প্রতীকী চিত্র
উৎসবের মরসুম শুরু হতেই শহর থেকে শহরতলি ঢেকে যায় আলোর চাদরে– সে হিন্দুদের উৎসব হোক বা অন্য সম্প্রদায়ের। আর আলোর কারুকাজের কথা মাথায় এলে সবার আগে মনে পড়ে চন্দননগরের কথা। আজও বহু ক্লাবই পুজোর আগে ঠিক করে ফেলে, চন্দননগর থেকে আলো নিয়ে এসে মানুষকে চমকে দেবে!
আসলে সত্যিই তাই। চন্দননগরের আলোর যে জগৎ জোড়া খ্যাতি! অবাক করা সব আলোর কারুকার্য, যা দেখলে সত্যি অবাক হতে হয়। বর্তমানে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো আর আলো এই শহরকে সমগ্র বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। এক সময়ের ফরাসি উপনিবেশ গোটা বিশ্বের কাছে আজ হয়ে উঠেছে ‘আলোর শহর’। কিন্তু চন্দননগরের এই আলোর নেপথ্যে আছে এক বড় ইতিহাস, যা অনেকের কাছেই অজানা। আর এই ইতিহাস জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে তৎকালীন জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রার ইতিহাস সম্পর্কে। কারণ চন্দননগরের আলোর শহর হিসেবে তকমা পাওয়ার নেপথ্যে জগদ্ধাত্রী পুজোর এক বিরাট ভূমিকা।
বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল আনুমানিক ১৮ শতকের মাঝেমাঝি সময়ে। কথিত, ১৮৫৪ সালে প্রথম রেলপথ চালু হলে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ পুজো দেখতে ও প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা দেখতে এখানে ভিড় জমাতেন। আর এই বছর থেকেই আস্তে আস্তে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখার ভিড় জমতে শুরু করে। এমনকি পুজোর জৌলুসও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে পুজোর সংখ্যাও। পুজো কমিটির সংখ্যাবৃদ্ধি, জনজোয়ার– সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু গোল বাধে প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়ে। এই জনজোয়ার আর অসংখ্য ঠাকুর নিয়ে পুজো কমিটি গুলি মহা সমস্যায় পড়তে শুরু করেন। কারণ সেই সময়ে চন্দননগরে ছিল না বৈদ্যুতিক আলো। কাজেই নিরঞ্জনের সময়ে স্বল্প আলোয় নানা দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করে। আর সেই থেকেই সবাই অনুভব করেন আলোর প্রয়োজনীয়তা।
শুনলে অবাক হবেন, আলোর ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রথমে অনেকগুলি পিতলের বড় গামলায় ঘুঁটে জ্বালিয়ে প্রতিমার সামনে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হত, যাতে ঘুঁটের আলোয় আলোকিত হয় সেই স্থান। তবে সেই আলো প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই কম। তাই এর পর বাঁশের মাথায় কাপড় জড়িয়ে কেরোসিনে ভিজিয়ে মশাল তৈরি করে প্রতিমা নিরঞ্জন শুরু হল। বেশি ক্ষণ কার্যকর হত না এই মশালও। পরবর্তীতে তাই সমস্যা সমাধানে এল হ্যাজাক, যার আলো অনেকটাই কার্যকরী হয়েছিল এবং যথেষ্ট উজ্জ্বলও ছিল। এই হ্যাজাক বাহকদের সুদূর ওড়িশা থেকে নিয়ে আসা হত।
এর অনেক বছর পরে ১৯৩৪ সালে প্রথম চন্দননগরে বিদ্যুৎ আসে। আর তার ৪ বছর পরেই প্রথম শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পুজোয় আলোর ব্যবহার। মণ্ডপে মণ্ডপে বসানো হয় বৈদ্যুতিক আলো। স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় ব্যবহৃত হতে শুরু করল টিউব লাইট। এর পরে আস্তে আস্তে নানা রকমের আলোর ব্যবহার শুরু হল চন্দনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয়।
আজ চন্দনগরের আলো যে বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ, তার নেপথ্যে আছেন আলোকশিল্পী শ্রীধর দাস। এই হাতে তৈরি আলো অবাক করেছিল সমগ্র ভারতকে তথা বিশ্বকে। তাঁর হাতে বানানো সব আলো ব্যবহৃত হতে শুরু করে মস্কো, ব্রিটেন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ইতালি জুড়ে। এমনকি হাওড়া ব্রিজ থেকে শুরু করে আইফেল টাওয়ারেও।
শ্রীধর দাসের শৈশব থেকেই আলোর প্রতি ছিল এক নেশা। চন্দননগরে তিনি প্রথম টর্চের ল্যাম্প থেকে তৈরি করেছিলেন ৬.২ টুনি বাল্বের আলো। সেই বছর কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে জলের নীচে আলোকসজ্জায় তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। এর পরে ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি আলোর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। তিনিই প্রথম তৈরি করেন আলোর বোর্ড, আলোর গাছ, আলোর গেট ইত্যাদি, যা মানুষ দেখত আর অবাক হত। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত কারণে নিজের হাতে আর আলো তৈরি না করলেও পরামর্শদাতা হিসাবে ডাক আসে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থাকে। চন্দনগরের আলোর প্রসঙ্গ এলেই যাঁর নাম সবার সামনে আসে, তিনি একমাত্র শ্রীধর দাস।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy