করোনার আঘাত সত্ত্বেও বেজিংয়ের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মেক্সিকোয় বৃষ্টি হলে কি ময়দানে দাঁড়িয়ে মাথার উপর ছাতা খোলেন?
আপাত-নিরীহ এই প্রশ্ন উপেক্ষা করতে পারেন অনেকে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলবেন ভিন্ন কথা। তাঁরা বলতে পারেন, ‘‘হ্যাঁ, উদারীকরণের যুগে মেক্সিকোয় তেমন জোরে বৃষ্টি হলে ময়দানে ছাতা খোলার সম্ভাবনা রয়েছে বইকি।’’
কিন্তু কোভিড-পরবর্তী দুনিয়ায় অর্থনীতিতে উল্টো দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে চলে-যাওয়া বছরটায়। এক যাত্রায় পৃথক ফল ভোগ করছে আমেরিকা এবং চিন। করোনার আক্রমণে বেসামাল আমেরিকা। টলমল করছে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য। কিন্তু যে দেশে প্রথম থাবা বসিয়েছিল করোনা সেই চিনে পরিস্থিতি এখন, ‘অল কোয়ায়েট...’।
প্রযুক্তি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে আমেরিকার আকাশপাতাল ফারাক। ছবি: রয়টার্স।
দুনিয়ার অর্থনীতির রাশ ধরে রাখার শতাব্দী-প্রাচীন ‘অভ্যাস’ কি তা হলে এ বার ভুলতে হবে আমেরিকাকে? সেই ভরকেন্দ্র কি সরে যেতে চলেছে চিনের দিকে? শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসঙ্কটই নয়, জো বাইডেনের আমেরিকার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন দেশের অর্থনীতি। শুধু তা-ই নয়, এসবের মধ্যে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই স্লোগান নীরবে শাসিয়েও যাবে ডেমোক্র্যাটদের। পূর্বাভাসটা প্রথম দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (আইএমএফ)। তারা বলেছিল, খারাপ পরিস্থিতি কাটিয়ে ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে আর্থিক বৃদ্ধি হবে, তার মধ্যে ২৬.৮ শতাংশ অবদান থাকবে চিনের। ২০২৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে ২৭.৭ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু কেন এই উলটপুরাণ? বিশ্ব অর্থনীতির যে স্রোত এতদিন ধরে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর ঘেঁষে বইত, তা করোনা-উত্তর পৃথিবীতে সম্পূর্ণ উল্টো খাতে, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে চিন সাগরে ঢুকে পড়বে কেন?
যত সময় গড়িয়েছে, ততই পরিস্থিতির বদল হয়েছে। ছবি: রয়টার্স।
২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর চিনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনা রোগীর সন্ধান মিলেছিল। তখনও করোনার নাম প্রায় শোনেইনি আমেরিকা। শুনলেও তা আমেরিকানদের তাচ্ছিল্যের কাঁধ-ঝাঁকুনিতে উড়ে গিয়েছে বেমালুম। কিন্তু তার পর যত সময় গড়িয়েছে, ততই পরিস্থিতির বদল হয়েছে। প্রথমে ধীরে। পরে দুর্বার গতিতে। বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে দু’দেশের করোনা-আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা দেখলে। মাঝ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমেরিকায় মোট করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। মৃত্যু ২ লক্ষ ৮৬ হাজারেরও বেশি। পক্ষান্তরে, চিনে এ পর্যন্ত মোট সংক্রমিতের সংখ্যা ৯৩ হাজারের সামান্য বেশি। মৃত্যু ৪ হাজার ৭০০-র কিছু বেশি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, গোটা দুনিয়া যখন অতিমারির বিরুদ্ধে দিশেহারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, ততদিনে সেই যুদ্ধ শেষ করে অন্যদিকে মন দিতে পেরেছে চিন। শি চিনফিং-এর প্রশাসনের এই সাফল্যই এগিয়ে রাখছে চিনকে।
বিশ্ব কূটনীতির ময়দানে আমেরিকা এবং চিনের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। একসময় শুল্ক বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল দু’দেশই। গোটা দুনিয়ায় কম্পিউটার, সম্প্রচারের যন্ত্র, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার, গাড়ির যন্ত্রাংশ, বৈদ্যুতিক তার, আলো, ভিডিয়ো গেম, মোবাইলের যন্ত্রাংশ, জুতো, চামড়ার জিনিসপত্র, সুতো, পোশাক, আসবাবপত্র, প্লাস্টিকের সামগ্রী, সোনা ইত্যাদি রফতানি করে চিন। এর বহু জিনিস পৌঁছয় আমেরিকাতেও। করোনার মধ্যেই পরিস্থিতি এমন মোড় নেয়, যে চিনা যন্ত্রাংশ না পেয়ে পিছিয়ে যায় অ্যাপলের মতো সংস্থার নতুন ফোন বাজারে আনার ইভেন্টও।
করোনা প্রাথমিক ভাবে কিছুটা ধাক্কা দিয়েছিল চিনের অর্থনীতিকে। বিশ্বায়নের জেরে চিনের সেই অর্থনৈতিক দুরবস্থার জের ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশেও। বেজিংয়ের সঙ্গে নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন দেশগুলিতেও করোনার ধাক্কা লাগে। অর্থনীতির পরিভাষায় ‘স্পিলওভার এফেক্ট’। তার প্রথম আঘাত গিয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের চাহিদায়। ফলে একে একে দাম কমতে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসের। বাজারে চাহিদা এবং পণ্য জোগানের ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে। বাড়তে শুরু করে কর্মহীনতা। করোনার পারিপার্শ্বিক ধাক্কায় গোটা আমেরিকা-সহ বিশ্ব যখন তটস্থ, তখন অবশ্য অতিমারি পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দিয়ে ফেলেছে চিন।
‘স্পিলওভার এফেক্ট’ সামলাতে গিয়ে গোটা দুনিয়া যখন মুহ্যমান, তখন পায়ের তলায় শক্ত জমি ফিরে পেয়েছে বেজিং। সদ্য ঘটে-যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে হারিয়ে আমেরিকার ক্ষমতায় বসতে চলেছেন বাইডেন। কিন্তু তাঁর সামনে করোনার তৈরি করা একের পর এক ক্ষত। দেশের একটি বড় অংশের মানুষের কাজ নেই। শিল্প উৎপাদন কমেছে। ছাঁটা পড়েছে শেয়ারবাজারের উড়ান। কমেছে মানুষের আয়ও। এসবের জের সরাসরি গিয়ে পড়েছে দেশের গড় বার্ষিক উৎপাদনে (জিডিপি)। কিন্তু এ সবের মধ্যেও প্রাথমিক ধাক্কা সামলে দেশবাসীকে বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে চিনের অর্থনীতি।
এই মন্দা কাটিয়ে দ্রুতগতিতে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। ছবি: রয়টার্স।
করোনার আঘাত সত্ত্বেও বেজিংয়ের অর্থনৈতিক উন্নতির কারণ কী?
অর্থনীতিবিদদের মতে, কারণ লুকিয়ে চিনা অর্থনীতির শিকড়ে। দুনিয়া জুড়ে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই নভেম্বরে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে চিনের জিডিপি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছিল ৪.৯ শতাংশ। আমদানি বেড়েছিল ১৩.২ শতাংশ এবং রফতানি ৯.৯ শতাংশ। এর কারণ হিসাবে আটের দশকে চিনের অর্থনৈতিক সংস্কারের কথাই তুলে আনছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের মতে, চিনের প্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল শেনঝেন মডেলই (কোটিপতিদের নিরিখে সারা বিশ্বে যে শহর পঞ্চম। প্রথম বেজিং। তারপর একে একে নিউইয়র্ক, সাংহাই এবং হংকং) বদলে দিয়েছে চিনা অর্থনীতির অভিমুখ। নতুন আবিষ্কার এবং প্রযুক্তির ব্যবহার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে ক্রমশই প্রভাব বিস্তার করছে চিন।
ড্র্রাগনের দেশে যখন ‘বসন্ত’, তখন করোনা সংক্রমণে কাবু আমেরিকা। সপ্তাহে ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন। তার জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পক্ষেত্র। অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ থেকে এখনও অনেক দূরে। তার কারণ, সারা দেশেই কাজের বাজার এখনও সবল হয়ে ওঠেনি। উৎপাদন, খনি, শিক্ষা, তথ্য, সরকারি, রিয়েল এস্টেট, পরিষেবা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দেশের নাগরিকদের মধ্যে খরচ করার চেয়ে টাকা জমানোর প্রবণতাই বেশি করে ধরা পড়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের একাংশ আগেই আশা প্রকাশ করেছিলেন, এই মন্দা কাটিয়ে দ্রুতগতিতে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। গত সেপ্টেম্বরেই ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যানুফ্যাকচারার্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ শ্যাড মাউট্রে বলেছিলেন, ‘‘আমেরিকার অর্থনীতিতে নানা সঙ্কেত দেখে এটাই মনে হচ্ছে যে, অনেক শক্তিশালী হয়েই সে আগের অবস্থায় ফিরে আসছে।’’ ইতিমধ্যেই কিছু বদল লক্ষ্য করা গিয়েছে। নভেম্বর মাসেই প্রায় আড়াই লক্ষ চাকরি তৈরি হয়েছে। যদিও তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এর মধ্যে এসে উপস্থিত শীত। এই সময়ে করোনা সংক্রমণে লাগাম পরানোই আমেরিকার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
ড্রাগনের দেশে যখন ‘বসন্ত’, তখন করোনা সংক্রমণে কাবু আমেরিকা। ছবি: এএফপি।
কোভিড পরবর্তী সময়ে চিনের অর্থনীতি কি দীর্ঘস্থায়ী ধাক্কা দিতে চলেছে আমেরিকাকে? দুনিয়া জুড়ে উদারীকরণের স্রোতের ‘স্লুইস গেট’ নিয়ন্ত্রণের ভার অনেকটা ছিল আমেরিকার উপরেই। এ বার সেই কর্তৃত্ব কি খর্ব হতে চলেছে? বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। তাঁর মতে, ‘‘চিনের ভিতরে কী ঘটে চলেছে তা আমরা জানি না। কিন্তু যেটা বোঝা যায়, সেটা হল প্রযুক্তি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে আমেরিকার আকাশপাতাল ফারাক। কারণ, চিনে গণহারে উৎপাদন হয়। কিন্তু আমেরিকা নানা জিনিস আবিষ্কার করে।’’ অভিরূপ আরও বলছেন, ‘‘অতি সম্প্রতিই মৌলিক গবেষণা শুরু হয়েছে চিনে। মনে হয় না, এত তাড়াতাড়ি তারা আমেরিকাকে তারা ধরে ফেলতে পারবে। চিন শিক্ষায় আগের থেকে অনেক বিনিয়োগ করেছে বটে, কিন্তু আমেরিকার থেকে তারা এখনও অনেক পিছিয়ে। আমেরিকার প্রথম ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা হয়। চিনের সেই জায়গায় আসতে এখনও অনেক দেরি।’’ অভিরূপের মতে,‘‘করোনা একটি সাময়িক শক মাত্র। এই সঙ্কট থেকে আমরা দ্রুতই বেরিয়ে যাব। ফলে এর থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা পাবে না বেজিং।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy