গত কাল রাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি জানিয়েছিলেন, সমঝোতায় যেতে তিনি প্রস্তুত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও উত্তর মেলেনি। জ়েলেনস্কি বলেছেন, ‘‘ওরা যদি বিস্ফোরকের কার্পেট বিছিয়ে দেয়, শহরের সব মানুষকে মেরে ফেলে, তা হলেই কিভ দখল করতে পারবে। না হলে নয়। আর সেটাই যদি ওদের লক্ষ্য হয়, তা হলে তা-ই করুক ওরা।’’
রুশ হানায় এমনই চেহারা হয়েছে আবাসনের। খারকিভে। পিটিআই
রবিবারের প্রার্থনা চলছে গির্জায়। ক্রশবিদ্ধ যিশুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত মুখগুলো। তাঁদের প্রার্থনা ভেদ করে মাঝেমাঝেই ভেসে আসছে সাইরেন।
ঘটনাস্থল, ইউক্রেনের লিভিভের গ্রিক ক্যাথলিক গির্জা। দেশের একেবারে পশ্চিমে পোল্যান্ড সীমান্ত-ঘেঁষা এই শহর। ১৮ দিন হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এত দিন লিভিভ প্রায় শান্তই ছিল। বরং এই শহর হয়ে উঠেছিল দেশ ছেড়ে পালানোর অন্যতম নিরাপদ করিডর। কিন্তু রুশ সেনা এ বারে পৌঁছে গিয়েছে এখানেও। গত কাল থেকে শুরু হয়েছে নাগাড়ে হামলা। ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট লিভিভ শহর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে গিয়েছিল। বাসিন্দাদের আশা, ইউরোপের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র, প্রাচীন ভাস্কর্যে মোড়া এই শহরকে হয়তো রেহাই দেবে রুশরা।
ইউক্রেনের মানচিত্রটা এ রকম: উত্তরে বেলারুস ও পূর্বে রাশিয়া। আয়তাকার দেশটার দীর্ঘ দক্ষিণ সীমান্ত জুড়ে আজভ সাগর ও কৃষ্ণসাগর। দক্ষিণ-পশ্চিমে মলডোভা, রোমানিয়া। পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি। বন্ধু দেশ বেলারুসকে ঘাঁটি করে সেই দিক দিয়ে প্রথম ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। তার পরে
রাশিয়া সীমান্ত থেকেও সরাসরি কিভের উদ্দেশে রওনা হয় বিশাল সেনা কনভয়। রাজধানী কিভ দেশের একেবারে মধ্যভাগে। কৃষ্ণসাগরের অন্দরে থাকা ক্রাইমিয়া ২০১৪ সালেই ইউক্রেনের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল রাশিয়া। সে দিক থেকেও কৃষ্ণসাগরের ধার ঘেঁষা বন্দর-শহরগুলোতে হামলা শুরু হয়। এর মধ্যে খেরসন আগেই মস্কোর কব্জায় চলে গিয়েছে। মারিয়ুপোলে এখনও লড়াই চলছে। সবচেয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধ হয়তো দেখছে এই শহরই। উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ, তিন দিক থেকে গ্রাস করতে করতে এ বারে পুরো দেশটাকে গিলে নিতে শুরু করেছে রুশ বাহিনী। মাঝখানে দূর্গের চেহারা নিয়ে একা দাঁড়িয়ে কিভ।
কিভবাসীও হয়তো বুঝতে পারছেন সময় ফুরিয়ে আসছে। সেন্ট্রাল কিভের সেন্ট ভলোদিমির ক্যাথিড্রালেও রবিবারের প্রার্থনা হয়েছে। হাতে গোনা কিছু মানুষ। দু’জন সেনা, ১৫ থেকে ২০ জন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মী। মোমের আলোয় দাঁড়িয়ে তাঁরা জানিয়েছেন, এই হয়তো শেষ আসা। এ সপ্তাহে কী ঘটবে জানা নেই। কিভ এখন রুশ সেনার আসার অপেক্ষায়। এক ব্রিটিশ সাংবাদিক জানাচ্ছেন, রাস্তাঘাটে লোকজন নেই বললেই চলে। নীল কোট গায়ে এক মহিলাকে তাঁর চোখে পড়ে। সাংবাদিকের বয়ানে, ‘‘চারপাশ দেখেই চলেছেন। যেন শেষ বারের মতো শহরটাকে দু’চোখ ভরে দেখে নেওয়া। অক্ষত ও সুন্দর।’’
আজ লিভিভের কাছে ইয়াভোরিভে একটি সেনা প্রশিক্ষণ শিবিরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় রুশ বাহিনী। তাতে ৩৫ জন নিহত হয়েছেন বলে প্রাথমিক খবর। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ে এই সেনা ঘাঁটিতে। জায়গাটি পোল্যান্ড সীমান্ত থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। মস্কো শাসিয়ে এসেছে এত দিন, যে সব রাষ্ট্র ইউক্রেনকে এতটুকু সাহায্য করবে, তাদের রুশ-বিরোধিতার মাসুল দিতে হবে। এই তালিকায় প্রথমে রয়েছে নেটোর সদস্য দেশ পোল্যান্ড। অস্ত্র বা অন্যান্য যে কোনও সাহায্য কিভে পৌঁছেছে পোল্যান্ড হয়েই। ওই সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনায় কিছুটা হলেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে পড়শি দেশে। কারণ ১৮ দিন ব্যাপী যুদ্ধে এই প্রথম পশ্চিম ঘেঁষে হামলা চালাল রাশিয়া।
ইউক্রেনে আমেরিকা বা নেটোর কোনও সেনা ঘাঁটি নেই। কিন্তু এই শিবিরটিতে তাদের কর্তাব্যক্তিরা এসে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিত। এমনকি নেটোর মহড়াও হয়েছে এখানে। তা ছাড়া, এখানে রয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল পিসকিপিং অ্যান্ড সিকিয়োরিটি সেন্টার’। ইউক্রেনকে দলে (নেটোয়) না নিলেও আমেরিকা-সহ পশ্চিমি শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বাড়ছিল। রাশিয়ার দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল, ৩০ দেশের নেটো জোট ক্রমশই রাশিয়ার ঘাড়ের কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। সোভিয়েত রাশিয়াকে ঠেকাতে যে পশ্চিমি জোট তৈরি হয়েছিল, সেই নেটোর এই গতিবিধি মোটেই ভাল চোখে দেখছিল না মস্কো।
লিভিভের গভর্নর ম্যাকসিম কোজিৎস্কি দাবি করেছেন, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সক্রিয় ছিল। বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্রকেই আকাশে ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ক্ষেপণাস্ত্র কোনও ভাবে সিস্টেমের নজর থেকে বেরিয়ে যায়। তাতেই ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। জখম ১৩৪।
পশ্চিমের আর এক শহর ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্কের বিমানবন্দরেও আজ হামলা চালায় রুশ বাহিনী। স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরির সীমান্ত থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে শহরটি। এই বিমানবন্দরটির একটি অংশ যাত্রী পরিষেবায় ব্যবহার হয়, অন্য অংশে রয়েছে মিলিটারি এয়ারফিল্ড।
পূর্ব ডনেৎস্কের একটি মনাস্ট্রিতে হামলা চলে। একটি শিশু নিবাসেও গোলাবর্ষণ করা হয়। সাধুসন্ন্যাসী ও বাসিন্দারা লুকিয়ে ছিলেন সেখানে। ৩২ জন জখম হয়েছেন। ডনেৎস্ক থেকে কিছু বাসিন্দাকে উদ্ধার করে পশ্চিম সীমান্তের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল একটি ট্রেন। বোমা পড়ে এই ট্রেনে। এক জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। মারিয়ুপোলের পরিস্থিতি একই রকম। অভিযোগ, ৪ লক্ষ মানুষের এই শহরকে কার্যত বন্দি করে হামলা চালানো হচ্ছে। বাইরে থেকে জল, খাবার, ওষুধ কিছুই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পালাতেও দেওয়া হচ্ছে না কাউকে। বিদ্যুৎ নেই। কার্যত মাটির নীচে ‘গর্তের মধ্যে’ ঠান্ডায় ও না-খেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মানুষ। ইতিমধ্যে কত প্রাণহানি ঘটেছে জানা নেই। শহরের মেয়র জানিয়েছেন, ১৫০০-র বেশি মৃত্যু হয়েছে। তবে বাস্তবে, সংখ্যাটা অনেক বেশি। খবর সংগ্রহে বেরিয়ে কিভের উত্তরপশ্চিমে ইরপিনে নিহত হয়েছেন এক আমেরিকান সাংবাদিক। নাম ব্রেন্ট রেনড। ইউক্রেন তড়িঘড়ি রাশিয়ার উপর দায় ঠেলেছে। তবে ঘটনার সত্যাসত্য জানা যায়নি। আরও এক সাংবাদিক জখম।
গত কাল রাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি জানিয়েছিলেন, সমঝোতায় যেতে তিনি প্রস্তুত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও উত্তর মেলেনি। জ়েলেনস্কি বলেছেন, ‘‘ওরা যদি বিস্ফোরকের কার্পেট বিছিয়ে দেয়, শহরের সব মানুষকে মেরে ফেলে, তা হলেই কিভ দখল করতে পারবে। না হলে নয়। আর সেটাই যদি ওদের লক্ষ্য হয়, তা হলে তা-ই করুক ওরা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy