নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বারাণসী থেকে ভোটেও লড়েছিলেন আতিক আহমেদ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
১৯৬২ সাল। দেশের উত্তর সীমান্তে তখন তীব্র উত্তেজনা। চিনের প্ররোচনা দিন দিন বাড়ছে। কত দিন ধৈর্য ধরবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতের আকাশে, বাতাসে। যুদ্ধ যে অবশ্যম্ভাবী ক্রমশ তা যেন বুঝতে পারছিলেন উত্তরপ্রদেশের ফুলপুরের সাংসদ নেহরুও। এই টানাপড়েন যখন চরমে, সেই বছরেরই ১০ অগাস্ট তৎকালীন ইলাহাবাদের (বর্তমানে প্রয়াগরাজ) পার্শ্ববর্তী কাসারি মাসারি গ্রামের সামান্য টাঙাওয়ালা হাজি ফিরোজ় আহমেদের পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন। নাম দেওয়া হয়, আতিক আহমেদ। যিনি পরবর্তী কালে নেহরুর ফুলপুরের সাংসদ হবেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রয়াগরাজে পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে যে আতিককে ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ’ থেকে গুলি করে খুন করা হল। হত্যাকারীরা আতিককে খুন করার পর স্লোগান দেয়, ‘জয় শ্রীরাম’!
বাবা টাঙা চালাতেন। সেই অর্থে কোনও মতে চলত সংসার। মুসলিম গাদ্দি সম্প্রদায়ের প্রাচীন পেশা গো-পালন। অভাবের বাড়িতে গরু ছিল না। সংসার টানতে হাজি ফিরোজ় আহমেদ টাঙা টানতেন। জীবিকার প্রয়োজনেই হাজি ফিরোজ় পরিবারকে নিয়ে উঠে আসেন ইলাহাবাদের চাকিয়ায়। ছোটবেলা থেকে দারিদ্রকে খুব কাছ থেকে দেখা আতিক একটা জিনিস বুঝে গিয়েছিলেন, অভাবের সংসারে চেকনাই আনতে প্রয়োজন টাকা, প্রচুর টাকা। তাই শুরু থেকেই অঢেল অর্থ উপার্জন করে সংসারে অভাব মেটানো ছিল আতিকের মূল লক্ষ্য। কবে যে সেই লক্ষ্য পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা পেরিয়ে মানুষ খুনে পৌঁছে গেল, তার সুলুকসন্ধান আতিকেরও হয়তো অজানা ছিল। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির পুরনো লোকেরা বলেন, এই চাকিয়াই ক্রমশ হয়ে ওঠে আতিক-আতঙ্কের রাজধানী।
আতিকের বয়স তখন মাত্র ১৭। অপরাধে হাতেখড়ি সেই কাঁচা বয়সেই। তৎকালীন ইলাহাবাদের খুলদাবাদ থানায় আতিকের নামে প্রথম খুনের মামলা নথিভুক্ত হয়। সেই শুরু। তার পর থেকে পুলিশের খাতায় অন্তত একশো বার নাম উঠেছে হাজি ফিরোজ়ের ছেলের। কখনও অভিযোগ অপহরণের, কখনও খুনের, আবার কখনও দলবল নিয়ে ডাকাতির।
এই সময় আতিকের ‘হিম্মতে’ মুগ্ধ হন তৎকালীন ইলাহাবাদের ‘বেতাজ বাদশা’ চাঁদবাবা। আতিক চাঁদবাবার শরণে আসেন। শুরু হয় জুটিতে লুটি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, উত্তরপ্রদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে মাফিয়ারাজের রমরমার সেই শুরু। এরই মধ্যে চাঁদবাবা খুন হয়ে যান। পুরো সাম্রাজ্য হাতে চলে আসে আতিকের। চাকিয়া ছাড়িয়ে গোটা ইলাহাবাদে আতিক-রাজেরও সেই শুরু।
আতিক বুঝতে পারেন, সরাসরি রাজনীতির হাত মাথায় না থাকলে দাপট ধরে রাখা অসম্ভব। অতএব, পুরোদমে রাজনীতিতেও নেমে পড়েন। ১৯৯১ সালে প্রথম বার ভোটে দাঁড়ান ইলাহাবাদ পশ্চিম কেন্দ্র থেকে। তবে নির্দল প্রার্থী হিসাবে। তার পর ১৯৯৩ সালেও নির্দল হিসাবেই জেতেন আতিক। ১৯৯৬ সালে মুলায়মের দল এসপি আতিককে আপন করে নেয়। ইলাহাবাদ পশ্চিম থেকে আবার জেতেন আতিক। তবে এ বার এসপির সাইকেল প্রতীকে। ২০০২ সালেও আতিক এই কেন্দ্র থেকেই জিতেছিলেন। সে বার দল ছিল এনডিএ শরিক আপনা দল।
২০০৪ সালে আসে সেই মুহূর্ত। যখন নেতাজি (মুলায়ম সেই নামেই পরিচিত) আতিককে ফুলপুর থেকে লোকসভা ভোটে লড়ার টিকিট দেন। যে ফুলপুরে এক সময় সাংসদ ছিলেন নেহরু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, জ্ঞানেশ্বর মিশ্ররা। ফুলপুরে জয় আতিককে যেমন বহু দূর বিস্তৃত পরিচিতি এনে দিয়েছিল, তেমনই ফুলপুরে জয়ের পরেই সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যারও সূত্রপাত গ্যাংস্টার থেকে নেতা হওয়া আতিকের জীবনে। ফুলপুরে জয়ের পর আতিক ইলাহাবাদ পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ইস্তফা দেন। উপনির্বাচনে এসপির প্রতীকে দাঁড়ান আতিকের ভাই আশরাফ। উল্টো দিকে মায়াবতীর বিএসপির রাজু পাল। রাজু হারিয়ে দেন আতিকের ভাই আশরাফকে।
রাজনীতির দাবার বোর্ডে মাদারির ব্যালেন্স দেখিয়ে উত্থান আতিকের। — ফাইল ছবি।
কখনও এসপি, আবার কখনও সোনেলালের আপনা দল— নিজের জীবনকে নিষ্কণ্টক রাখতে রাজনীতির দাবার বোর্ডে আগাগোড়া মাদারির ব্যালেন্স দেখিয়ে গিয়েছেন আতিক। শুধু ফুলপুর থেকে জয়ই নয়, আতিকের জীবনে রয়েছে আরও বড় বড় রাজনৈতিক-চমক। ২০১৯ সালে আতিক নির্দল প্রার্থী হিসাবে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে, বারাণসী কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। প্রত্যাশিত ভাবেই জিততে পারেননি, যদিও প্রচারের আলোর কিছুটা কেড়ে নেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘এই অধিবেশন কক্ষে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছি, এই মাফিয়াকে মাটিতে মিশিয়ে দেব।’’ সে কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছিলেন আতিক। তাই পুলিশের গুলিতে ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে অসহায় পিতা আতিকের আকুতি ছিল, ‘‘আমি সত্যিই মাটিতে মিশে গিয়েছি। দয়া করে আমার পরিবারকে আর হেনস্থা করবেন না।’’ শনিবার রাতে সাংবাদিকের ছদ্মবেশে প্রশ্ন করার অছিলায় গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল আতিক ও তাঁর ভাই আশরাফকে। একই সঙ্গে সম্ভবত শেষ হল উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির এক অন্ধকারময় অধ্যায়।