Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

Rabindranath Tagore: আমেরিকায় কবিগুরুর স্মৃতির বাড়ি কিনলেন দুই বাঙালি, রবীন্দ্রনাথ সত্যিই যেখানে থেকেছিলেন

এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ সত্যিই থেকেছিলেন। প্রায় ১১০ বছর আগে। এখানেই লেখা হয়েছিল নোবেলজয়ী ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ।

দোতলা সাদা রঙের বাড়ি। ইংল্যান্ডের পুরনো বাড়ির ধাঁচে তৈরি।

দোতলা সাদা রঙের বাড়ি। ইংল্যান্ডের পুরনো বাড়ির ধাঁচে তৈরি।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:৪৬
Share: Save:

এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ সত্যিই থেকেছিলেন। প্রায় ১১০ বছর আগে। এখানেই লেখা হয়েছিল নোবেলজয়ী ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ। এই বাড়িতে বসেই কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস-সহ একাধিক খ্যাতনামীকে প্রচুর চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। পেয়েওছেন। পড়াতে গিয়েছেন হার্ভার্ডে। আইওয়া-শিকাগোতে গিয়েছেন এ বাড়ি থেকেই। রবীন্দ্র-স্মৃতিমাখা সেই বাড়ি এখন দুই বাঙালির। কাজল মুখোপাধ্যায় এবং মৌসুমী দত্ত রায়। সম্প্রতি তাঁরা আমেরিকার আর্বানা-শ্যাম্পেনে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে ওই বাড়িটি কিনেছেন।

অধুনা বাঙালি দেখেছে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ওয়েবসিরিজ ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কোনওদিন খেতে আসেননি’। যা আদতে একটি জনপ্রিয় বাংলাদেশি রহস্যকাহিনির নাম। কিন্তু দুই প্রবাসী বাঙালি আমেরিকার মাটিতে যে বাড়িটি কিনেছেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথ সত্যিই থাকতে এসেছিলেন।

দোতলা সাদা রঙের বাড়ি। ইংল্যান্ডের পুরনো বাড়ির ধাঁচে তৈরি। কাজল-মৌসুমী জানালেন, বাড়ির ভিতরটাও খুবই সুন্দর। ‘‘একটা পুরনো পুরনো ব্যাপার লেপ্টে আছে বাড়িটার সঙ্গে। নীচে তিনটে আর উপরে তিনটে করে ঘর। রবীন্দ্র-সময়কার অনেক জিনিসপত্রও আছে। বাথটবও,’’—বললেন কাজল। আর মৌসুমীর কথায়, ‘‘আফগানিস্তানের ঘটনার পর সে দিন জার্মান চ্যান্সেলরকে দেখলাম, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ আবৃত্তি করছেন। মনে হল, দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ এখনও কত প্রাসঙ্গিক এই পশ্চিমে! গোটা বিশ্বে। অথচ বাঙালি তাঁর মূল্যায়ন করতে পারেনি এখনও। এমনকি, পুব-পশ্চিমের সেই যোগসূত্রও এখন ছিন্ন। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পুরনো সেই যোগসূত্র ফের জুড়তে চাই আমরা। তাই বাড়িটা নিয়েছি।’’

এই বাড়ি শুধু রবীন্দ্রনাথেরই স্মৃতিবিজড়িত নয়, এখানে থেকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। থেকেছেন রথীন্দ্র-পত্নী প্রতিমাদেবীও। কাজল-মৌসুমীর ইচ্ছা, প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের যে মেলবন্ধন রবীন্দ্রনাথ ঘটিয়েছিলেন, তা পুনরুজ্জীবিত করা। কবির দর্শনকে এই সময়ে এসে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কাছে ফের তুলে ধরা। আর সে কারণেই নিউ ইয়র্কের প্রবাসী দুই বাঙালি কাজল-মৌসুমী আর্বানার এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত মিউজিয়াম এবং আর্কাইভ গড়ে তুলতে চান।

দুই প্রবাসী বাঙালি আমেরিকার মাটিতে কিনে নিলেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত আস্ত একটা বাড়ি!

দুই প্রবাসী বাঙালি আমেরিকার মাটিতে কিনে নিলেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত আস্ত একটা বাড়ি!

১৯০৬ সালে আর্বানায় ‘এগ্রিলাকালচার ইকনমিক্স’ নিয়ে পড়তে এসেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। সঙ্গে সন্তোষচন্দ্র মজুমদার। তখন রবীন্দ্রনাথ কয়েক দিনের জন্য এসেছিলেন আর্বানায়। পরে তিনি ফের আসেন ১৯১২ সালে। ছিলেন টানা ছ’মাস। ১৯১৩-র এপ্রিল পর্যন্ত। তার বছর দুয়েক আগেই রথীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছে প্রতিমাদেবীর সঙ্গে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আসেন আর্বানা। ২৭ অক্টোবর, ১৯১২ নামেন নিউ ইয়র্কে। সেখান থেকে ট্রেনে শিকাগো। তার পর ঘোড়ার গাড়িতে আর্বানা। ৭ নভেম্বর, ১৯১২। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘ভাই জ্যোতিদাদা, আমরা আমেরিকায় এসে পৌঁছেছি। সে কারণে তোমার চিঠি আসতে দেরি হয়েছে।... আমরা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। বৌমা সেই বাড়ির কর্ত্রী। তাকে নিজেই রান্না করতে হচ্ছে।’ চিঠির উপরে ঠিকানা লেখা— ‘৫০৮ হাই স্ট্রিট, আর্বানা, ইলিনয়, ইউএসএ’। এই বাড়িতেই টানা ছ’মাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখন বাড়িটি দুই বাঙালির।

১৯০৩ সালে তৈরি আর্বানার বাড়িটি কিছু দিন আগে পর্যন্ত ছিল এক আমেরিকান ভদ্রলোকের। নাম স্ট্যান শার্লো। বয়স সত্তরের উপরে। বহু চেষ্টার পর কাজল-মৌসুমী তাঁকে রাজি করাতে পেরেছেন ওই বাড়ি বিক্রি করতে। নিউ ইয়র্ক থেকে আনন্দবাজার অনলাইনকে কাজল বলছিলেন, ‘‘বৃদ্ধ প্রথমে রাজি ছিলেন না। তিনি রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ হলেও বাড়িটির ঐতিহ্যের ব্যাপারে খুব যে যত্নশীল ছিলেন, তেমন নয়। আমরা অনেক দিন ধরেই অনুরোধ করছিলাম। শেষে শার্লোর ছেলে তাঁর বাবাকে রাজি করান। বোঝান, বাঙালিদের কাছে এ বাড়ি থাকলে ইতিহাসে তিনিও থেকে যাবেন। অবশেষে আমরা বাড়িটা হাতে পাই।’’ কত দামে কিনলেন কবিগুরুর বাড়ি? কাজলের জবাব, ‘‘দামটা বিষয় নয়। এই বাড়ি দুর্মূল্য।’’

আর্বানার এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের বসবাসের নানা স্মৃতির উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর চিঠিপত্র থেকে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘সিলেক্টেড লেটার্‌স অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’-এ এই বাড়ি এবং আর্বানার একাধিক বার উল্লেখ রয়েছে। যদিও কৃষ্ণা দত্ত এবং অ্যান্ড্রু রবিনসন সম্পাদিত সে বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণ এখন আর পাওয়া যায় না। কাজল-মৌসুমীর কাছে একটি সংস্করণ রয়েছে। মৌসুমী বললেন, ‘‘আর্বানাতে একটা টেগোর ফেস্টিভ্যাল হয় প্রতি বছর। চ্যানিংমারে ফাউন্ডেশন আর ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সাল চার্চ তার উদ্যোক্তা। আমরা প্রতি বছর যেতাম। তার আগেই ওই বই থেকে বাড়িটা সম্পর্কে জেনেছিলাম। গেলেই বাড়িটা দেখতাম হাঁ করে। এই বাড়ির সঙ্গে এত ইতিহাস জড়িয়ে! নোবেলজয়ী গীতাঞ্জলি এখানে বসে অনূদিত হয়েছে। একটা শিহরণ জাগত। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা পরিসংখ্যানবিদ অনিল বেরা আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওঁকে বলি বাড়িটা কিনে নিতে। তবে শেষমেশ ওঁর উদ্যোগেই বাড়িটা আমরা পেয়েছি।’’

চিঠির উপরে ঠিকানা লেখা— ‘৫০৮ হাই স্ট্রিট, আর্বানা, ইলিনয়, ইউএসএ’।

চিঠির উপরে ঠিকানা লেখা— ‘৫০৮ হাই স্ট্রিট, আর্বানা, ইলিনয়, ইউএসএ’।

কাজল-মৌসুমী আরও মনে করেন, আর্বানার এই বাড়ি থেকেই বিশ্বভারতীর বীজ বপন হয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ এখান থেকে পড়াশোনা করেই শান্তিনিকেতনে সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই বাড়িতে বসেই উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, সিএস অ্যান্ড্রুজ, এজরা পাউন্ডকে একাধিক চিঠি লিখেছেন কবিগুরু। কাজল বললেন, ‘‘বাড়িটা দেখলেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হত। বাঙালির গর্ব তো এই বাড়ি! বাড়িটার কথা তেমন ভাবে কেউ জানেন না। রথীন্দ্রনাথ কসমোপলিটন ক্লাব এই বাড়িতে শুরু করেছিলেন। আমেরিকার তৎকালীন লেখক, বিদ্বজ্জনেরা আসতেন এ বাড়িতে। তাঁদের মধ্যে আলোচনা হত। সাহিত্যসভা বসত। বৈঠক হত। রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে পশ্চিমে আরও বেশি করে প্রচারের জন্য এই বাড়িটার প্রয়োজন আছে।’’

আর মৌসুমী? তিনি বলছেন, ‘‘এ বাড়ি আমাদের নয়, ভারতের সম্পত্তি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেবেলা’য় লিখেছেন, ‘বিলেতে গেলেম, ব্যারিস্টার হইনি। জীবনের গোড়াকার কাঠামোটাকে নাড়া দেবার মতো ধাক্কা পাইনি, নিজের মধ্যে নিয়েছি পুব-পশ্চিমের হাত মেলানো— আমার নামটার মানে পেয়েছি প্রাণের মধ্যে।’ আমরা সেই দর্শনটাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’’ কাজল যোগ করলেন, ‘‘এখানে একটা রাইটার্স রেসিডেন্স করার ইচ্ছে আছে। রাস্তাটার নাম ‘টেগোর সরণি’ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব। একটা ছোট ফাউন্ডেশনও করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে একটা মিউজিয়াম এবং আর্কাইভও করব।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore gitanjali usa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy