শেখ হাসিনা। ছবি: রয়টার্স।
শনিবার সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সূত্রের খবর, সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের অফিসারেরা সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও বাহিনীর মাঝারি স্তর থেকে কিছু অন্য সুর শোনা গিয়েছিল, যা ছিল গভীর ইঙ্গিতবাহী। কারণ, ১৯৭৫-এর অগস্টের ১৫ তারিখে অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবকে হত্যা করেছিল মাঝারি ও নীচের স্তরের সেনারাই।
উদ্বেগের এই দু’টি প্রসঙ্গ তুলে পরিস্থিতি জানার জন্য ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম আওয়ামী লীগের শরিক দলের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে, যিনি শনিবার দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্তত ৪০ মিনিট কথা বলেছেন সরাসরি। সেই নেতা জানান, শেখ হাসিনা ১০০ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে রবিবার বিষয়টি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কারণ, তাঁর দাবি ছিল, তাঁর পদত্যাগ চাওয়ার পরেই স্পষ্ট হয়েছে কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীরা বিএনপি ও জামাতে ইসলামির অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে মাঠে নেমেছে। শেখ হাসিনার হিসেব ছিল, রবিবার এই এক দফা দাবিতে (ইস্তফার) জমায়েতে তেমন লোক হবে না। রবিবার গ্রেফতার হওয়া সমস্ত সাধারণ ছাত্রকে তিনি মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, যে সমস্ত পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য আন্দোলনকারীদের দিকে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তাদের দ্রুত গ্রেফতার এবং কঠোর শাস্তির নির্দেশ দেবেন বলে প্রস্তুত হয়েছিলেন। হাসিনার দৃঢ় ধারণা ছিল, তাঁর পদক্ষেপে খেলা ঘুরে যাবে। এই কারণেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে দিয়ে হাসিনা দেশের সর্বত্র পাল্টা জমায়েতের ডাকও দিয়েছিলেন।
কিন্তু রবিবার সকাল থেকে যে ভাবে খুনোখুনি, পুলিশকে আক্রমণ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পিটিয়ে মারার মতো ঘটনা ঘটতে লাগল, শেখ হাসিনার আর কিছুই করা হয়ে উঠল না। অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্ফু সান্ধ্য আইন এবং ছুটি ঘোষণা করা হল। তত ক্ষণে প্রাণ চলে গিয়েছে অন্তত ১০০ জনের। আওয়ামী লীগের জমায়েত থেকে যেমন আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করা হয়েছে, দেখা গিয়েছে সশস্ত্র এক দল লোককে, যারা গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করছে থানা, পুলিশ সুপারের বাসভবন এবং আওয়ামী লীগের পরিচিত নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে। শোনা গেল, জরুরি অবস্থা জারি করার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী রবিবার দিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাদের এক অংশ পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তারা নিতে পারবে না। দেশের মানুষের ওপর গুলিগোলাও চালাবে না। অগত্যা শেখ হাসিনা আন্দোলন ঠেকাতে ভরসা করলেন দলের ছাত্র ও যুবকর্মীদের উপরেই। তবে এক দফা দাবির পক্ষে এত মানুষ রাস্তায় বেরোলেন যে কারও পক্ষেই তা নিবৃত্ত করা সম্ভব হল না।
কিন্তু এই পরিণতি কি একান্তই আকস্মিক? সন্দেহ নেই, শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। জীবনযাপনের মান উন্নত হয়েছে। মেট্রো রেল, পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক স্তরে উন্নীত করেছে। আবার একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী পক্ষের জন্য সামান্যতম জায়গাও তিনি ছেড়ে দেননি। পরপর তিনটি নির্বাচনকে হাস্যকর পর্যায়ে পরিণত করে, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার নীতিতে তিনি অবিচল ছিলেন। পর্যবেক্ষকেরা বারবারই বলেছিলেন, শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছে সেনাবাহিনীর একাংশ এবং পুলিশ, গোয়েন্দা, গুপ্তচরেরা। অভিযোগ, হামলা, মামলা, গুম ও খুনের অস্ত্র প্রয়োগ করে বিরোধী পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার কাজ শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর সরকার পক্ষের অনুগত এই অংশ। আর সাধারণ মানুষ, সুষ্ঠু ভোট পর্ব হলে যাঁদের অনেকের ভোটই হয়তো আওয়ামী লীগের পক্ষেই পড়ত, তাঁরাও ভোট দিতে না পেরে ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করলেন। উঠে আসে এমন এক প্রজন্ম, যাদের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই নেই। এই নব্য প্রজন্মের কাছে ভোট দিতে না পারা অসন্তোষের বড় কারণ।
গোল বাঁধল বিশ্ব জুড়ে অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন, হামাস-ইজ়রায়েলের যুদ্ধে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে যাওয়ায়। জ্বালানি তেল কিনতে পান্তা ফুরানোর হাল হয় বাংলাদেশেরও। দ্রুত কমেছে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার। ডাল, ভাত, পেঁয়াজ, আনাজ, মাছ-মাংস, ডিমের দাম যখন রকেটের গতিতে বেড়েছে, শেখ হাসিনা উপহার দিয়েছেন সেতু, মেট্রো রেল, নিজস্ব উপগ্রহ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম যাওয়ার সুড়ঙ্গ পথ। একই সঙ্গে সরকারের কিছু মন্ত্রী, আমলা, সুবিধাভোগী সরকারিকর্তা, পুলিশকর্তা, সেনাকর্তার শত শত কোটি টাকার সম্পদ সাধারণ মানুষকে বিরূপ করে তোলে। সামনে আসে বিদেশে অর্থ পাচারের বহু ঘটনাও।
আওয়ামী লীগ নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রতিভূ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু সেখানেও শেখ হাসিনার বিভিন্ন বিতর্কিত পদক্ষেপ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সশস্ত্র মৌলবাদী জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক জামাতে ইসলামিকে এক রকম উচ্ছেদ করেই ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা। আবার এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অপছন্দ হতে পারে চিন্তা করে হেফাজতে ইসলামি নামে মৌলবাদী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেন তিনি। তাদের কথা মেনে পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন আনেন। ব্লগারদের শুরু করা যে শাহবাগের আন্দোলন যুদ্ধাপরাধী জামাতে ইসলামের নেতাদের ফাঁসি দিতে বাধ্য করল, তাকেও হাসিনা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। এই ভাবে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক শক্তির এক অংশের সমর্থন হারিয়ে ফেলেন তিনি। এই ভাবে কখন যে পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে, তা যদি টের পেতেন শেখ হাসিনা, পরপর তিনটি নির্বাচন হয়তো সুষ্ঠু ভাবে হতে দিতেন।
অবশেষে সেনাবাহিনীর নির্দেশক্রমে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেশত্যাগ। সোমবার এক দিকে যখন উন্মত্ত জনতা গণভবনে ঢুকে লুটপাট শুরু করল, আর এক দল ভাঙতে শুরু করল শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি। হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশ কোন দিকে যাত্রা শুরু করল, এ ছবি কি তারই দিগনির্দেশক হয়ে রইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy