স্বাধীন বাংলাদেশে কেবল মাত্র একটি সিনেমাতেই গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
সে চলচ্চিত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের পটভূমিকায় নির্মিত। নায়কের ছোট বোনের চরিত্রাভিনেত্রী সুলতানা সেই গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া সেই ছবি ‘রক্তাক্ত বাংলা’-র পরিচালক ছিলেন মমতাজ আলী। নায়ক বিশ্বজিৎ তখন ভারতে খুবই জনপ্রিয়। ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীই লতাকে গাইতে রাজি করিয়েছিলেন নতুন দেশের নতুন সিনেমায়।
স্বাধীন বাংলাদেশে গানের ডালি নিয়ে মাত্র এক বারই পদার্পণ করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
সে-ও ১৯৭২ সালে। সুনীল দত্ত ভারতের একটি সাংস্কৃতিক দল নিয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান হয়েছিল সেখানে। তবে বাংলাদেশের সদ্য-নাগরিকেরা সেই অনুষ্ঠানগুলি দেখার সুযোগ খুব একটা পাননি। কারণ তখনও সে দেশে রয়ে যাওয়া ভারতীয় সেনানীদের মনোবল চাঙ্গা করাই ছিল সুনীল দত্তের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক দলটির লক্ষ্য।
তার পরেও কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়ল বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। হাতের স্টেনগান থেকে হানাদার বাহিনীর দিকে বুলেট বৃষ্টির যে অভিজ্ঞতা তাঁর আছে— সেটি অভিনয় ছিল না, সত্যিকারের। গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া সে দিনের সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার আজ একটাই প্রতিক্রিয়া, “কিচ্ছুটি ভাল লাগছে না!” জানালেন, এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু একটু আগেই ফোন করে বলছিলেন, এই বুড়ো বয়সে তিনিও কিছুতে কান্না চেপে রাখতে পারছেন না। সেই বন্ধুর কথায়, ‘কিশোর প্রেম থেকে দেশাত্মবোধ— জীবনের প্রতিটি বয়সের আবেগের মূর্ত প্রকাশ ছিল যাঁর সুরেলা কণ্ঠে, তাঁকে হারিয়ে কেমন যেন একা হয়ে পড়লাম। কোথাও একটা অবলম্বন যেন সরে গেল, এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে।’ সন্দেহ নেই বন্ধুর জবানিতে আসলে নিজের কথাও বলছিলেন বর্ষীয়ান এই অভিনেতা। পীযূষবাবুর কথায়, “কে বলে ‘ও মেরে ওয়াতন কি লোগোঁ’ শুধু নেহরুর চোখে জল এনেছিল? বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা যোদ্ধাদের কাছেও এই গান ছিল টনিক, শপথ-সঙ্গীতের মতো। লতার মৃত্যুসংবাদ সকাল সকাল হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশে।”
শনিবারে বাংলাদেশের টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদ মাধ্যম, সমাজমাধ্যমেও প্রতিধ্বনি উঠেছে সেই হাহাকারের। রুনা লায়লা থেকে সাবিনা ইয়াসমিন বলে চলেছেন সতত বিনয়ী এই মহান শিল্পীর সঙ্গে তাঁদের মুহূর্ত যাপন ও আলাপচারিতার কথামালা। নতুন দেশটির সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিস্ময়, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি লতার মুগ্ধ শ্রদ্ধা জেনেছে বাংলাদেশ। স্বজনবিয়োগের যন্ত্রণা পেয়েছেন তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফে বিস্তৃত এক ‘বিদেশ’-এর বাসিন্দারা। প্রথাসম্মত শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবু কেন যেন ১৯৭২-এর পরে লতা মঙ্গেশকরের আর কখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি ঢাকা কিংবা বাংলাদেশের অন্য কোনও শহরে। চেষ্টা হয়েছিল কয়েক বার। যেমন সেনাশাসক হুসেইন মহম্মদ এরশাদের আমলে। ভারত থেকে অনেক শিল্পী তাঁর অতিথি হয়ে ঢাকায় গিয়েছেন, অনুষ্ঠান করেছেন। এরশাদ খুব চেয়েছিলেন, লতাজিও আসুন। নিজের অনীহা স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ে প্রকাশ করেননি কখনও লতা। কিন্তু সেনাশাসকের দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনের আহ্বানে সাড়াও দেননি সুরের সরস্বতী।