ছেলে খেলা: সেমিফাইনালে জিতেছে ক্রোয়েশিয়া। খেলা শেষে লুঝনিকের মাঠে ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের সন্তানেরা। ছবি: গেটি ইমেজেস।
ছবির মতোই শহরটা। দুব্রভনিক। ক্রোয়েশিয়ার দক্ষিণ উপকূলে এড্রিয়াটিক সাগরের তীরে বিরাট পাঁচিলঘেরা এই প্রাচীন শহরের হালে খ্যাতি অবশ্য টিভি সিরিজ় ‘গেম অব থ্রোনস’-এর শুটিং-লোকেশন হিসেবে।
দু’কিলোমিটার পরিধি নিয়ে দুর্গের মতো প্রাচীরটা প্রায় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে রক্ষা করেছে দুব্রভনিককে। ক্রোয়েশিয়ার প্রথম বার বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার ঐতিহাসিক মুহূর্ত উদ্যাপনের এর থেকে ভাল প্রেক্ষাপট হয়? তাই এই প্রাচীরেই বিশাল স্ক্রিন বসিয়ে সরাসরি সেমিফাইনাল দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল।
স্থানীয় সময় রাত ৮টায় খেলা শুরু। কিন্তু ৬টার মধ্যেই জনস্রোত। লাল-সাদা পতাকা, ‘মদ্রিচ’, ‘রাকিতিচ’ লেখা জার্সি, স্কার্ফের ঢেউ। গান-নাচ-রং-তুলির মাঝে মনে হচ্ছিল, সামনে নিছক একটা ফুটবল ম্যাচ, নাকি শুভ উৎসবের সূচনা! কিয়েরান ট্রিপিয়ার তাঁর অসাধারণ ফ্রি-কিকে ইংল্যান্ডকে এগিয়ে দেওয়ার পরে অবশ্য একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন দর্শকেরা। ছবিটা পাল্টাল ৬৮ মিনিটে ইভান পেরিসিচের গোলের পরে। গান, ভাইকিং ক্ল্যাপস, রংমশালের দাপটে ওল্ড টাউন তখন আবার গমগমে। পাশের তরুণী এসেছিলেন অশীতিপর বাবাকে নিয়ে। দু’জনেরই চোখে জল।
প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতেই জয়ের গোলটা করলেন জুভেন্তাসের মারিয়ো মাঞ্জুকিচ। শুরু হল উৎসব। শেষ বাঁশি বাজতেই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে আবার মিশল কান্না। জ়াগ্রেব-এর ইয়োসিপ, রিয়েকা-র আনা— সবার চোখে জল। ইয়োসিপ বললেন, ‘‘আমার জীবনের সেরা দিন।’’ জানতাম, এ বার পার্টি চলবে রাতভর। টলমল করবে শহর, নাচবে-গাইবে। জর্জ বার্নার্ড শ এক বার বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা পৃথিবীর মধ্যেই স্বর্গ খোঁজেন, তাঁদের দুব্রভনিকে আসা উচিত।’’ গত রাতে সেই কথা সার্থক।
এই উৎসবের রাতেও আমি এমন এক ক্রোট-কে চিনতাম, যিনি আদৌ খুশি নন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম খেলা শুরুর ঠিক আগেই। হাসিমুখে দরজা খুলেছিলেন ৫৮ বছরের ইভান। ‘ইভান’ বলেই ডাকছি। আসল পরিচয়টা জানাতে চাননি। লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারা। হাতে সিগারেট। মুখে অমায়িক হাসি। বাড়িতে তৈরি পানীয় ‘লুজা’ ঢালতে ঢালতে চোয়াল চেপে ইভান বলেছিলেন, ‘‘আমি চাই না ক্রোয়েশিয়া জিতুক। আমি ক্রোয়েশিয়াকে ঘৃণা করি না, কিন্তু ভালওবাসি না। ওরা বাবাকে মেরে ফেলেছিল। কয়েক দশকের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চলার পরে এই বাড়িতেই গুলি চালিয়ে বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন ১৫ বছর আগে।’’
বলকান যুদ্ধে বিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়ায় ক্যাথলিক এবং অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের টানাপড়েন চিরন্তন। ইভানের বাবা অর্থোডক্স, মা বসনিয়ার মুসলিম। স্বাধীনতার পরেও কোনও দিন প্রাপ্য সম্মান পাননি। ক্রোয়েশিয়ায় এখন ৯৫ শতাংশের বেশি মানুষ ক্যাথলিক। এবং অর্থোডক্সরা চিরকালই তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক।
গল্প বলছিলেন ইভান। যুদ্ধের আগে কী ভাবে প্রায় ২০ কিলোমিটার মোটরবাইক চালিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রেম করতে যেতেন বাবা। ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হওয়ার পরেই শুরু হয়েছিল অর্থোডক্স-উচ্ছেদ। মিশ্র বিবাহের জন্য ইভানের পরিবার পাশে পায়নি কাউকেই। ইভান বলেন, ‘‘আমি এখানেই জন্মেছিলাম। আমি কোনও ধর্মের নই। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার ওরা কে? ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া— সবারই রক্তের খিদে।’’
ক্রোয়েশিয়া যদি বিশ্বকাপ জেতে? ইভানের আশঙ্কা, ‘‘ফুটবলের উদ্যাপন দিয়ে রাজনৈতিক অপরাধ চাপা দেওয়ার অনেক প্রমাণ ইতিহাসেই আছে। বিশ্ব তো জানবেই না, আমাদের সঙ্গে কী কী হয়েছে। সবাই বলবে ক্রোয়েশিয়ার সৌন্দর্য আর ফুটবলের কথা।’’ লুকা মদ্রিচ কী ভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত করেন, বোঝেন না ইভান।
সার্বিয়ার জঙ্গিদের হাতেই খুন হয়েছিলেন মদ্রিচের ঠাকুর্দা। কানাঘুষো বলে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তাঁদেরই এক আত্মীয়। গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচ ইতিমধ্যেই নায়ক। তাঁরও জন্ম অর্থোডক্স পিতার ঘরে। শুধুমাত্র এর জন্যই অনেক বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। প্রেমিকার পরিবার বিয়ে পর্যন্ত দিতে চায়নি। ‘‘আজ সব চাপা পড়ে গিয়েছে, কারণ সুবাসিচ ক্রোয়েশিয়ার হয়ে খেলেন’’— ম্লান মুখে বলেন ইভান।
বাড়িতে রিয়াল মাদ্রিদের বিশাল পতাকা। ক্রোয়েশিয়ার কোনও ক্লাবকে সমর্থন করেন না? হাসেন ইভান। বলেন, ‘‘দিনামো জ়াগ্রেবের সব চেয়ে বড় ভক্ত ছিলাম আমি। শহরের সবাই এক ডাকে চিনত। ফুটবলার জ়নিমির বোবান আমার প্রিয় বন্ধু ছিল। ও খেলতে এসি মিলানে যাওয়ার আগে একসঙ্গে পার্টি করতাম। কিন্তু বোবান আজ আমায় চিনতেও পারে না। যুদ্ধ সবই পাল্টে দেয়।’’
গত রাতে ক্রোয়েশিয়া জুড়ে যখন উৎসব, ইভানের কথা মনে পড়ছিল। এমন একটা সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরে হুমকির ভয়েই তো আসল পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি তিনি। বেশ রাতে আবার গিয়েছিলাম তাঁর বাড়ি।
ইভান আর দরজা খোলেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy