নিহতদের স্মৃতিতে মোমবাতি মিছিল । ওরেগন শহরে শুক্রবার। ছবি: এএফপি।
হাত তুলে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিলেন পড়ুয়া, শিক্ষক-শিক্ষিকারা। বন্দুক উজিয়ে তাঁদের শাসাচ্ছিল ক্রিস হারপার মারসার। উঁচু গলায় বলছিল, ‘‘তোমরা খ্রিস্টান, তাই মুহূর্তের মধ্যেই ঈশ্বরের দর্শন পাবে!’’
বৃহস্পতিবার রাতে ওরেগন প্রদেশের রোজবার্গ শহরে উমকপুয়া কমিউনিটি কলেজের ক্যাম্পাসে বছর ছাব্বিশের ওই বন্দুকবাজের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। গুরুতর জখম ২০। গুলি করার আগে কলেজের পড়ুয়া, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ধর্ম জেনে নিচ্ছিল সে। খ্রিস্টান জানলেই গর্জে উঠছিল বন্দুক। দিনের শেষে মারা গিয়েছে হারপার নিজেও। একটি সূত্র বলছে, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে তার। তবে অধিকাংশ প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, শেষমেশ আত্মহত্যা করেছে সে।
আমেরিকার স্কুল-কলেজে বন্দুকবাজের হানা অবশ্য নতুন নয়। সে ১৯৯৯-এ কলোরাডোয় কলম্বিয়ান হাইস্কুলের হামলাই হোক, বা ২০০৭ সালে ভার্জিনিয়ার পলিটেকনিক কলেজ। অথবা সম্প্রতি কানেক্টিকাটে স্যান্ডিহুক এলিমেন্টারি স্কুল। গুলিতে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে মার্কিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই তালিকায় নয়া সংযোজন উমপকুয়া। অন্য ক্ষেত্রে হামলার হিসেব ধরলে তালিকাটা আরও দীর্ঘ। তথ্য বলছে, চলতি বছরই আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ৩০০টি এ রকম হামলা হয়েছে।
বন্দুক-হামলার প্রেক্ষিতে বরাবর দেশের বন্দুক-আইন কঠোর করার পক্ষেই সওয়াল করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এ বারও ব্যতিক্রম হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে হোয়াইট হাউসে যখন সাংবাদিক বৈঠক করছিলেন, চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট। বন্দুক-আইন সংশোধনীতে বারবার বাধা দেওয়ায় ভর্ৎসনা করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান আর জাতীয় রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন লবিকে। বলেছেন, ‘‘ওরেগনে যা ঘটেছে, রাজনৈতিক ভাবে আমেরিকা নিজেই তা বেছে নিয়েছে।’’ বর্তমান আইনের দৌলতে, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই নিজের কাছে বন্দুক রাখতে পারেন আমেরিকায়। রিপাবলিকানদের উদ্দেশে তাই ওবামার কটাক্ষ, ‘‘বন্দুক থাকলেই আমরা নিরাপদ, আর কত দিন এ কথা বলবেন?’’
রোজবার্গ শহরের যে কলেজটিতে বৃহস্পতিবার হামলা হয়েছে তাতে পড়ুয়ার সংখ্যাটা হাজার তিনেক। দুপুর নাগাদ হারপার যখন ঢুকল, তখন পুরোদমে ক্লাস চলছে ক্যাম্পাসে। প্রথমে কলাবিভাগ, তার পর বিজ্ঞান, লাইব্রেরি— দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হারপার। কলেজের এক রক্ষী জানান, তার গায়ে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হাতে, পিঠে তিন-তিনটে বন্দুক। সঙ্গে প্রচুর কার্তুজ। বড়সড় হামলার পরিকল্পনা নিয়েই সে এসেছিল বলে অনুমান পুলিশের। তবে হামলার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়।
কলাবিভাগের ১৬ নম্বর ঘরটিতে ছিলেন বছর কুড়ির ক্যাসেন্ড্রা ওয়েলডিং। ভাষাশিক্ষার ক্লাস চলছিল সেখানে। আতঙ্ক কাটিয়ে ক্যাসেন্ড্রা বললেন, ‘‘একসঙ্গে অনেকগুলো বেলুন ফাটলে যেমন শব্দ হয়, ঠিক তেমন শব্দ পেলাম।’’ তাঁর বর্ণনা, আওয়াজ শুনে এক অশিক্ষক মহিলাকর্মী ছুটে এসে দরজা বন্ধ করতে যান। আবার একটা শব্দ। লুটিয়ে পড়লেন ওই মহিলা। সরাসরি তাঁর পেটে গুলি করে হারপার। পিঠের ব্যাগ জড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন ক্যাসেন্ড্রা ও তাঁর সহপাঠীরা। হারপারের শিকার হন কলাবিভাগের এক অধ্যাপকও। সামনে থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে।
মাত্র তিন সপ্তাহ আগে রোজবার্গের কলেজটিতে যোগ দিয়েছেন ব্যাডিন উইন্ডার (২৩)। গুলির আওয়াজে প্রথমে ভেবেছিলেন বড়সড় কিছু ভেঙে পড়েছে। পরে ভুল ভাঙে। ৯/১১-র সঙ্গে হামলার তুলনা করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। বেঁচে ফিরব না ভেবে নিয়ে ফোন করছিলাম বাড়িতে।’’ শিরদাঁড়ায় গুলি লাগলেও বেঁচে গিয়েছেন বছর আঠারোর অ্যানাস্টেসিয়া বয়লান। শুক্রবারই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছে। হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনিই জানান, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাই হামলার লক্ষ্য ছিল। বয়লানের পিঠে গুলি চালায় হারপার। লুটিয়ে পড়লে পা দিয়ে ঠেলে যাচাই করে নেয় আদৌ বেঁচে আছেন কি না। যন্ত্রণা সহ্য করে চোখ বুজে পড়েছিলেন বয়লান।
কলেজে হামলার খবর তত ক্ষণে রটে গিয়েছে। চত্বর ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। কলেজ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে একটি বিনোদনপার্ক। পুলিশের নির্দেশে খালি করে ফেলা হয় সেটি। এলাকাবাসীকে ঘরবন্দি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। কলেজের উল্টো দিকেই থাকেন লরি অ্যান্ড্রু। বাজি ফাটার আওয়াজ পেয়ে বাইরে আসেন। বারান্দা থেকে দেখেন, কম্বলে জড়িয়ে রক্তাক্ত এক তরুণীকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
শুক্রবার সকালে হামলাকারীর পরিচয় স্পষ্ট করেছে পুলিশ। জানানো হয়েছে, হারপার রোজবার্গেরই বাসিন্দা। জন্ম ইংল্যান্ডে। তবে ছোটবেলাতেই সপরিবার চলে আসে আমেরিকায়। বাবা ল্যান মারসারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আর পাঁচ জনের মতো ঘটনায় আমরাও সমান হতবাক। আমার পরিবারের জন্য বিধ্বংসী দিন ছিল এটা।’’ হারপারের প্রতিবেশী ব্রন্টে হার্ট জানান, ছোট থেকেই ঘরকুনো ছিল সে। বেশিরভাগ সময় অন্ধকার বারান্দায় একলা বসে থাকত।
একটি অনলাইন ডেটিং সাইটেও হারপারের প্রোফাইলের সন্ধান মিলেছে। তাতে নিজেকে ‘অধার্মিক’ বলে দাবি করেছে সে। সেই সঙ্গে ‘ডাজ নট লাইক অর্গানাইজড রিলিজিয়ন’ বলে একটি গ্রুপেরও সে সক্রিয় সদস্য ছিল বলে জানা গিয়েছে। হারপারের প্রোফাইল ঘেঁটে পুলিশ জেনেছে, কলেজে হামলা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আগেই হুঁশিয়ারি জারি করেছিল সে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy