দেওয়ান ভবানীচরণ মিত্র সে দিন সপার্ষদ এসেছিলেন সরস্বতী নদীতীরে সান্ধ্যভ্রমণে। হঠাৎ তাঁর কানে এল ঘণ্টাধ্বনি আর সেই সঙ্গে শিবস্তোত্র। একটু অবাকই হলেন তিনি। কাছেপিঠে শিবমন্দির তো নেই, পুজোর শব্দ আসে কোথা থেকে? বাড়িতে ফিরে এলেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু ব্যাপারটা ঘুরতে লাগল তাঁর মাথায়। কিছু দিন পরে নদীতীরের মাঠের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে দেখলেন একই ঘটনা। কোথা থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রপাঠের আওয়াজ। সে দিনই তিনি ঠিক করলেন নদীর তীরে শ্মশানের পাশে শিবমন্দির তৈরি করবেন। তাঁর নির্দেশে পরের দিন থেকেই বর্ধমানের মহারাজের সহায়তায় মন্দির তৈরির কাজ শুরু হল। সরস্বতী নদীর তীরে তৈরি হল দ্বাদশ শিবমন্দির।
ভবানীচরণ মিত্রের আর এক জ্ঞাতি ভ্রুকুটিরাম মিত্র এর কিছু দিনের মধ্যে বাকসা গ্রামেই তৈরি করলেন রঘুনাথ জিউয়ের মন্দির। সুন্দর সেই মন্দিরে প্রতি সকাল-সন্ধ্যায় আরতি হয় রাধাকৃষ্ণ এবং রঘুনাথের। গ্রামে মিত্রদের এত মন্দির— শিব, রাধাকৃষ্ণ, সবাই নিত্য পূজিত, অথচ দেবী দুর্গার আবাহন হবে না, এমনটা তো হতে পারে না। পরশুরাম মিত্রের সময় মিত্র পরিবারের একটি শাখা প্রভূত সমৃদ্ধি লাভ করল। তিনিই রঘুনাথ মন্দির তৈরির কয়েক বছর পর তাঁর বসতবাড়িতে দুর্গাদালান করে শুরু করলেন দুর্গাপূজা। এমন জাঁকজমকের পুজো গাঁয়ের লোক আগে দেখেনি। প্রতি বছর পুজোতে মিত্রদের বাড়ির পুজো দেখতে সারা গ্রামের লোক ভিড় করে আসেন। ভবানীচরণ মিত্রর পরিবারও এর কিছু দিনের মধ্যে শুরু করলেন দুর্গাপুজো। জনাই বাকসা এলাকায় প্রায় সাতটি মিত্র বাড়িতে আগে দুর্গাপুজো হত ধুমধাম করে। এখন সব বাড়ির পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র পরশুরাম মিত্রের বাড়িতেই এখনও পুজো হয়।
এই বাড়িতে উল্টোরথের দিন ‘কাঠে ঘা’ হয়। একটি নতুন বাঁশকে পুজো করে সেই বাঁশটি ঠাকুরের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহার করতে হয়। এর পর শুরু হয়ে যায় মূর্তি তৈরির কাজ। বাড়িতে রঘুনাথ জিউয়ের মন্দির থাকলেও পুজো হয় শাক্তমতে। এই বাড়িতে পুজোর পনেরো দিন আগে বোধন হয়। বোধন থেকে চণ্ডীপাঠ শুরু হয়। কলা বউ চলে আসে সেই সময়েই। মিত্রবাড়িতে তিন বার কলাবউ আসে। কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে অধিবাস হয়। নবমীতে কলা বউ আসে। এর এক সপ্তাহ পরে শুক্লপক্ষের প্রতিপদে আবার অধিবাস হয়। দু’জন পুরোহিত এর পরের দিন সরস্বতী নদীতে যান। এক জন পুরনো কলাবউয়ের বিসর্জন দেন। অন্য জন নতুন কলাবউ স্নান করিয়ে নিয়ে আসেন। এই কলাবউকেও বিসর্জন দেওয়া হয় সপ্তমীতে। ষষ্ঠীতে অধিবাসের পর সপ্তমীতে ফের কলাবউ আসে।
আরও পড়ুন: দত্তবাড়ির পুজোর সুরে মিশে থাকে দেশাত্মবোধের আবেগ
বোধন শুরু হওয়ার সময়েই ঠাকুরদালানে কিছুটা জায়গায় মাটি ফেলে তাঁদের নানা শস্যের বীজ ফেলা হয়। পুজো শুরুর সময় অঙ্কুর বেরয় শস্য থেকে। তার ওপর ঠাকুরের চৌকি পাতা হয়। দেবী দুর্গা যে সঙ্গে করে ফসল আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসেন, এই আচারের মাধ্যমে সেই কথাই বোঝান হয়। মিত্র পরিবারের জমিদারির আয় ছিল মূলত কৃষি। সেই কারণেই পুজো শুরুর সময় থেকে এই নিয়ম। ষষ্ঠীর দিন ঠাকুরকে চৌকিতে তোলার পর কাপড়, গয়না পরানো হয়। দেবী দুর্গা এবং লক্ষ্মী সরস্বতী বেনারসী পরেন। পুজো শুরুর আগে রঘুনাথ মন্দির থেকে রঘুনাথ জিউকে আনা হয় ঠাকুরদালানে। সেই সঙ্গে আনা হয় মঙ্গলচণ্ডীর ঘট। প্রতি দিন পুজোর পর রঘুনাথ জিউকে তাঁর মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পর দিন সকালে পুজো শুরুর আগে ফের তাঁকে নিয়ে আসা হয় ঠাকুরদালানে।
সপ্তমীর সকালে সমুদ্রের জলে দেবীকে স্নান করিয়ে নিম কাঠি পুজো করা হয়। তার পর সেই কাঠি দিয়ে দেবীর দাঁতন হয়। এই বাড়িতে পশুবলি হয় এখনও। সপ্তমীর দিন একটি পাঁঠা, অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে আর একটি পাঁঠা নবমীর দিন পাঁচটি পাঁঠা এবং একটা ভেড়া বলি হয়। বলির সময় রঘুনাথ জিউকে ভাল করে কাপড় মুড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে তিনি বলি দেখতে না পান। বাকসার অন্যান্য পুজোর বাড়ির মতো মিত্রবাড়ি থেকেও প্রথমে পুজো যায় বদ্যিমাতা এবং বিশালাক্ষ্মী মাতার মন্দিরে। বদ্যিমাতার মন্দিরে নবমীর দিন নৈবেদ্যর সঙ্গে পাঠানো হয় একটি পাঁঠা। সেখানে পাঁঠা বলির পর মিত্রবাড়িতে বলি হয়। পাঁচকড়াই, মেওয়া, কাজু, কিসমিস, নানা রকম ফল, একশোটি নারকেল নাড়ু এবং লুচিভোগ দেওয়া হয় ঠাকুরকে। এ ছাড়াও প্রতি দিন একটি আঁশযুক্ত মাছ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: আন্দুল দত্তচৌধুরী বাড়ির পুজোয় কুমারীকেও হাতে পরতে হয় শাঁখা
বিসর্জনের সময় ঠাকুরদালানের সামনে আলপনা দিয়ে সেখানে দেবীকে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়। অন্য দিকে, রঘুনাথ জিউকেও ঠাকুরদালানের দিকে মুখ করে রঘুনাথ মন্দিরের সামনের রোয়াকে নিয়ে বসেন পুরোহিত। রঘুনাথ জিউয়ের সামনে চলে বরণ এবং সিদুঁরখেলা। বিদায়ের সময় কনকাঞ্জলি দেওয়া হয়। রুপোর রেকাবিতে পানসুপারি, সেদ্ধ চাল কনকাঞ্জলির জন্য সাজিয়ে দেওয়া হয় দেবীকে। প্রতিমাকে সরস্বতী নদীতে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়ার আগে রঘুনাথ মন্দিরের সামনে নিয়ে আসেন বাহকোরা। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় নদীতে। ঘাটে পৌঁছে দেবীর এবং লক্ষ্মী-সরস্বতীর পোশাক খুলিয়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরানো হয়। কার্তিক গণেশেরও গরদের পোশাক খুলিয়ে সুতির পোশাক পরানো হয়। এর পর বিসর্জন দেওয়া হয় দেবীকে। বাড়ি ফিরে রঘুনাথ মন্দির থেকে চরণামৃত নিয়ে দুর্গাদালানে যান সবাই। সেখান থেকে নবঘটের জল নিয়ে বাড়িতে গিয়ে পূর্বপুরুষের ছবির সামনে কলাপাতায় আলতা দিয়ে লেখেন ‘শ্রী শ্রী দুর্গামাতা সহায়!!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy