প্রতীকী চিত্র
“একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা। ”
অর্থাৎ এ জগতে একমাত্র আমিই তো আছি, আমা হইতে অপর দ্বিতীয় আর কে আছে? স্বয়ং দেবী এই কথাটি বলছেন অর্থাৎ তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। অথচ আজ পরিসংখ্যান বলে এই মায়েদের মধ্যেই ৩২ শতাংশ প্রতিদিন নিজের সংসারেই অত্যাচার ও লাঞ্ছনার শিকার হন!
কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছনা, প্রেমিকের দ্বারা প্রতারণা, গৃহ লাঞ্ছনা, হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেজ দ্বারা লাঞ্ছনা, টিজিং প্রভৃতির খতিয়ান দিলে সম্ভবত খবরের কাগজের এক দিনের সব কয়টি পাতাও কম বলে মনে হবে।
আশ্চর্য, ধর্ষণ ও নারী অবমাননা পূর্ণ সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে, আমরা বারংবার নারীর অধিকার অর্জনের কথা বলি। অথচ এই সমাজে নারীর অধিকার সর্বাগ্রে এবং তারা চিরকালই ছিল এবং এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরাই নানা ভাবে নারীর বিক্ষেপ ঘটিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছি। তাই নারীর অধিকার অর্জন নয়, লুন্ঠিত অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়া উচিৎ শব্দটা।
প্রাচীন যুগ হতে কিছু আদর্শ তুলে ধরা যাক,
"ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।" (অথর্ববেদ ১১.৫.১৮)
অথর্ব বেদ বলছে, ঠিক যেমন যুবক ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে, ঠিক তেমনি এক জন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে পছন্দমতো বিদ্বান যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে।
"চেতন্তি সুমতিনাম যজ্ঞম দধে সরস্বতী" (ঋগ্বেদ ১.৩.১১) নারী শিক্ষিকাকে জ্ঞান ও প্রেরণার আধার রূপে স্তুতি করা হচ্ছে।
"ছাস্যাদযঃ ছাত্রীশালাযাম্" (পাণিনি ৬.২.৮৬)
ছাত্রীদের জন্যে আলাদা ছাত্রীশালা বা হোস্টেলের ব্যবস্থাও ছিল। তা হলে বুঝতে পারছেন, সে যুগে এই লিঙ্গসমতা পূর্ণরূপে বহাল ছিল। দু'জনেই পড়াশোনা করার সমান সুযোগ পেত। কর্ম হতে স্বামী নির্বাচনেরও স্বাধীনতা ছিল। নারী জেনেবুঝে যাচাই করে নিতে পারত।
হরিৎ ধর্মসূত্র, গোভিল গৃহ্যসূত্র নারীর উপনয়ন অর্থাৎ পৈতে হচ্ছে। সে স্বামীর সঙ্গে বসে যজ্ঞে অংশগ্রহণ করছে। ঋকবেদে বিশ্ববারা নাম নিয়ে এক নারীকে পূর্বমুখী হয়ে বসে বেদমন্ত্র পাঠপূর্বক করতেও আমরা দেখি। আজও তামিলনাড়ুর বৃহদিশ্বর শিবমন্দিরে দেবী সরস্বতীর আদলে গড়া উপবীতধারিণী নারীমূর্তি দেখা যায়, যা প্রায় ১০০০ বছরের পুরাতন।
মহাভারতের ব্রহ্মবাদিনী তিনি সুলভা এতই জ্ঞানী ছিলেন যে, তাঁর সুযোগ্য কোনও স্বামী পাওয়া গেল না। তিনি অনূঢ়া রইলেন। সেখানে নারী নিজেকে রক্ষা করতে অস্ত্র ধারণ করতে পারে। দেবতারা তার কাছে অস্ত্র ধারণের জন্য প্রার্থনাও করতেন। অর্থাৎ নারী অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ও সুনিপুণা হত। তবেই না সে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারত! সে ক্ষেত্রে সংসার ও পালন তার নারীসুলভ মমত্বের প্রকাশ, একান্তই নিজের পছন্দ।
মধ্যযুগ এল। এক বর্বর সময় এসে উপস্থিত হল, যে সময়ে পুরুষ ক্রমাগতই নারীকে শাসন ও শোষণ করার জন্য তাকে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করতে লাগল। এতে সুবিধা করে দিল আমাদের পুরাতন স্মৃতিশাস্ত্র, যেহেতু সবই স্মৃতি অর্থাৎ শুনে শুনে মনে রাখা হতো। তাই নিজের ইচ্ছামতো বিক্ষেপ ঘটানো সম্ভব হল। যে কথাগুলি গভীর অর্থবহ ছিল, তাকে লঘু করে ফেলা হল।
অপেক্ষাকৃত নবীন মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে, নারী হল শস্যক্ষেত্র এবং পুরুষ হল বীজ। বৃক্ষ যেহেতু বীজের বৈশিষ্ট্য পায়, তাই বীজদাতাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু কথা হল বীজ অনুযায়ী বৃক্ষ হলেও ক্ষেত্র যদি সহায়তা না করে, অনুকূল পরিবেশ না দেয়, সে বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমটুকুও হয় না। কিন্তু এই প্রসঙ্গটা অনুচ্চারিত রয়ে গেল। পুরুষ সমাজের মাথা হয়ে বসল। আশ্চর্য ভাবে, বীজদাতা পুরুষ হলেও কন্যাসন্তান বা পুত্রসন্তান জন্মের জন্য দায়ী করা হলো নারীকে। নিজের কথার নিজেরাই দ্বিমত করতে থাকল তারা। এইভাবে বারংবার বিকৃত হতে থাকল নারীর অধিকার এবং তার প্রতিষ্ঠা। তারই প্রমাণ স্বরূপ আমরা দেখতে পাই, সতীর জন্য শিব দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করছেন, মা দুর্গা নিজ হাতে অস্ত্র তুলছেন, শান্তশিষ্ট মা লক্ষ্মী নিজে ভয়ঙ্করী রূপ ধারণ করছেন। অথচ সময় যখন পেরিয়ে আসছে, তখন সীতা লাঞ্ছিতা হচ্ছেন রাবণের দ্বারা। দ্রৌপদী লাঞ্ছিতা হচ্ছেন ভরা সভায়, তাঁকে প্রতিশোধের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে পুরুষের উপরে।
দুর্গাপূজা, কালীপূজা আদতে নারীর আজন্মকালের এই অধিকারকেই সূচিত করে। দেবী স্তুতি বা মন্ত্র প্রতিবছরের বার্ষিক পরীক্ষার মতো সেই কথাকেই স্মরণ করায়, যে 'লেডিজ ফার্স্ট' লব্জটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে সমান হও। নারী তোমার অধিকার লুণ্ঠিত, তাকে কেড়ে নাও। তোমার ভিতর দিয়েই আমার জাগরণ হোক।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy