প্রতীকী ছবি
‘মুক্তাঞ্চল’ পঞ্জশির প্রদেশও কি পতনের মুখে? আফগানিস্তানে রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমশ জোরালো হচ্ছে এই জল্পনা। তালিবানের মুখপাত্র বিলাল করিমি টুইটারে দাবি করেছেন, পঞ্জশিরের আটটি জেলাই তাঁদের দখলে চলে এসেছে। বাকি রয়েছে রাজধানী বাজ়ারাক। সেখানেও ঢুকে পড়েছেন তালিবান যোদ্ধারা। চলছে লড়াই।
পঞ্জশিরের পরিস্থিতি ঠিক কী, তা নিয়ে বরাবরই ধোঁয়াশা ছিল। দিন দুয়েক আগে থেকেই তালিবান দাবি করছিল, পঞ্জশির তাদের কব্জায়। আবার তালিবান-বিরোধী ন্যাশনাল রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট (এনআরএফ) গত কালও টুইটারে বলেছিল যে, তাদের সঙ্গে লড়াইয়ে সাতশোরও বেশি তালিবান যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। আরও ছ’শো তালিবকে গ্রেফতার করে জেলে ভরা হয়েছে।
কিন্তু সেই দাবি ঘিরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে আজ স্থানীয় সময় রাত দশটা নাগাদ। তালিবান পঞ্জশিরের আটটি জেলা দখলের দাবি করার কিছু ক্ষণের মধ্যেই এনআরএফের নেতা আহমেদ মাসুদ তালিবানকে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বসেন। ফেসবুকে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে মাসুদ বলেন, ‘‘তালিবান যদি পঞ্জশির ও আন্দারাবে হামলা বন্ধ করে সরে যায়, তা হলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তির স্বার্থে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে এনআরএফ তৈরি। ধর্ম ও নৈতিকতা মেনে তালিবানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবে বিরোধ মিটিয়ে নিতে ফ্রন্ট বদ্ধপরিকর। আমরা নিশ্চিত, তালিবানের সঙ্গে একযোগে আফগান মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিয়েই এগোবে দেশের পরিচালন ব্যবস্থা।’’
আজ কাবুলের এক জমায়েতে ধর্মগুরুদের একাংশও দু’পক্ষকে এই ‘অবৈধ যুদ্ধ’ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে আহ্বান জানান। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, আমেরিকার সঙ্গে আলোচনায় বসতে যেখানে বাধা নেই, সেখানে নিরীহ দেশবাসীর প্রাণরক্ষার স্বার্থে আলোচনায় কিসের আপত্তি? মাসুদ জানিয়েছেন, সেই আহ্বানে তিনি সাড়া দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পঞ্জশিরকে চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখে, জল-খাবারের সরবরাহ, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে পঞ্জশির তথা এনআরএফ-কে পরোক্ষ চাপেও ফেলেছিল তালিবান।
দিনভর নানা দাবি-পাল্টা দাবি ওঠে সমাজমাধ্যমে। টুইটারে শেয়ার করা একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সাদা পতাকা লাগানো কনভয়। নেপথ্যে লোকজনকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘তালিবান পালাচ্ছে।’’ এনআরএফ তখন দাবি করেছিল, খাওয়াক পাস এলাকায় কয়েক হাজার তালিবকে ঘিরে রেখেছে তারা। দাশে রাওয়াক নামে একটি জায়গায় গাড়ি ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছে তালিবান বাহিনী। পিছু হটতে হটতে নাকি পঞ্জশির-লাগোয়া কাপিসা প্রদেশের সীমানার কাছে চলে গিয়েছে তারা। আর তালিবান দাবি করেছিল, একে একে সব জেলা তাদের দখলে চলে আসছে। বাজ়ারাকের লাগোয়া রুখা-তে পুলিশের সদর দফতরও তাদের কব্জায়। এনআরএফের বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেও দাবি করে তালিবান।
এই পরিস্থিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রপুঞ্জকে লেখা এনআরএফের আর এক নেতা, প্রাক্তন আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালের একটি চিঠি। ওই চিঠিতে সালে আর্জি জানিয়েছেন, পঞ্জশিরে তালিবানি আক্রমণ বন্ধ করতে বিশ্ব এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ যেন সক্রিয় হয়। সালে বলেছেন, ‘‘মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ মিলিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ এই অবরুদ্ধ উপত্যকায় পড়ে রয়েছেন। অন্যান্য প্রদেশের প্রায় ১০ হাজার ঘরছাড়া মানুষও তাঁদের মধ্যে আছেন। এ দিকে অবিলম্বে নজর না দিলে মানবতা ও মানবাধিকারের বিপর্যয় ঘটে যাবে। লোকে খেতে পাবে না, হয়তো গণহত্যাও দেখতে হবে।’’
গত পরশু একটি ব্রিটিশ দৈনিকে লেখা দীর্ঘ নিবন্ধে সালে বলেন, কাবুল বিমানবন্দর বন্ধ হওয়ার পরে সাধারণ আফগানেরা যে ভাবে দেশ ছাড়ার জন্য সীমান্তে ভিড় করছেন, তা পশ্চিমি সভ্যতার পক্ষে চূড়ান্ত লজ্জার। তাই পশ্চিমি দেশগুলি যেন রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য তালিবানের উপরে চাপ সৃষ্টি করে। সালে লিখেছেন, ‘‘তালিবান স্রেফ এক ক্লান্ত আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ভ্রান্ত নীতির ফায়দা তুলেছে। তারা মোটেই হৃদয় জেতেনি। পাকিস্তানের কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই তাদের চালাচ্ছে। তালিবানের মুখপাত্রের কাছে প্রায় প্রত্যেক ঘণ্টায় পাক দূতাবাস থেকে নির্দেশ আসছে। কিন্তু এ সব টিকবে না, কারণ পাকিস্তান এবং তাদের এই ‘উপভোক্তারা’ কোনও সচল অর্থনীতি বা সরকারি পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারবে না। সরকার চালানোও তালিবানের সাধ্যের বাইরে।’’
ওই নিবন্ধে সালে জানিয়েছেন, গত ১৫ অগস্ট কাবুলের পতনের দিনে আহমেদ মাসুদও ছিলেন রাজধানীতে। তখনই তাঁরা একসঙ্গে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কম্পিউটার ও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বাসভবন ছাড়ার আগে স্ত্রী এবং মেয়েদের সমস্ত ছবি নষ্ট করে দেন সালে। বন্দুক বসানো দু’টো পিকআপ ট্রাক আর
কয়েকটা সাঁজোয়া গাড়ির কনভয়ে তাঁরা রওনা হন পঞ্জশিরের পথে। দু’বার হামলার মুখেও পড়েন। সালের সঙ্গে ছিলেন বিশ্বস্ত প্রধান দেহরক্ষী রহিম। সালে তাঁকে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন, পথে কোনও সংঘর্ষে তিনি যদি জখম হন, তা হলে রহিম যেন তাঁর মাথায় দু’টো গুলি করেন। তালিবানের হাতে তাঁকে যেন ধরা দিতে না হয়। পঞ্জশিরে পৌঁছে তিনি দেখেছেন, বহু যোদ্ধা আসছেন এনআরএফে যোগ দিতে। তাঁদের মধ্যে সাধারণ আফগানেরাও রয়েছেন, সতীর্থদের মৃত্যু দেখেও
যাঁরা তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পিছপা নন।
যদিও লড়াই কত ক্ষণ চলবে, সেটাই বড় এখন প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy