(বাঁ দিকে) শেখ হাসিনা। (ডান দিকে) মীর আহমেদ বিন কাসেম, মাইকেল চাকমা এবং আবদুল্লাহিল আমান আজ়মি (উপরে)। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে সোমবার। তার পরেই হাসিনা জমানার ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের দুই ‘বিশেষ’ বন্দি আবদুল্লাহিল আমান আজ়মি এবং মীর আহমেদ বিন কাসেমকে। আজ়মি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার। তাঁর বাবা প্রয়াত গোলাম আজ়ম ছিলেন জামাতে ইসলামির ‘আমির’ (প্রধান)। আর কাসেম হলেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামাত নেতা মীর কাসেম আলির কনিষ্ঠ পুত্র। পেশায় ব্যারিস্টার। আট বছর আগে দু’জনকেই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের আইনশৃঙলা রক্ষা বাহিনী। তার পর থেকে তাঁদের খোঁজ মেলেনি। ‘আয়নাঘর’ থেকে তাঁদের মুক্তির পরে বাংলাদেশের সেনাকর্তাদের একাংশ এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ দাবি করেছেন, ‘আয়নাঘর’-এর বাকি বন্দিদেরও মুক্ত করা হোক।
‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। বুধবার ইউপিডিএফ সূত্রে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা দীর্ঘ পাঁচ বছর তিন মাস পর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মঙ্গলবার ভোরের দিকে চট্টগ্রামের একটি স্থানে তাঁকে চোখ-বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাইকেল চাকমা নিখোঁজ হন ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম-সহ বাংলাদেশের সব জনগণ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ছিলেন।
কিন্তু ‘আয়নাঘর’ কী? বাংলাদেশের মানুষের বর্ণনায় ‘গুমখানা’। হাসিনার শাসনকালে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, হাসিনা দ্বিতীয় বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। অর্থাৎ, তাঁর শাসনকালেই ‘আয়নাঘর’-এর শুরু। তথ্য বলছে, ওই বন্দিদের মধ্যে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে এত দিন ১৫১ জন বন্দি ছিলেন বলে সূত্রের খবর। তাঁদের মধ্যেই মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন জনের মুক্তি হয়েছে। ওয়াকিবহাল লোকজনের বক্তব্য, ‘‘আয়নাঘর হল এক গোপন গুমখানা।’’ ওই ‘গুমখানা’র দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স’ (ডিজিএফআই)।
হাসিনার পতনের পর ‘আয়নাঘর’ আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। সেখানে অত্যাচারের বর্ণনা যেমন আবার আলোচিত হতে শুরু করেছে, তেমনই আওয়ামী লীগের একাংশ বলছেন, ‘‘আয়নাঘর তো একদিনে তৈরি হয়নি! বিএনপি আওয়ামী লীগের হাজার লোককে খুন করেছে। শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলায় একসঙ্গে ২৬ জনকে খুন করেছিল বিএনপি-জামাতিরা। সেই দোষীদেরও তো শাস্তি প্রাপ্য ছিল।’’ তবে ওই নেতারা এ-ও বলছেন যে, এই ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ বাংলাদেশকে আরও বেশি করে কুশাসনের গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে।
আয়নাঘরের কথা জনসমক্ষে আসে বছর দু’য়েক আগে। ২০২২ সালের এই অগস্টেই সুইডেনের একটি সংবাদমাধ্যম ‘নেত্রনিউজ়’ একটি অন্তর্তদন্তমূলক ভিডিয়ো প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইউটিউবে। পুরনো সেই ভিডিয়ো মঙ্গলবার রাত ১১টায় পুনঃপ্রচার করেছে বিএনপি। তাতে শোনা গিয়েছে ‘আয়নাঘর’ থেকে বেঁচে ফিরে আসা দুই প্রাক্তন বন্দির বিবরণ।
‘আয়নাঘর’ ছিল ঢাকা শহরে ডিজিএফআই সদর দফতরের ঠিক পিছনে। সেখান থেকে ছাড়া-পাওয়া এক প্রাক্তন বন্দির কথায়, ‘‘উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং। দক্ষিণে মেস বি। পূর্ব পাশে কয়েকটি সরকারি দফতর। পশ্চিম পাশে ডিজিএফআইয়ের ফাঁকা ছাউনি। উত্তর-পূর্বে ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। আর মাঝখানে একটা মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানেই (ওই গুমঘর)। ওই গুমঘরের ছদ্মনাম ‘আয়নাঘর’।’’
যিনি এই বিবরণ দিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান। তিনি দু’বার ‘গুম’ হয়েছিলেন আয়নাঘরে। হাসিনুর জানিয়েছেন, আয়নাঘরের অবস্থান তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শৌচাগারের কমোডের উপরে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে লাগানে এগজ়স্ট ফ্যানের গর্তের একচিলতে ফাঁক দিয়ে। হাসিনুরের কথায়, ‘‘কর্মসূত্রে ওই জায়গায় এসেছি। জায়গাটা আমি চিনে ফেলি।’’ তাঁর বিবরণেই চোখের সামনে ফুটে উঠেছে আয়নাঘরের অন্দরমহল। আয়নাঘরের দু’টি বিভাগ। একটি ১৬টি কুঠুরির পুরনো বিভাগ। অন্যটি ১০টি কুঠুরির নতুন বিভাগ। প্রতিটি ঘর ‘শব্দরহিত’। ভিতরের আওয়াজ যাতে বাইরে না যায়, তার জন্য প্রতি পাঁচটি ঘরপিছু দু’টি করে বড় এগজ়স্ট ফ্যান লাগানো। ১০টি কুঠুরির নতুন বিভাগটিতে চারটি এগজ়স্ট ফ্যান ছিল বলে জানিয়েছেন হাসিনুর।
এগজ়স্ট ফ্যানের কথা শোনা গিয়েছে দ্বিতীয় প্রাক্তন বন্দি শেখ মোহাম্মদ সেলিম হোসেনের দেওয়া বিবরণেও। তাঁর কথায়, ‘‘ফ্যানগুলো দিনে এক বার বন্ধ হত। বন্ধ হলেই শুনতে পেতাম কান্নার শব্দ। কত লোক কাঁদছে! কোনও কোনও জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আওয়াজটা হঠাৎ বেড়ে যেত!’’
তবে দুই বন্দিই জানিয়েছেন, তাঁদের খাবার দেওয়া হত পর্যাপ্ত পরিমাণে। তবে তার কোনও সময় ছিল না। কখনও কখনও অনেক সময়ের ব্যবধানে ভরপেট খাবার দেওয়া হত। আবার কখনও কখনও ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পেট ঠেসে খাওয়ানো হত। দেওয়া হত বাংলাদেশের পরিচিত ব্র্যান্ডের মিনারেল ওয়াটারের বোতলের জলও।
ওই সংবাদমাধ্যমের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল জানান, মালয়েশিয়া প্রবাসী তরুণ ওই সেলিমের কাছ থেকে ফোন পাওয়ার পর তাঁদের ‘অনুসন্ধান’ শুরু হয়। সেলিমকে ২০১৬ সালের মে মাসে ‘গুম’ করা হয়েছিল গাজিপুরের কাপাসিয়া থেকে। বেশ কয়েকমাস নিখোঁজ থাকার পরে তাঁকে একটি ভুয়ো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সাধারণ কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে মালয়েশিয়ায় ফিরে সেলিম যোগাযোগ করেন খলিলের সঙ্গে। জানান নিজের অভিজ্ঞতার কথা।
সেলিম বলেছেন, ‘‘যে ঘরে ছিলাম, সেই ঘরের দেওয়ালে অনেক লেখা। খোদাই করে লিখে রেখে গিয়েছে সবাই। এক এক জনের লেখার স্টাইল এক একরকম। কেউ লিখেছে, আমাকে বাড়ি থেকে তুলে এনেছিল ডিজিএফআই। কেউ লিখেছে ফোন নম্বর। সঙ্গে অনুরোধ: পারলে আমার পরিবারকে কেউ বলবেন, যেন আমার খোঁজ করে। আমাকে সরকার বন্দি করে রেখেছে। কত জনকে যে এখানে আনা হয়েছিল, ভেবে কুল পাওয়া যাবে না।’’
সেলিমকে একটি গাড়ির গ্যারাজ থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ডিজিএফআই। তাঁর দেওয়া আয়নাঘরের বিবরণ মিলে গিয়েছে অপর প্রাক্তন বন্দি হাসিনুরের সঙ্গে। তবে সেলিম জানিয়েছেন, আয়নাঘরের ঘরগুলোয় সূর্যের আলোও পৌঁছতো না। তাঁর কথায়, ‘‘১০ ফুট বাই ১০ চৌকো ঘর। উঁচু ছাদ। আর উপরে থাকত এগজ়স্ট ফ্যান। আর একটা ছোট্ট আলো। বাইরে দিন কি রাত বোঝার উপায় ছিল না। ঘরে কোনও জানলা ছিল না। শুধু দু’টো দরজা ছিল। একটা কাঠের। একটা লোহার। খাঁচার মতো। প্রথমে সেই খাঁচার মতো লোহার দরজা। তার পরে কাঠের দরজা। তাতে থাকত একটা ছোট গোল গর্ত। সেখান থেকে প্রহরীরা দেখে নিতেন, ভিতরে কে কী করছে।’’
আয়নাঘরের প্রহরার দায়িত্বে থাকেন মূলত সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা। প্রতি চার ঘণ্টার শিফ্টে নতুন এবং পুরনো বিভাগে দু’জন করে মোট চার জন প্রহরী থাকতেন। তাঁদের কাজ ছিল বন্দিদের মুখে কাপড় বেঁধে শৌচাগারে নিয়ে যাওয়া এবং শৌচাগার থেকে সে ভাবেই নিয়ে আসা। যাতে একই সময়ে এক জায়গায় একাধিক বন্দি এসে পড়লেও কেউ কাউকে দেখতে না পান, চিনতে না পারেন।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছিল আলাদা ঘর। সেই ঘরগুলিকে বলা হত ‘টর্চার রুম’। তথ্যচিত্রে সেলিম জানিয়েছেন, এক বারই তাঁকে সেই ঘরে যেতে হয়েছিল। জুটেছিল বেদম মার। কারণ, তদন্তকারীরা যা প্রশ্ন করছিলেন, তার একটিরও জবাব ছিল না তাঁর কাছে। চোখ-বাঁধা সেলিমকে প্রশ্ন করছিল এক মহিলা কণ্ঠস্বর। সেই জিজ্ঞাসাবাদ পর্বেই সেলিমের মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। কারণ, ডিজিএফআই বুঝতে পারে, একই নামের অন্য ব্যক্তিকে ‘ভুলবশত’ তুলে এনেছে তারা। খলিল জানিয়েছেন, তাঁরা অন্তর্তদন্ত করে জানতে পারেন, একই সময়ে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন আরও এক ব্যক্তি। তাঁর ভুয়ো কাগজপত্রের অনেকগুলিতেই নাম ছিল ‘সেলিম’। ডিজিএফআই গাজিপুরের সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝতে পারে, মালয়েশিয়াবাসী যে সেলিমের খোঁজ তাঁরা করছিলেন, ইনি তিনি নন। শুরু হয় ভুল শুধরানোর প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় অনেক দেরি হয়ে যায়। তত দিনে সেলিমের জীবনে একটা বিভীষিকাময় অধ্যায় লেখা হয়ে গিয়েছে। যার দাগ কোনও দিন মুছবে না।
তথ্যচিত্রে সেলিম জানিয়েছেন, আয়নাঘরে থাকাকালীন তাঁর বহু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাঁর ঘরেই থাকতেন বাংলাদেশের এক অ্যাথলিট। নাম লিটন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর অলিম্পিক্সে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি ‘গুম’ হয়ে যান। সেলিমের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তাও হত। কথাবার্তা হত আয়নাঘরের আশপাশের কয়েদিদের সঙ্গেও। সে কথা বলার অভিজ্ঞতাও শুনিয়েছেন সেলিম। কিন্তু শব্দরহিত ঘরে কথা হবে কী করে? সেলিম জানিয়েছেন, কথা হত এগজ়স্ট ফ্যান বন্ধ হলে। দিনে এক বারই বন্ধ করা হত ফ্যানগুলো। ৩০ মিনিটের জন্য। সেই সময় দেওয়ালে ধাক্কা দিয়ে কথা শুরু হত তাঁদের। এক বার সেলিম আয়নাঘরে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি পুলিশের হাত ছাড়িয়ে পালাচ্ছেন। সে কথা শুনে পাশের কুঠুরির বন্দি বলেছিলেন, তা হলে বোধ হয় তাঁর মুক্তি আসন্ন। আরও বলেছিলেন, সব টয়লেটে তিনি তাঁর বাড়ির ফোন নম্বর লিখে রেখেছেন। ফিরে গেলে সেলিম যেন তাঁর বাড়িতে একটা ফোন করেন।
ফোন করেছিলেন সেলিম। নম্বরটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ছাড়া পেয়ে মালয়েশিয়ায় ফিরে গিয়েই সেই নম্বরে ফোন করেছিলেন তিনি। ও প্রান্তে সব শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল এক অশক্ত মহিলার কণ্ঠস্বর। তিনি ওই বন্দির মা। তিনি সেলিমকে বলেছিলেন, তিনি যেন আর ফোন না করেন। তাঁদের সমস্ত ফোনে সরকার আড়ি পেতে রেখেছে। ফোন করলে সেলিমও বিপদে পড়ে যেতে পারেন।
তথ্যচিত্রের শেষে সেলিমের একটি ‘ভয়েস নোট’ও আছে। তাতে সেলিম বলছেন, ‘‘আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ। আমি যেগুলো বললাম, সেগুলো আপনারা এমন ভাবে সকলের কাছে পৌঁছে দিন, যাতে অন্য যারা এখনও গুম আছে, তাদের ভাগ্যে যেন পরিবর্তন আসে। এমন নির্যাতন এবং নিপীড়নের শিকার যেন বাংলাদেশের আর কোনও মানুষ না হন। আমি চাই, আমার মতো যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, সেই প্রত্যেকটা মানুষ যেন এসে কথা বলে আপনাদের সঙ্গে। কিন্তু কেন জানি, সবাই ভয় পায়!’’
সেই ‘ভয়’ আর নেই। লৌহকপাট খুলেছে আয়নাঘরের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy