Follow us on

Download the latest Anandabazar app

© 2021 ABP Pvt. Ltd.

Advertisement

২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ই-পেপার

বেড়ানো

Ghats of Kolkata : কলকাতার গঙ্গার ঘাটগুলির পিছনে আছে দারুণ সব গল্প, জেনে বেড়িয়ে আসুন

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:০৫
এ দেশে নদী থাকলে তার ঘাটও থাকে। আর ঘাট থাকলে যে তার নিজের 'কথা' থাকবেই, তা স্বয়ং রবিঠাকুর লিখে গিয়েছেন। নদীমাতৃক এই দেশে ঘাটে ঘাটে সংঘটিত হয় বিস্তর আচার-অনুষ্ঠান। সে কারণে ঘাটগুলির আলাদা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্যও রয়েছে। কলকাতায়, হুগলি নদী তথা গঙ্গার ধারে বিভিন্ন জায়গায় নির্মিত এই ঘাটগুলি ঐতিহ্যপূর্ণ মহানগরীর বিশেষ কিছু অংশ। এদের প্রত্যেকের পিছনেই রয়েছে কাহিনি-কিংবন্তি-ইতিহাস। যে  কোনও অবসরে এই সব ঘাট হয়ে উঠতে পারে আপনার বেড়ানোর জায়গা। তবে ঘুরতে যাওয়ার আগে জেনে রাখা ভাল কলকাতার ঘাট-কাহিনি।

প্রিন্সেপ ঘাটই সম্ভবত বর্তমানে  কলকাতা শহরের উপর গঙ্গার সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘাট, অন্তত নতুন প্রজন্মের কাছে। এই ঘাটের পাশের সাদা স্মৃতিস্তম্ভটি দেখা গেছে বিভিন্ন চলচ্চিত্রেও। এটি তৈরি হয় জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। তিনি ১৮১৯ সালে কলকাতা টাকশালের সহকারী ধাতু পরীক্ষক হিসাবে কলকাতায় আসেন। এ ছাড়াও তিনি একজন পণ্ডিত, একজন রাসায়নিক বিজ্ঞানী, প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ, শিলালিপি পাঠক এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সচিব ছিলেন। ৪০ বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু হয়।
Advertisement
ডব্লিউ ফিৎজেরাল্ড পরিকল্পিত প্যালাডিয়ান ধাঁচের স্তম্ভটি এই ঘাটের সৌন্দর্য বহু গুণ বৃদ্ধি করেছে। ১৮৪৩ সালে জনসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত করা হয়। তার পর একাধিক বার সংস্কার হয়েছে এই ঘাটের। এই ঘাটটি বিনোদন জগতের বিভিন্ন কাজেকর্মে ব্যবহৃত হয়, আজও। চমৎকার স্মৃতিস্তম্ভটি ছাড়াও, এই স্থানের জনপ্রিয়তার কারণ হল নদীর দৃশ্য এবং পটভূমিতে আলোকিত বিদ্যাসাগর সেতু। নদীর তীর অনুসরণ করে দুপাশে গাছের ছায়ায় হাঁটার পথও তৈরি করা রয়েছে।

আর্মেনীয়রা কলকাতায় বসতি স্থাপনকারী প্রথম দিকের বিদেশী অভিবাসীদের মধ্যে অন্যতম। আর্মেনিয়ান ঘাটটি ১৭৩৪ সালে আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী মানভেল হাজার মালিয়ানের নির্মিত। এই ঘাটটি সুন্দর ভাবে পরিকল্পনা করে তৈরি করা হয়েছিল। তবে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই গঙ্গার ঘাটটি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে ক্রমশ।
Advertisement
১৮৫৪-৭৪ সালে, পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ তাদের কলকাতা স্টেশন এবং টিকিট সংরক্ষণ কক্ষ এই আর্মেনিয়ান ঘাটেই রেখেছিল। এই কাউন্টার থেকে যাত্রীদের ট্রেনের টিকিট কিনতে হত এবং তার পরে হাওড়ার প্ল্যাটফর্ম থেকে তাদের ট্রেনে চড়ার জন্য রেলের মালিকানাধীন স্টিমার বা লঞ্চে গঙ্গা পার হতে হত। ১৮৭৪ সালে হাওড়া সেতুর নির্মাণ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল।

উনিশ শতকের শেষের দিকে নির্মিত আউট্রাম ঘাটটি স্যার জেমস আউট্রামের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। ঔপনিবেশিক যুগে, ঘাটটি থেকে পূর্ববঙ্গ এবং বার্মায় (বর্তমানে মায়ানমার) যাওয়ার জন্য জাহাজ ছাড়ত।

আউট্রাম ঘাটে দুর্গাপূজার সময় প্রতিমা নিরঞ্জন হয় আজও। এছাড়াও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, মিলেনিয়াম পার্ক এবং রেসকোর্সের মতো স্থানগুলি আশপাশেই হওয়ার ফলে এই ঘাটটির গুরুত্ব সহজেই অনুমান করা সম্ভব। এই ঘাট থেকে নদীবক্ষে ভ্রমণের জন্য নৌকা ভাড়াও করতে পারেন।

বাবুঘাট বা বাবু  রাজচন্দ্র ঘাট ১৮৩০ সালে রানি রাসমণির অনুরোধে তাঁর স্বামী জানবাজারের জমিদার বাবু রাজচন্দ্র নির্মাণ করেন এই ঘাট। এটি কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম ঘাট। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই ঘাট নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন। প্রায় দুই শতক পুরনো বাবুঘাটে মিলেমিশে গিয়েছে ব্রিটিশ-কলোনিয়াল ও গ্রিক স্থাপত্যশৈলী। বড়-বড় থামের উপরে ত্রিভুজাকৃতি কাঠামো— এমন ভাবেই তৈরি হয়েছে বাবুঘাটের প্রবেশদ্বার। এই ঘাটে মূল চাতালের কিছুটা পরেই শুরু হয়েছে সিঁড়ি। যা নেমে গিয়েছে গঙ্গার বুকে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ডোরিক-গ্রিক স্থাপত্য যে একদা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল তার প্রমাণ বাবুঘাট। রাজচন্দ্র এই ঘাটের পাশেই একটি কলও বসিয়েছিলেন সেইসময় যেটি দিয়ে এই অঞ্চলের রাস্তা ধোয়া হত গঙ্গার থেকে জল নিয়ে। বাবুঘাট আজ একটি জনাকীর্ণ স্থান, কারণ এখান থেকে হাওড়াগামী লঞ্চ ছাড়ে।

মল্লিক ঘাটটি ১৮৫৫ সালে কলকাতার বাবু নয়নচাঁদ মল্লিকের ছেলে রামমোহন মল্লিক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এত বছরের পুরনো মল্লিক ঘাটে প্রতিদিন ভোরে বসে ফুলের বাজার। সম্ভবত দেশের বৃহত্তম, এবং এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ফুলের বাজার এই ঐতিহাসিক ঘাটে বসে। এটি হাওড়া ব্রিজের ঠিক নীচে অবস্থিত। এই ঘাটের পাইকারি ফুলের বাজারটিই স্থানটিই  প্রধান দ্রষ্টব্য বলে অনেকে মনে করেন।

অনেক জায়গায় এই ঘাটটিকে 'ছোটুলাল ঘাট' হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে এক সময় নাকি একটি চিত্তাকর্ষক চাঁদোয়া সহ একটি বিশাল মণ্ডপ ছিল। যদিও সেই ঘাটের পুরনো গৌরব আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবে ফুলের বাজার এই অঞ্চলটিকে সারাদিন কোলাহলে পরিপূর্ণ রাখে।

হুগলি নদীর ধারে ঘন জঙ্গলে্র মধ্যে একটি নিম গাছের নীচে একাকী কালী মূর্তি, দেবীকে মাথার উপর কেবল একটি খড়ের ছাদ। অনেকেই মনে করেন, এখানেই ছিল প্রাচীনতম নিমতলা শ্মশান। সম্ভবত, এই নিম গাছ থেকে স্থানটির নামকরণ করা হয়। ১৮২৮ সালের মে মাসে, নিমতলা শ্মশানটি ১৬০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৯০ ফুট প্রস্থ সহকারে নির্মিত হয়েছিল, যার তিন দিকে ১৫ ফুট লম্বা দেয়াল ছিল শুধুমাত্র নদীর দিকে খোলা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যপাধ্যায়ের মতো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে এখানে দাহ করা হয়েছিল এবং আজও কলকাতা শহরে মহাশ্মশানের ঘাট হিসেবে নিমতলা ঘাটের কথাই মানুষের মুখে ফেরে। ২০১০ সালে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ১৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এর সংস্কার করে। এই ঘাট সম্পর্কিত নানান আধিভৌতিক কাহিনিও মানুষের মুখে শোনা যায়।