবের বাহন, বিপুল বপু, ঐশী তেজোদীপ্ত ষাঁড়। আর মায়ের কাছে তিনি তাঁর পরিবারের অংশ, কৈলাশ মুখ্য।
তাই তো যে কোনও মন্দিরে দেখবেন, মহেশ্বর এর দিকে মুখ করে বসে থাকেন নন্দী মহারাজ। নিস্পন্দ হয়ে, নিস্পলক নেত্রে তাকিয়ে থাকেন আপন আরাধ্যের দিকে। কথায় আছে শিবের কাছে যা কিছু প্রার্থনা করার, তা নন্দী মহারাজ এর কানে কানে বলতে হয়, তাঁর কানে বলাই শিবকে বলা— শিব মানেই নন্দী।
আর শিব মানেই শক্তি। কারণ শিব তত্ত্ব সংসার তত্ত্ব।
তথ্যসূত্র: শিব পুরাণ (জে. এল. শাস্ত্রী), স্কন্দ পুরাণ জ্যোতিষার্ণব (অরিজিত মজুমদার), নম: শিবায় ( সুচেতনা সেন কুমার)
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy