এই বছরটাও হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে পুজো করাই ভাল। তখন এ বছরেই বলতে পারবেন, ‘আসছে বছর অবশ্যই আগের মতো করে আবার পুজো হবে।'
পুজোর গল্প বলার আগে সতর্কীকরণ বার্তা। অতিমারি কম, কিন্তু একেবারে চলে যায়নি। সংযত হওয়ার সময়ও তাই চলে যায়নি। ফলে, এই বছরটাও হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে পুজো করাই ভাল। যত ভিড় কম হবে, তত সংক্রমণ কম ছড়াবে। যত সংক্রমণ কম ছড়াবে, ততই পৃথিবী সুস্থ হবে। তখন এ বছরেই সবাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারবেন, ‘আসছে বছর অবশ্যই আগের মতো করে আবার পুজো হবে।'
এ বার আসি পুজোর গল্পে। আমি দু’দেশের পুজো দেখেছি। অবিভক্ত বাংলা আর দেশভাগের পর ভারতবর্ষের। আমার জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। তখন ওপার বাংলায় বারোয়ারি পুজো বড় একটা হত না। জমিদার বাড়ি এবং সাধারণের বাড়িতেই বেশির ভাগ পুজো হত। আর দুটো বাড়ির মধ্যের দূরত্ব থাকত কয়েক মাইল। কলকাতার মতো গায়ে গায়ে পুজো তো ছিল না। এক পুজোর ঢাকের বাদ্যি আর এক পুজো প্যান্ডেল পর্যন্ত পৌঁছতই না। বিদ্যুতের আলো নেই। থিম পুজো নেই। ডাকের সাজের একচালার প্রতিমা। হ্যাজাকের আলো। সব প্রতিমাই প্রায় এক ধরনের। তাই দেখতাম ঘুরে ঘুরে। তবে পূর্ববঙ্গের পুজোয় আন্তরিকতা ছিল। সবাই একসঙ্গে মিলে হাতে হাত লাগিয়ে পুজোর কাজ করতেন। ঘর সাজানো থেকে প্রতিমা সাজানো, পুজোর কাজ-- সব কিছুই। রঙিন কাগজের শিকল তৈরি দালান সাজানো হত। মণ্ডপের বাঁশ বাঁধতেন পরিবারের সদস্যরাই। আমাদের বাড়িতেও পুজো হত। বাড়ির ছেলেদের মতো মেয়েরাও প্রচণ্ড খাটতেন ক’দিন।
আর আমরা ছোটরা? আনন্দ-হুল্লোড় তো ছিলই। আর ছিল এক ছিটের জামা। ছেলেদের, মেয়েদের পুজো স্টাইল বা ফ্যাশন বলতে কিচ্ছু নেই! ছেলেদের সবার এক রকমের পোশাক। একটি হাফপ্যান্ট। তাই পরেই গোটা পুজো শেষ! বাবা নতুন জুতো কিনে দিতেন। তখনকার দিনের বিখ্যাত ‘নটি বয় শ্যু’। ওই এক জোড়া জুতো দিয়েই বছর দেড়েক হেসেখেলে চলে যেত। আমি বড় হয়ে যেতাম। জুতো ছোট হয়ে যেত। তবু ছিঁড়ত না! তা ছাড়া, পুজোয় জুতো পায়ে পথ হাঁটতাম নাকি! খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখতাম আমরা।
শরৎকালে মা দুগ্গার মতো বাংলাদেশের প্রকৃতিও অপরূপা। ঝকঝকে নীল আকাশ। তার নীচে সাদা কাশফুল। নদী ঘেরা দেশে হরেক ফুলের মেলা। শিউলি, পদ্ম। গাছে ফোটা ফুল দিয়েই সেজে উঠতেন মা। সাজত পুজোবাড়ির দরদালান। রাতে জোৎস্নার আলোয় স্নান করে উঠত চারপাশ। প্রকৃতির ওই রূপ বলে বোঝানোর নয়। তবে এত যে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখতাম, প্রসাদ পেতাম চাল-কলা মাখা, বাতাসা, ফল। কোনও বাড়িতে পাত পেড়ে বসে ভোগের খিচুড়ি খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বরং এখন পুজো মণ্ডপে দেখি ভূরিভোজের ঢালাও আয়োজন।
দেশ ভাগ হল। আমরা এ দেশে চলে এলাম। দেশের বাড়ির দুর্গাপুজোও বন্ধ হয়ে গেল। পুরো অন্য রকম ব্যাপার। এসে দেখি শহরের পুজোয় কী ভিড়! ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। প্রচুর লোকের ঢল রাজপথে। নিজেকে সামলানোই দায়। তাও শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে ঘুরে অনেক ঠাকুর দেখে ফেলতাম। তখন বয়সটাও কম। তবু প্রেম আসেনি পুজোর হাত ধরে। তার কারণও ছিল। আমি বড্ড মুখচোরা। দু’চোখ ভরে যত দেখতে পারি, মুখে বলতে পারি কম। এমনও হয়েছে কত বার, ভাল লেগেছে কাউকে। বলতেই পারিনি! পুরোটাই একতরফা হয়ে থেকে গিয়েছে। তাই প্রেম যখন এসেছে, তাকে আঁকড়ে ধরেই থেকেছি। খাতায়-কলমে জীবনে মাত্র একটি প্রেম আমার। যিনি প্রেমিকা তিনিই স্ত্রী। বহু বছর এক সঙ্গে কাটিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন আমার ঘরনি। তাই পুজোপ্রেম নিয়ে আমার কিচ্ছু বলার নেই।
এ ভাবেই আস্তে আস্তে বয়স বাড়ল। সংসারী হলাম। তখন এই ভিড়টাকেই ভয় পেতে আরম্ভ করলাম। ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেশি লোকজনের মধ্যে যেতামই না। আশপাশের ঠাকুর দেখিয়ে বাড়ি চলে আসতাম। যদি ছেলেপুলে হারিয়ে যায়! বহু বছর এমনও গিয়েছে, ঠাকুর দেখতেই বার হইনি। লিখতে লিখতে কখন যেন সকাল-সন্ধে কেটে গিয়েছে, টের পাইনি। যে বছর থেকে আমায় পুজোর বিচারক হিসেবে বেছে নেওয়া হল, সে বছর থেকে আমি কলকাতার থিম পুজোর প্রেমে পড়ে গেলাম।
বাঙালির দুর্গাপুজোয় বরাবরই আধ্যাত্মিকতা কম। সামাজিকতা, উন্মাদনা বেশি। থিম পুজো সেখানে ধর্ম আর শিল্পের মধ্যে যেন মেলবন্ধন ঘটাল। আর্ট কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া শিল্পীরা মণ্ডপ গড়ছেন। পুজোর আবহে সৃজনশীলতা যেন নতুন করে জন্ম নিচ্ছে। মণ্ডপ ভাঙা হয়ে গেলে খুব দুঃখ হত। মনে হত, এত কষ্টে তৈরি একেকটা শিল্প এ ভাবে ভেঙে ফেলা হবে! কোনও ভাবে এগুলোকে রাখা যায় না! অনেকেরই থিম পুজো ভাল লাগে না। আমার কিন্তু বেশ লাগে।
কর্মসূত্রে আরও একটা পুজো দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। লেখকদের পুজো। এখন একটি পুজো শেষ হয়ে গেলেই বছরশেষে পরের পুজোর লেখা জমা দেওয়ার সময় এসে যায়। শুধু এই নিয়ম আমার বেলাতেই খাটে না। আমি অতি অলস। সবার থেকে দেরি করে লেখা জমা দিই। সবাই সেটুকু মানিয়ে নিয়ে বাড়তি সময় দেন, অপেক্ষা করেন আমার জন্য। আমাদের মতো লেখকদের পুজোয় তাই ‘আসছে বছর’ বলার সুযোগ নেই। সেই বছরেই পরের বছরের পুজো এগিয়ে আসে, আমাদের পুজোর এটাই মজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy