ফৌজি নন। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন অসম যুদ্ধের ইতিহাসে ‘চরিত্র’ হিসেবে সম্ভবত এখনই ঢুকে পড়েছেন ৪৪ বছরের ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি।
রুশ আক্রমণের সামনে রুখে দাঁড়িয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
তাঁকে দেশ ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। উত্তর পেয়েছিলেন, ‘‘এখন লড়াই দোরগোড়ায়! আমি পালাতে চাই না! বরং আমাকে ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী অস্ত্র দিন!’’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি জানেন, মানুষের চেয়ে বড় অস্ত্র হয় না। রাশিয়ার সঙ্গে যখন এক ‘অসম’ যুদ্ধে লড়ছে তাঁর দেশ, লড়ছেন তাঁর দেশের মানুষ, তখন পালিয়ে না-গিয়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে গোটা ইউক্রেনের মনোবল জোরদার করতে নেমেছেন দেশের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং!
ইতিহাস বলে, অসম লড়াইয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কঠিন পরিস্থিতি নায়কের জন্ম দিয়েছে। ইউক্রেনের কঠিন পরিস্থিতিও তেমনই খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই জন্ম দিয়েছে এক নায়কের— ভোলোদিমির জেলেনস্কি।
অনিদ্রায় দু’চোখ লাল, মুখে কয়েক দিনের না-কামানো দাড়ি। হাতে স্মার্টফোন। দৃশ্যতই ধ্বস্ত কিন্তু শক্ত চোয়াল। জেলেনস্কি তাঁর ভিডিয়োবার্তায় স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘আমাকে নিয়ে অনেক জল্পনা হচ্ছে। কিন্তু আমি ময়দানে আছি।’’
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে রুখে দাঁড়িয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। সাম্প্রতিক কালে যে উদাহরণ দেখা যায়নি।
তালিবানদের হাতে কাবুলের পতন হতেই দেশ ছেড়েছিলেন আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছনোর পর টুইটারে দেশবাসী এবং গোটা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছিলেন, ‘জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত ছিল দেশ ছেড়ে যাওয়া।’ গনির সম্ভবত মনে ছিল, তাঁর পূর্বসূরি তথা দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লা দেশে থেকে যাওয়ায় তাঁকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিয়েছিল তালিবানরা।
গনি দেশ ছাড়েন গত বছরের ১৫ অগস্ট। তার প্রায় আট মাস পর আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ইউক্রেনেও। সেখানে শত্রুপক্ষের সমরসজ্জা আরও তীক্ষ্ম। কিন্তু গনির মতো জেলেনস্কি ময়দান ছেড়ে পালাননি। প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের মতো দাঁড়িয়েছেন বুক চিতিয়ে।
পশ্চিমী দুনিয়ার মহারথী-অতিরথীরা আপাতত কেউ সে ভাবে তাঁর পাশে নেই। তা সত্ত্বেও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত রুশ সেনা আর দেশবাসীর মাঝে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।
বেলারুস, ডনবাস এবং ক্রাইমিয়া— তিন দিক থেকেই ইউক্রেনকে ঘিরে ফেলছে রুশ সেনা। রাজধানী কিভ প্রায় অবরুদ্ধ। হাত গুটিয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জও। কিন্তু জেলেনস্কি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই চালাবেন।
রাজনীতিতে আসবেন, কখনও ভাবেননি। ছিলেন কৌতুকাভিনেতা। হয়ে গেলেন গোটা দেশের প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ক্রিভি রি নামে একটি শহরে জন্ম জেলেনস্কির। লোহার খনি আর ধাতবশিল্প নির্ভর ওই শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। অভিনয়ের প্রতি বরাবর আকর্ষণ ছিল। কিভের ‘ন্যাশনাল ইকনমিক ইউনিভার্সিটি’ থেকে পড়াশোনার পর জেলেনস্কি তৈরি করেছিলেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা। তাদের প্রযোজনায় কৌতুকাভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়তা পান জেলেনস্কি। কিন্তু সেই জগৎ থেকে এখন অনেকটা দূরে জেলেনস্কি।
সাড়ে চার কোটি দেশবাসীকে সাহস যুগিয়ে তাঁদের নায়ক বলছেন, ‘‘আমরা অস্ত্র নামিয়ে রাখব না। আমাদের দেশকে রক্ষা করব। আমাদের দেশ, আমাদের সন্তান— আমরা সব রক্ষা করব।’’ ভিডিয়োবার্তায় তিনি বলেছেন, ‘‘রাশিয়ার প্রথম লক্ষ্য আমি। দ্বিতীয় লক্ষ্য আমার পরিবার। রাশিয়া চায়, আমাকে শেষ করে আমার দেশকে রাজনৈতিক ভাবে নিঃস্ব করে দিতে। কিন্তু আমি পালাব না। এখানেই থাকব। যেখানে আমার সেনারা প্রতি মুহূর্তে রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই করছে!’’
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনের শক্তির থেকে ধারে-ভারে বহুগুণ এগিয়ে রাশিয়া। জেলেনস্কি যখন দেশবাসীকে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছেন, তখন ইউক্রেনের জনমনে ঢুকে পড়েছে যুদ্ধের ত্রাস এবং ধ্বংসের আতঙ্ক। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে ছুটে যাওয়া বুলেটের ঝাঁক আর রকেট বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ শহরজুড়ে তৈরি করে ফেলেছে সন্ত্রাসের আবহ। শনিবারই কিভের লোবানভস্কি স্ট্রিটের একটি বহুতলে রকেট ছোড়ে রুশ সেনাবাহিনী। বরাতজোরে বেঁচে যাওয়া ওই বহুতলের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘আমরা রান্নাঘরে ছিলাম। রকেটটা সরাসরি শোওয়ার ঘরে আছড়ে পড়ে। বিস্ফোরণে আমার স্ত্রী এবং এক সন্তানের পা উড়ে যায়। আর এক সন্তানকে উদ্ধার করা গিয়েছে।’’
এই লড়াইটাই ডেভিড-গোলিয়াথের যুদ্ধে বদলে দেওয়াের চেষ্টায় রয়েছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তাঁর লড়াই আরও কঠিন। কারণ, তাঁর লড়াই ঘরের সঙ্গে বাইরেও। তবে দেশের ভিতরের চিত্র পাল্টে দিতে পেরেছেন জেলেনস্কি। রাশিয়ার সঙ্গে তখন যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে। বিশালকায় রুশ সেনার সামনে ‘লিলিপুট’ জেলেনস্কিকে করুণার পাত্র হিসাবেই দেখছিলেন ইউক্রেনের নাগরিকদের একাংশ। তাঁর নিন্দাও করছিলেন অনেকে। কিন্তু বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী না ছাড়ার ইস্পাতকঠিন মানসিকতা দেখে প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ অনেকেই। ‘ইউক্রেনিস্কা প্রাভদা’ নামে ইউক্রেনের প্রধান ওয়েবসাইটের সম্পাদক তথা সাংবাদিক সেভগিল মুসায়েভার কথায়, ‘‘জেলেনস্কি সিংহের মতো লড়াই করছেন। গোটা দেশ তাঁর পাশে আছে।’’
২০১৯ সালে ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ইউক্রেনের ক্ষমতায় এসে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম ভাষণে জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া সব দেশকেই বলছি, আমাদের দেখুন। সব কিছুই সম্ভব।’’ কূটনীতিকদের মতে, তাঁর সেই বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল পুতিন-শাসিত রাশিয়া। রাশিয়ার ‘একনায়কতন্ত্র’ এবং ইউক্রেনে প্রতিষ্ঠিত ‘গণতন্ত্র’-এর তুলনা টানতেই জেলেনস্কি ওই কথা বলেছিলেন।
সেই পুতিনই জেলেনস্কির দেশ আক্রমণ করে বসেছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য বলছে, রুশ আক্রমণ এবং যুদ্ধের জেরে ইউক্রেনের গৃহহীনদের সংখ্যা এখনই সাড়ে ৩ লক্ষ পেরিয়ে গিয়েছে। রাজধানী কিভে এখন কার্ফু। খবর আসছে, রাশিয়ার গুপ্তচর বাহিনী ঢুকে পড়েছে শহরে। দক্ষিণ ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর মেলিতোপোল রুশবাহিনীর কব্জায়। সেই প্রবল চাপের মুখেও দেশবাসীকে সাহস যুগিয়ে জেলেনস্কি বলছেন, ‘‘আমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করবই! কারণ সত্যই আমাদের অস্ত্র। আর সত্য হল— এটা আমাদের দেশ!’’ তাঁর এই ভাষণে প্রথম ভাষণের অনুরণন শুনতে পাচ্ছেন অনেকে।
আক্রান্ত দেশের প্রেসিডেন্ট পালিয়ে না-গিয়ে দেশবাসীর পাশে থাকার সরাসরি বার্তা দিচ্ছেন। কঠিন যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করছেন দেশের সেনাকে। পরিস্থিতি কঠিনতর হলে দেশরক্ষায় যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকা সকলের হাতেই অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত প্রায় নেওয়া হয়ে গিয়েছে। দেশবাসীর মনোবল দেশের প্রেসিডেন্ট। টুইটারে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে সেই ভিডিয়ো, যেখানে জ্বালানি শেষ হয়ে-যাওয়া রুশ ট্যাঙ্কচালককে ইউক্রেনের রাস্তায় এক বাইক আরোহী বলছেন, ‘‘দেশে ফিরে যাও!’’
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গোটা ইউক্রেনকে এক সুরে বেঁধে দিয়েছেন প্রাক্তন কৌতুকাভিনেতা। উত্তীর্ণ হয়েছেন প্রকৃত রাষ্ট্রনেতার আসনে। কূটনীতিকরা অবশ্য মনে করছেন, সেটা দেশের জন্য তো বটেই, রাষ্ট্রনেতা হিসাবে জেলেনস্কির নিজের জন্যও প্রয়োজন ছিল। দেশবাসীর চোখে তাঁর এই উত্তরণ প্রয়োজন ছিল। যাঁকে সরিয়ে জেলেনস্কির উত্থান, উইক্রেনের সেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কোও রাস্তায় নেমে পড়েছেন অ্যাসল্ট কালাশনিকভ রাইফেল হাতে। ৫৬ বছরের প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা বলেছেন, ‘‘পুতিন ইউক্রেন এবং ইউক্রেনীয়দের ঘৃণা করেন! কিন্তু আমরা ইউক্রেনকে রক্ষা করবই!’’
জেলেনস্কিকে দেখতে দেখতে অনেকের মনে পড়ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস আর কাহিনীর মিশেলে ২০০১ সালের সেই ছবির কথা। দক্ষিণ রাশিয়ার স্তালিনগ্রাদ (এখন ‘ভলগোগ্রাদ’) আক্রমণ করেছে নাৎসিবাহিনী। সেখানে আক্ষরিক অর্থেই শেষ লড়াই লড়ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ। সেই যুদ্ধে পাঁচটি বুলেটে পাঁচ শত্রুকে খতম করে উত্থান হয় রুশ সেনা ভাসিলি জাইটসেভের। ছবির নাম ‘এনিমি অ্যাট দ্য গেটস’।
ফৌজি নন। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন অসম যুদ্ধের ইতিহাসে ‘চরিত্র’ হিসেবে সম্ভবত এখনই ঢুকে পড়েছেন ৪৪ বছরের ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy