Mental Health

মনোরোগের সঙ্গে যুদ্ধ পেরিয়ে কাজে ফিরেছেন ‘প্রত্যয়ী’রা, কেউ এখন নার্স, কেউ অঙ্কের স্যর

সুস্থ হয়ে ওঠা মনোরোগীদের মূলস্রোতে ফেরাতে গত জুলাইয়ে ‘প্রত্যয়’-এর উদ্বোধন হয়। ২৩ জন আবাসিক থাকতে শুরু করেন সেখানে। তাঁদেরই পাঁচ জন ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:৫৭
Share:

বছর শেষ হওয়ার আগেই নতুন জীবনে পা রাখলেন ‘প্রত্যয়’-এর কয়েক জন আবাসিক। নিজস্ব চিত্র।

আগের সময়টা কঠিন ছিল। মানসিক রোগের সঙ্গে লড়াই তো ছিলই, সঙ্গে লড়তে হয়েছে সমাজের নানা ভাবনার সঙ্গে। দূরে সরিয়ে দিয়েছে সমাজ। মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন আপনজনেরাই। তবু মূল স্রোতে ফেরার চেষ্টা চলেছে নিরন্তর। ২০২২ সাল সে সব পুরনো প্রভাবে ভরা জীবনে নতুন সমীকরণ তৈরি করল। বছর শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের কয়েক জন পা রাখলেন নতুন জীবনে।

Advertisement

যে সকল মানসিক রোগী সুস্থ হয়েও ঘরে ফিরতে পারেননি, তাঁদের মূল স্রোতে ফেরানোর জন্য করা হয়েছে পদক্ষেপ। তৈরি হয়েছে ‘প্রত্যয়’। মানসিক হাসপাতাল ছেড়ে বন্ডেল গেট অঞ্চলের নতুন ঠিকানায় থাকতে শুরু করেছেন মানসিক রোগের সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের পর সুস্থ হয়ে ওঠা কেউ কেউ। যেমন ওষুধ চলছিল, তেমনই চলছে। কিন্তু তার সঙ্গে নতুন করে স্বাধীন ভাবে জীবন গড়ার প্রস্তুতি হচ্ছে। রোজের জীবনের খুঁটিনাটি কাজ নিজে করে নেওয়ার অভ্যাসও করা হচ্ছে। আবার চলছে আয়ের ব্যবস্থা খোঁজার চেষ্টা। যে যেমন কাজ পারেন, তার ভিত্তিতেই করতে হবে চাকরির সন্ধান। এবং কাজ পেয়েও গেলেন পাঁচ জন! তা দেখে মনোবল বাড়ল বাকিদের।

গত জুলাই মাসে ‘প্রত্যয়’-এর উদ্বোধন হওয়ার পরপরই ২৩ জন আবাসিক থাকতে শুরু করেন সেখানে। তার পর ধীরে ধীরে বাড়ে সংখ্যাটি। ডিসেম্বর শেষের আগে তাঁদেরই মধ্যে পাঁচ জন চাকরি পেয়েছেন। কেউ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন, কেউ আবার হাসপাতালে নার্সের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের অসুস্থতার ইতিহাস লুকিয়ে নয়, সকলকে জানিয়েই পেয়েছেন কাজে যোগ দেওয়ার ডাক। আর মানসিক রোগীদের নিয়ে নিরন্তর চলতে থাকা লড়াইয়ে সেখানেই আলাদা মাত্রা পেল এই বছরটি।

Advertisement

মানসিক রোগে সমাজ যে দূরে সরিয়ে দেয়, তা অজানা নয়। কিন্তু সে রোগ সারার পরেও যে অধিকাংশকে আর আপন করে নিতে চান না পরিজনেরাও! ফলে রোগ সারলেও মন ভেঙে যায় অধিকাংশের। এর পর কী করবেন, তা ভেবেই পান না অনেকে। তেমনই লড়াই লড়ছেন ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকেরা। এক এক জনের লড়াই এক এক রকম। কারও সন্তানের ঠিকানা জানা থাকলেও মুখ দেখার অনুমতি মেলে না, কেউ আবার সাহসই করে উঠতে পারেন না বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার।

কলকাতার ছেলে শৌভিক মুখোপাধ্যায় যেমন অনেকটা সুস্থ হয়েও বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না। এখনও পারেননি। তবে দিনে ব্লক প্রিন্টের কাজ আর সন্ধ্যায় যৌনপল্লির শিশুদের অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ানোর দায়িত্ব পেয়ে অনেকটা বদলে গিয়েছে শৌভিকের জীবন। গত দু’মাস ধরে এ ভাবে কাজ করে অনেকটা মনের জোরও বেড়েছে। নিজের আয় থেকে কিছুটা টাকা বাঁচিয়ে ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছিলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মা-ও একা থাকেন। দেখার কেউ নেই। ঘরে না ফেরালেও ছেলের মন মায়ের জন্য কাঁদে। দু’মাসের টাকা থেকে অল্প অল্প বাঁচিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন শৌভিক। বললেন, ‘‘মায়ের কাজে লাগবে। আমি তো সব সময়ে সঙ্গে থাকি না। একাই তো সব করেন।’’ আর যে-সে উপায়ে তো টাকা আসেনি। শৌভিক যৌনপল্লির শিশুদের পড়াতে পেরে তৃপ্তও। বলেন, ‘‘ওরাও তো আমাদের মতোই ব্রাত্য। ওদের পড়াতে পেরে ভাল লাগছে। আমার লেখাপড়া কাজে লাগছে। আমি কলেজে পড়ার সময়েও টিউশন করতাম। কিন্তু যৌনপল্লির শিশুদের পড়ানোর অভিজ্ঞতা আলাদা।’’

পম্পা গুহের বাড়ি ব্যারাকপুরে। নার্সিংয়ের কোর্স করাই ছিল। তার পর অবশ্য সব ওলটপালট হয়ে যায়। অনেক দিন কাটে মানসিক হাসপাতালে। এ বার তিনি সুস্থ। অন্য রোগীদের সাহায্য করতে চান। তাই দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ নিয়েছেন। দিব্যি চলছে কাজ। মায়ের সঙ্গেই থাকে তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। অনেক দিন কারও সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। বাড়ি যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তবে নতুন কাজ পাওয়ার পর দেখা করে এসেছেন মা আর মেয়ের সঙ্গে। মাকে দেখে খুব খুশি তাঁর মেয়ে।

নতুন কাজে যোগ দিয়েছেন আরও তিন জন। প্রদীপ দাস এখন মধ্য কলকাতার অফিসে যান রোজ বন্ডেল গেট থেকে। বাস-ট্রামে যাতায়াত করতে যেমন ভাল লাগছে, তেমনই ভাল লাগছে চপ-কাটলেট খাওয়ার সুযোগ পেয়ে। বলেন, ‘‘আমার এখন দারুণ লাগছে কাজ করতে। অনেক জায়গায় যাচ্ছি। আজই যেমন কাজের জন্য সাঁতরাগাছি এসেছি।’’ প্রথম মাসের বেতন পেয়ে মোবাইল ফোনও কিনে নিয়েছেন প্রদীপ। সেই ফোন থেকেই কথা বলেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে। রাজু চৌধুরী আর অরিন্দম চৌধুরী কাজ পেয়েছেন নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে। নিজেদের দায়িত্ব তো নিচ্ছেনই, সঙ্গে যে আরও অনেকের সুরক্ষার কথা ভাবছেন তাঁরা, তা দেখে খুশি ‘প্রত্যয়’-এর সকলেই। ‘প্রত্যয়’-এর প্রোজেক্ট ম্যানেজার অভিজিৎ রায় জানান, বেশ কিছু দিন ধরেই চেষ্টা চলছিল বুঝে নেওয়ার, কে কোন কাজ ভাল ভাবে করতে পারেন। সেই মতো আবাসিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াও হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এখনই কাজে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা অনেকেরই হচ্ছে। তবে সকলে একই সময়ে তো কাজে যেতে পারবেন না। কেউ আগে পারবেন, কেউ ক’টা দিন পর প্রস্তুত হবেন। কিন্তু আর কিছু দিনের মধ্যে আরও বেশ কয়েক জন কাজে যোগ দেবেন বলে আমরা আশা করছি।’’

মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকদের নিয়মিত দেখাশোনা করেন। তাঁর সংস্থা ‘অঞ্জলি’র কর্মীরা নানা ভাবে এখানকার আবাসিকদের সাহায্য করেন। রত্নাবলী বলেন, ‘‘মনোসামাজিক প্রতিবন্ধতা নিয়ে অঞ্জলি কাজ করছে প্রায় কুড়ি বছর। রোগভোগের সময়ে বা প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার সময়ে স্বাভাবিক যে দক্ষতাগুলি অনুশীলনের অভাবে হারিয়ে যায়, সেগুলিকে ফের অভ্যাসে ফিরিয়ে আনা, নতুন দক্ষতা তৈরি করা এ রকম কাজগুলি আমরা অঞ্জলির শুরুর সময় থেকেই করি। আরও অনেক সংগঠনই এই কাজগুলি করে।’’ তিনি জানিয়েছেন, এর সঙ্গে শুরু থেকেই অঞ্জলি জোর দিয়েছিল, অধিকারের প্রশ্নে। রত্নাবলীর কথায়, ‘‘মনোসামাজিক প্রতিবন্ধকতা এক জন মানুষের অধিকারকে সীমিত করার কোনও কারণ হতে পারে না। কিন্তু আখচার সেটা হয়। মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষটির চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে অপারগ পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী বা প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার দায়টা গিয়ে পড়ে সেই আক্রান্ত মানুষটির উপরেই। ফলে তাঁর অধিকারকে খর্ব করার একটা যৌক্তিকতা নির্মিত হয়। আর সেটা আমরাই করি, সুস্থতার দাবি নিয়ে চলাফেরা করা, ব্যক্তি, সংঘ বা প্রতিষ্ঠান। প্রত্যয় সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল। এই অধিকারের প্রশ্নটাকে আরও জোরাল ভাবে সামনে নিয়ে আসার। সরকারি বা বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই আপাত ভাবে যে কোনও প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন মানুষকে কাজে নেওয়ার ব্যাপারে লিখিত আইন, নীতি এগুলি সবই আছে। কিন্তু সেগুলি কতটা বাস্তবায়িত হয়, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশও যথেষ্ট। ভাল অভিজ্ঞতা যতগুলি, সেগুলি এখনও ব্যতিক্রমই। কারণ, মনোসামাজিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সামাজিক বোঝাপড়া অনাস্থা, হিংসাত্মক কিছু উদ্বৃত্ত অর্থ জুড়ে নেয়। তাই নিজেদের ভরসাযোগ্যতা, দক্ষতা প্রমাণের দায়ও এই মানুষগুলির উপরেই এসে পড়ে।’’

মানসিক রোগ থেকে সেরে উঠে সেই দক্ষতা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করতে পেরেছেন ‘প্রত্যয়’-এর ওই পাঁচ জন আবাসিক। আর সকলের আশা, আগামী দিনে এই পাঁচ জনের কাজ আরও অনেককে ভরসা দেবে। মনোরোগীদের প্রতি সমাজের আচরণ বদলাতেও সাহায্য করবে। রত্নাবলী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দফতর এবং নারী শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, অঞ্জলির মৌলিক বোঝাপড়াকে হাতেকলমে করে দেখানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য। সরকারি বোঝাপড়ার সঙ্গে সব সময়ে সব ক্ষেত্রে যে মতের মিল হচ্ছে, এমন নয়। কিন্তু প্রথম বার কোনও কাজ করতে গেলে, করে দেখার অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় শিক্ষকের কাজ করে। এ ক্ষেত্রেও সে রকমই হচ্ছে।’’ রত্নাবলী জানিয়েছেন, প্রত্যয়ের পাঁচ জন আবাসিক ইতিমধ্যেই তাঁদের জীবনের এই নতুন পর্যায়ে দু’মাসের কর্মজীবন অতিক্রম করেছেন। দু’জন প্রবেশন থেকে সরাসরি প্রমোশন পেয়েছেন। যে মানুষদের আগলে, আটকে রাখতে হয় বলে বেশির ভাগ সুস্থ মানুষ মনে করেন, তাঁরা অন্যের সুরক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছেন। কোটি টাকার সম্পত্তির সুরক্ষার বন্দোবস্ত করছেন। সেবা-শুশ্রূষার দায় কে নেবে, এই অজুহাতে যাঁরা পরিবার পরিত্যক্ত হন, তাঁরা অন্যের সেবা-শুশ্রূষা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই পাঁচ জনের অভিজ্ঞতা শুরু মাত্র। পরের পাঁচ জনও তৈরি হয়ে আছেন। নতুন বছরে তাঁদের নতুন কর্মজীবন শুরু করবেন। যাঁরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন এবং যাঁরা করবেন, এঁদের প্রত্যেকেই যথাযথ ইন্টারভিউ দিয়ে তবেই কাজ পেয়েছেন। কোনও ব্যক্তিগত পরিচিতির সূত্রে নয়। ‘প্রত্যয়’ প্রকল্পে যোগদানকারীদের আমরা প্রত্যয়ী বলছি। মনোসামাজিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সামাজিক প্রত্যয় এঁরা তৈরি করতে পারবেন কি না, সেটা সময় বলবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement