ফাইল চিত্র।
তাপমাত্রার পারদ শূন্যের অনেক নীচে। তা তুচ্ছ করেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে প্রাণ হাতে করে বেরোনোর মরিয়া চেষ্টায় সীমান্ত অঞ্চলগুলির দিকে পাড়ি দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। একই পথ বেছে নিয়েছেন আটকে পড়া বহু ভারতীয় ছাত্রছাত্রীও। তবে ভারতীয় দূতাবাসের আশ্বাসকে সম্বল করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পোল্যান্ড বা রোমানিয়া সীমান্তে পৌঁছনো ওই ছাত্রছাত্রীদের চটক ভেঙেছে সীমান্তে পৌঁছে। তাঁদের দাবি, ইউক্রেনিয়ানদের সহজেই সীমান্ত পেরোতে দেওয়া হলেও বেছে বেছে ভারতীয়দেরই আটকে দিচ্ছেন সীমান্তরক্ষীরা!
দেশের অন্দরে রুশ সেনার দাপট চলছে। আর সীমান্তে এসে ইউক্রেন বাহিনীর ‘আগ্রাসী’ চেহারার সাক্ষী হচ্ছেন তাঁরা। এমনটাই অভিজ্ঞতা সীমান্তে পৌঁছনো ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশের। অভিযোগ একাধিক— সেনা এবং পুলিশ একজোট হয়ে পোল্যান্ড সীমান্ত অঞ্চল থেকে ঠেলে ইউক্রেনের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে ভারতীয়দের। আতঙ্ক ছড়াতে বার বার শূন্যে গুলি ছোড়া হচ্ছে। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরেও ভিসার লাইন থেকে টেনে টেনে ভারতীয়দের বার করার অভিযোগও রয়েছে। এমনকি ভারতীয়দের জমায়েত লক্ষ্য করে গাড়ি ছুটিয়ে এগিয়ে আসার অভিযোগও উঠেছে সেনার বিরুদ্ধে। মারধর এবং লাথিও নাকি চলেছে মুহুর্মুহু। রোমানিয়া সীমান্তের পরিস্থিতিও প্রায় এক। সেখানেও ভিড় বাড়ছে ভারতীয়দের। তবে তাঁদের আর্জি শোনার মতো কেউ নেই। নিজেদের এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা সমাজমাধ্যমে তুলে ধরেছেন একাধিক ছাত্রছাত্রী।
প্রায় ৫০ কিলোমিটার হেঁটে শনিবার বিকেলে পোল্যান্ড সীমান্তের টার্নোপিলে পৌঁছেছেন এক মেডিক্যাল পড়ুয়া। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতীয়দের লাইন বেড়েই চলেছে। কেউ কেউ ৪৮ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে... তবে ইউক্রেনিয়ানদের যেতে দেওয়া হলেও আমাদের হচ্ছে না। এখানকার পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হবে। ভারতীয় দূতাবাসের আধিকারিকেরাও আমাদের ফোনের উত্তর দিচ্ছেন না। আমাদের কেউ সাহায্য করছে না, কেউ না। আমরা কোথায় যাব?’’ ওই ছাত্রী জানান, প্রায় ৪৮ ঘণ্টা ধরে এই রাস্তাই ঠিকানা বহু ভারতীয়ের। খোলা আকাশের নীচে থেকে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় কোনওভাবে টিকে থাকতে জঞ্জাল জ্বালিয়ে চলছে শরীর গরম রাখার চেষ্টা। পাশ থেকে ক্ষোভ উগরে প্রশ্ন ছোড়েন এক ছাত্র, ‘‘যদি পোল্যান্ড হয়ে আমাদের উদ্ধারের কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার মতো ব্যবস্থাপনাই হয়নি এখনও তা হলে দূতাবাসের তরফে আমাদের এখানে আসতে বলা হল কেন?’’ হাল ছেড়ে অনেকেই অবশ্য ইতিমধ্যেই ফিরে গিয়েছেন বাঙ্কার কিংবা বেসমেন্টে।
দিল্লিতে অবস্থিত পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত টুইট করেছিলেন, ‘ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের ভিসা ছাড়াই ঢুকতে দিচ্ছে পোল্যান্ড।’ যাঁরা পোল্যান্ডের আধিকারিকদের কাছে পৌঁছতে পারছেন তাঁরা জানিয়েছেন, এই কথা ১০০% সত্যি। কিন্তু সেই পর্যন্ত পৌঁছতেই পারছেন না অধিকাংশ ভারতীয়কে। ইউক্রেনের বাহিনীর তরফে সীমান্তের এ পারেই প্রতিহত করা হচ্ছে তাঁদের। সীমান্তে এই অত্যাচারের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এক ছাত্রী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শুধু ইউক্রেনিয়ানদের ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছিল। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক মিনতি করি। তার পর শুধু মাত্র মহিলাদের কয়েক জনকে যেতে দিতে রাজি হন তাঁরা। ইতিমধ্যেই হঠাৎ কোথা থেকে পুলিশ এসে ভারতীয় ছাত্রদের বেধড়ক মারতে শুরু করল!’’ অত্যাচারের বহর বাড়তে থাকে বলেই জানান ওই ছাত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘অত্যাচার চরমে পৌঁছে যখন হাঁপানি আছে এমন এক ছাত্রকে মারধরের পরে বাকিদের দেখতে বলা হয়, শ্বাস না-নিতে পারলে ঠিক কেমন লাগে!’’
ঘটনাস্থলের চিত্র যা ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, ভারতীয়দের ইচ্ছে করে আটক করে রাখার চেষ্টাই চালাচ্ছে ইউক্রেন সেনা— মত কূটনীতিকদের একাংশের। এক সূত্রের খবর, ইউক্রেনের এক অভিবাসন আধিকারিক নাকি এ-ও বলে বসেন যে, ‘‘তোমাদের সরকার আমাদের পাসে দাঁড়ায়নি, আমরা কেন তোমাদের সাহায্য করব!’’ এমনকি অনেক ভারতীয়ের পাসপোর্ট বা যাতায়াত সংক্রান্ত জরুরি নথি ছিঁড়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে ইউক্রেনের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে। যদিও এই বিষয়গুলির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
উল্লেখ্য, তাঁদের পাশে না-দাঁড়ানোর জন্য কারও নাম উল্লেখ না-করেই ভারত-সহ একাধিক দেশের বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন তোপ দেগেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত। বলেছিলেন, ‘‘ইউক্রেনে বসবাসকারী আপনাদের নাগরিকদের নিরাপত্তাই অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল।’’ হঠাৎ ইউক্রেনিয়ান সেনার এই ভোলবদল কি এই হুমকিরই পরোক্ষ প্রতিফলন? জবাব অবশ্য মেলেনি।
অন্য দিকে, কূটনীতির ছায়া থেকে বহু দূরে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এক দেশের সীমান্তে খোলা আকাশের নীচে নিরাপত্তাহীন অনিশ্চয়তার রাত কাটানো অসহায় ছাত্রছাত্রীদের একটাই দ্বন্দ্ব, ‘‘কেন আটকানো হচ্ছে ভারতীয়দেরই? কেন দেখা নেই দূতাবাস আধিকারিকদেরও?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy