এক দিন বিকেল মায়াবি হলুদ রঙের হয়ে ওঠে। হাওয়ায় ভেসে আসে ছুটির পরোয়ানা। আমরা টের পাই, পুজো আসছে।
আসলে পুজো নিয়ে এত কথা বলে ফেলেছি, নতুন কী লিখতে পারব জানা নেই। কিন্তু লিখতে বসা তো এক ধরনের আত্ম-আবিষ্কার। শেষ লাইনটা লিখে কলম তুলে নেওয়ার আগে পর্যন্ত নিজেই জানা যায় না, অনেক কথার ফাঁকে কোন কথাটা বাকি থেকে গিয়েছে। সেই আশাতেই কলম বাগিয়ে বসা। এই সময়ে দিন ছোট হয়ে আসে, গোধূলিকে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্সের অবকাশ না দিয়েই বিনা নোটিসে সন্ধে নেমে আসে। খেলতে গিয়ে বল হারায় ঘন ঘন। বাড়ি থেকে ছ'টা অবধি অনুমতি থাকলেও সূর্যের তাড়াহুড়োয় খেলা গুটোতে হয় সাড়ে পাঁচটায়। কিন্তু এরই মধ্যে এক দিন বিকেল মায়াবি হলুদ রঙের হয়ে ওঠে। হাওয়ায় ভেসে আসে ছুটির পরোয়ানা। আমরা টের পাই, পুজো আসছে। আসলে আমার পুজোর সঙ্গে তালের বড়ার আশ্চর্য সম্পর্ক আছে। কারণ আমার সেজপিসির বাড়িতে জন্মাষ্টমী খুব বড় করে হত। আমরা সবাই যেতাম। দুপুরের ঘুম ভাঙত তালের বড়ার মিষ্টি গন্ধে। আর কানে মধুবর্ষণের মত লাগত মা আর সেজপিসির পুজোর বাজারের আলোচনা। যেখানে ল্যাংবোট হিসেবে অবশ্যই থাকব আমি। যাব কোথায়? যে সে জায়গায় নয় বাবা! শ্রীরাম আর্কেড। ওখানে লিফট থেকে বাইরে দেখা যায়। এলেবেলে বাজার নয়। আমার তখন মনে হত, কলকাতার যাবতীয় ঐশ্বর্য শ্রীরাম আর্কেডেই রাখা। তার সঙ্গে আমার সেজপিসির অনবদ্য হিন্দিতে দরদাম “ক্যা বোলতা? ৫০০ কা জিন্স? এ তো দুশো মে মিলতা।” মা আর পিসির ধুয়াধার হিন্দির পর দোকানদারদের মুখ দেখে আমার খুব মায়া লাগত। ওই হিন্দির অভিঘাত সহ্য না করতে পেরেই সম্ভবত দোকানদার দরদামে গোহারান হেরে যেতেন।
এই রকম করে করে পুজোর সময় এগিয়ে আসত। নাটকের দলে মহালয়ার রাতের খাওয়াদাওয়া, স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন পেরিয়ে যে দিন ভ্যান থেকে নেমে দেখতাম বাড়ির ছাদ পাড়ার পুজো কমিটি থেকে বাল্ব দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে, বুঝতাম আর দেরি নেই। এবং অবশ্যই পূজাবার্ষিকী। আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী বাবা কিনে দিত। বাকি পূজাবার্ষিকীগুলোর কার ভাগে কী পড়বে, তা ঠিক হত লাইব্রেরির লটারিতে। ও আরেকটা কথা বলা হয় নি, জামা কাপড় যে যা দিত দিত, জুতোটা সব সময়ে বাবাই দিত। সেই দিনটা একটা উৎসব ছিল আমাদের। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে বাবার অফিসে যেতাম টিফিন টাইমে। বাবা আমাদের নিয়ে বেরত ওই পড়ার স্পেশাল খাবার খাওয়াতে। এক এক বছর এক একটা। কোনও বছর ফালুদা-কুলফি, কোনও বছর পাওভাজি, কোনও বছর রোজ় মিল্ক। ছোট ছোট আনন্দ ছিল আমাদের, কিন্তু আজীবনের স্মৃতি। তারপর খবরের কাগজে বেরনো পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন থেকে মডেল মুখস্থ করে দোকানে গিয়ে বসা, এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দৃশ্যটির সাক্ষী হওয়া। আমি সত্যি বলছি, জুতোর দোকানে দোতলার উদ্দেশ্যে পায়ের সাইজ আর মডেল বলা এবং উপর থেকে উড়ন্ত বাক্সে জুতোর আগমন, এবং নিপুণ দক্ষতায় সেই ক্যাচ ধরা, এর থেকে চমকপ্রদ দৃশ্য আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। আমি বড় হয়ে যা যা হতে চেয়েছি, তার মধ্যে জুতোর দোকানের কর্মচারী অন্যতম।
দেখুন, সব বয়সের পুজো আলাদা। ক্যাপ শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখ বদলে যায় ‘ও আমার দিকে তাকালো না কেন’-তে। কাজেই পুজোর কোনও বয়স নির্বিশেষে সারসংক্ষেপ হয় না। কিন্তু কিছু জিনিস থাকে, যাদের কোনও পরিবর্তন হয়নি বহু পুজোয়। যেমন দীপকাকুর অটো ভাড়া করে ঘুরতে যাওয়া। পুজোয় আর যে ঠাকুর দেখি না কেন, একডালিয়া এবং পার্ক সার্কাস ময়দানের ঠাকুর দেখতে বাবা নিয়ে যেতই। কারণ এই দু’জায়গায় প্রতিমা গড়তেন রমেশ পাল। বাবা আমাদের দাঁড় করিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন কেন রমেশ পালের প্রতিমা সবার থেকে আলাদা। আর সত্যি এত তো থিমের ঠাকুর থেকে শুরু করে অনেক কিছু দেখেছি, ওই রকম চোখ আর দেখলাম না।
ম্যাডক্স স্কোয়ারে গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যেত। ওখানে দুর্গার গলায় সত্যিকারের সোনার গয়না, তাই সব সময় পুলিশ পোস্টিং। ওখানকার সুন্দরীদের দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকাই সার হত। কেউ ভুলেও পাত্তা দিত না। আমরা খবরের কাগজ পেতে ভারতমতার মাঠে বসতাম। ম্যাডক্স থেকে রোজগার করা হীনন্মন্যতা মুহূর্তে কোথায় মিলিয়ে যেত। লাল শালুতে মোড়া কলসিতে বিক্রি হত ভাং কুলফি। তাই খেয়ে আমার এক বন্ধুর সারারাত সে কী কান্না “সব উইড়্যা যাইতাসে, ওই দ্যাখ প্যান্ডেল উইড়্যা গ্যালো” বলে কেঁদেই চলেছে বিজয়গড় মাঠের রেলিং আকঁড়ে। রেলিং ছাড়লে সেও উড়ে যাবে এই ভয়ে।
পৃথিবীর কম জায়গা তো ঘুরলাম না, দেশ বিদেশের খাবারও কম চাখিনি এই জীবনে। কিন্তু পুজোর অস্থায়ী স্টলের এগরোলের যে প্রাণকাড়া গন্ধ, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে খুব কম জিনিসই। এই এত সব আনন্দের মধ্যে দশমী কখন যে হুট করে চলে আসত, টের পেতাম না। হঠাৎ ভারতমাতার প্যান্ডেল ফাঁকা হয়ে যেত। ইতিউতি উড়ত ছেঁড়া খবরের কাগজ। যে গুলো আগের দিন অবধি ভর্তি মাঠে জায়গা রাখার জন্য ছিল মহার্ঘ্য বস্তু তারা মৃত সৈনিকের মতো মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে থাকত। হঠাৎ টের পেতাম, শিশির পড়া বেড়ে গিয়েছে রাতে। সিগারেটের ধোঁয়ায় মিশিয়ে দিতাম এক বছরের অপেক্ষা। এই রকম করতে করতে কবে যেন খ্যাতনামী হয়ে গেলাম। এখন বিচারক সেজে শহরের শ্রেষ্ঠ পুজো বাছতে বেরই। বডিগার্ড, নিরাপত্তারক্ষী, সুরক্ষা বলয় এই সব ভেদ করে মাইকে একটা গোল ভেসে আসে “বিজয়গড় থেকে আসা বাবিন, তুমি সেলিব্রিটির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছ। তোমার জন্য তোমার শৈশব অপেক্ষা করছে। মেলার কার্যালয়ে যোগাযোগ করো।” আমি ভুলেও ওই ঘোষণায় কান দিই না। সবার মুখোমুখি হতে নেই। গম্ভীর মুখ করে বিচারক রাহুল পা চালায়, যত জোরে সম্ভব। যত দূর গেলে ওই ঘোষণা আর শোনা যাবে না, তত দূর চলে যেতে চাই। কারণ আমি জানি বিজয়গড় থেকে আসা বাবিন, সে আজকের রাহুলকে পাত্তা দেয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy