ছবি এপি
গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের প্রিয় ও নিরাপদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে। অনেক দিন অফিসে যাওয়া হয় না। গত দু’মাসে আমার এই সুরক্ষিত, নিশ্চিন্ত অ্যান আরবারের খুদে জগৎটা কী রকম বদলে গিয়েছে। গাড়ির রিয়ার উইন্ডো দিয়ে দেখি, অনেক পুলিশের গাড়ি। জনাপঞ্চাশের মিছিল আসছে। মুখে মাস্ক পরা কিছু মানুষ, অধিকাংশই ছাত্রছাত্রী। শান্ত পদক্ষেপ, কারও হাতে প্ল্যাকার্ড, কারও হাতে মোমবাতি। রাস্তায় নেমেছে আমেরিকার মানুষ। সব রঙের মানুষ। আমাদের সময় বড়ো আকুলভাবে কাঁদছে। তার ক্রন্দন শুনি আমি, ভিতরে, বাহিরে। নৈরাজ্য চলছে সারা আমেরিকায়, ভাঙচুর, লুঠতরাজ। এ দেশে আছি চব্বিশ বছর, জীবনের অর্ধেকের থেকে বেশি সময়। মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়েছিলাম ২০১২ সালে, জীবনের প্রথম ভোটটা বারাক ওবামাকে দেব বলে। এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল সেটা। আজ আর এক সন্ধিক্ষণ।
গাড়িটা রাস্তার ধারে রেখে, চটজলদি একটা মাস্ক পড়ে, গ্লাভস পরে দ্রুতপায়ে হেঁটে আমি যোগ দিই ওই মিছিলে। বিকেল হয়ে আসছে তখন। আকাশে অস্তমান সূর্যের রক্তিমাভা। পেছনের সারির দু’টি মেয়ে সরে আমায় জায়গা করে দেয়। যাতে কারও পাশে আমি হাঁটতে পারি একই সরলরেখায়। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। কাউকে চিনি না ওই মিছিলে, এরা আমার কন্যাসমা। হাঁটতে হাঁটতে অনেক ভাবনা মনে ভেসে আসে। চারশো বছরের বৈষম্যের, অত্যাচারের ইতিহাস। কোভিডের প্রতিষেধক
টিকা বা নিরাময় বেরোলেও বেরোতে পারে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, চামড়ার অতিরিক্ত মেলানিনের জন্য এই অসম বিভাজনের কোনও মহৌষধি আমরা খুঁজে পাইনি আজও, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গিয়েছে। তবু আমরা গর্ব করি আমাদের মহান সভ্যতা নিয়ে, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান নিয়ে, আলোকিত, বিদগ্ধ মন নিয়ে। প্রগতির সংজ্ঞাটা আমরা তৈরি করে নিয়েছি নিজেদের সুবিধে মতো। আমরা প্রশ্ন করতেও ভুলে যাই, এত আত্মমগ্ন আমাদের পৃথিবী। এই মিছিলের প্রতিবাদের পরে বাড়ি ফিরে গিয়ে আমিও হয়ে যাব কথায় ভরা, ফোঁপরা এক অধ্যাপক।
অ্যান আরবারের এই সুরক্ষাচক্র থেকে দু’পা বেরোলেই চল্লিশ মাইল দূরে ডেট্রয়েট। জাতীয় মানচিত্রে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ডেট্রয়েটে খুবই বেড়েছিল, এখন নিয়ন্ত্রণে এলেও, মিশিগানের কোভিড-সংক্রান্ত মৃত্যুর এক চতুর্থাংশ ডেট্রয়েটে। সাত লক্ষ লোকের এই শহরের আশি শতাংশ বাসিন্দা আফ্রো-মার্কিন। পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, দারিদ্র—ঐতিহাসিক ভাবে দীন এই শহরে কোভিডের মৃত্যুহার বাড়িয়ে দিয়েছে। আর্থসামাজিক এই অসাম্য পরিষেবা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোর মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে। পাঁচ বছরের মেয়ে স্কাইলার হারবার্ট, ডেট্রয়েটের প্রথম শিশু যে কোভিড-সংক্রান্ত কারণে মারা যায়, তার বাবা মায়ের সুযোগ ও অধিকার ছিল না নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাড়িতে বসে থাকার, তাদের রোজ কাজে যেতে হয়েছে। সেই দৈনন্দিন কাজ থেকে এসেছে ভাইরাস, নিয়তির মতো তাদের শিশুকন্যার দেহে। অসহায় সমর্পণ। আজ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু চারশো বছরের বুটের নীচে চাপা পড়া অজস্র কৃষ্ণকায় মানুষ ক্রমাগত বলেই চলছে “আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না আর।” আমরা মূক ও বধির হয়ে সেই আর্তনাদ মেনে নিয়েছি। আজ এই মেনে না-নেওয়ার আগুন আমায় অনুপ্রাণিত করে।
এই সব ভাবতে ভাবতে আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিল এসে দাঁড়ায় একটি বড় পাথরের সামনে, যে পাথরে গ্রাফিতি করে এই শহরের মানুষ প্রতিবাদ জানায়। প্রায় একশো বছর ধরে এই ট্র্যাডিশন। নতজানু হয়ে বসি সেই লাইমস্টোন রকের সামনে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় গণিতবিদ রিমানের কথা। রিমান যখন বুঝলেন তাঁর নতুন জ্যামিতিক ভাবনার জন্যে নতুন সব স্পেস ও মাত্রা তৈরি করা দরকার, তখন উনি ইউক্লিডের সব পুরনো তত্ত্ব ছেড়ে একদম নতুন করে শুরু করলেন। আর সেই সৃষ্টির ওপরেই নির্মাণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্ব। আমাদের সমাজের একটা এ রকম র্যাডিকাল পরিবর্তন দরকার বলে আমার মনে হয়। গরীবের
ছেলেমেয়েরা ভাল স্কুলে যেতে পারবে না, এটা কেন ধরে নিয়েছি আমরা? এই সব আন্তরিক উত্তেজনার মধ্যে, মগজের কার্ফু ও স্লোগানের মধ্যে, আমাদের সমবেত মিছিল শেষ হয়ে যায় প্রার্থনার সুরে। ঘরফেরতা আমি গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে উদাত্ত বেসুরো গলায় চীৎকার করে গাইতে থাকি “এ পরবাসে রবে কে... হায়! কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে।” আর আমার চোখ থেকে মাস্কের আড়ালে ঢাকা গালের মসৃণ বাদামি চামড়ার ওপর অশ্রু ঝরে পড়ে, যার কোন রঙ নেই।
(লেখক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বায়োস্ট্যাটিসটিক্স, ইউনাভির্সিটি অব মিশিগান)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy