পাকিস্তানে কারাবন্দি ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানকে আলোকবর্তিকা করে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ন’মাসের মরণপণ যুদ্ধে জয় আসে, আসে স্বাধীনতা। মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার বুধবার, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালন করল শেখ মুজিবের নামটুকু উচ্চারণ ছাড়া। রাষ্ট্রপতি বা প্রধান উপদেষ্টার বাণীতে স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার কথা আছে। কে করলেন, কী ভাবে করলেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে করলেন— কোনও উল্লেখই রাখা হয়নি তার।
যে দিন মুজিবের উল্লেখ না রেখে স্বাধীনতা দিবস পালন করছে বাংলাদেশ, সেই দিনই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি চিঠিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানান। চিঠিটি বাংলাদেশে ভারতের হাই-কমিশন থেকে প্রকাশ করা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘এই দিনটি আমাদের দুই দেশের ইতিহাস ও ত্যাগের দলিল। যা আমাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত তৈরি করেছে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুক্ত সব সময়ে আমাদের সম্পর্কের পথপ্রদর্শক আলো। আমরা এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
কূটনৈতিক শিবির মনে করছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা। বর্তমান পরিস্থিতিতে যা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ শাহাবুদ্দিনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
আজ চার দিনের সফরে চিনে গিয়েছেন ইউনূস। তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নিজের প্রথম দ্বিপাক্ষিক বিদেশ সফরে ভারতেই আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই মর্মে গত ডিসেম্বরে ঢাকা বার্তা পাঠালেও দিল্লির তরফে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। শফিকুলের দাবি, এই চিন সফর চূড়ান্ত করার আগেই ভারতে আসার কথা ভেবেছিলেন ইউনূস।
এ দিন বাংলাদেশের সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ‘জয় বংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান তুলে মিছিল করেন এক দল যুবক। তাঁরা সৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘ছাত্র-জনতা’ নামধারী ইউনূসের এক দল সমর্থক। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি এ দিনও দেওয়ার ‘অপরাধে’ জাতীয় স্মৃতি সৌধ থেকে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। এঁরা মুক্তিযোদ্ধাপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের পদাধিকারী। সেই সময়ে কর্তব্যরত এক সাংবাদিক ইফতিকার উদ্দিন পুলিশকে প্রশ্ন করেন, “স্বাধীনতা দিবসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া কি অপরাধ? না কি নিষিদ্ধ স্লোগান?” পুলিশ জবাব না দিয়ে আটকদের নিয়ে দ্রুত সরে যায়। তার পর থেকেই একটি টিভি চ্যানেলের এই সাংবাদিককে নিশানা করে সমাজমাধ্যমে খুনের হুমকি দেওয়া শুরু করেছে জঙ্গি মনোভাবাপন্ন ও জামায়াতপন্থীরা। ইফতিকার সমাজমাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।
দেশে তো বটেই, বিদেশি কূটনৈতিক ভবনগুলিতেও এ বারের স্বাধীনতা দিবস পালনে শেখ মুজিবকে ব্রাত্য রাখা হল। দূতাবাসগুলি থেকে মুজিবের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। কলকাতা উপ-দূতাবাস ও নানা দেশের যে সব কূটনৈতিক ভবনে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য রয়েছে, বেশ কিছু দিন আগে থেকেই তা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। এ দিন প্রায় সব দূতাবাসে স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা এবং বিদেশ উপদেষ্টার বাণী পাঠ করা হয়। তার পরে আলোচনা সভাতেও কূটনীতিকেরা শেখ মুজিবের উল্লেখ সযত্নে এড়িয়ে যান। যেমন এড়িয়ে যান পাকিস্তানের উল্লেখও। তার বদলে ‘দখলদার’ শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়েছে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের তৈরি আধ ঘণ্টার একটি তথ্যচিত্র সব কূটনৈতিক ভবনে দেখানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ইউরোপের একটি দেশের বাংলাদেশি কূটনীতিক জানিয়েছেন, ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ নামে এই তথ্যচিত্রটিতে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথাই নেই। পুরোটাই শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের কাহিনি। তাঁর কথায়— “এই তথ্যচিত্র দেখিয়ে দিয়েছে, ইউনূস সরকার এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছে একাত্তর নয়, জুলাই আন্দোলনই স্বাধীনতা আন্দোলন।” ওই কূটনীতিক জানান, সরকারি তথ্যচিত্রটিতে সেন্সরের সাধারণ নিয়মটুকুও না মেনে অবাধে হিংসা ও রক্ত দেখানো হয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহের ক্লোজ় আপ, ছিন্নভিন্ন দেহাংশ দেখানো হয়েছে— যা দর্শককে আতঙ্কিত করে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কেন্দ্র কলকাতার উপ-দূতাবাস ও আগরতলার সহকারী দূতাবাসেও মুজিবের ছবি, এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর ছবিও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দু’জায়গাতেই ওই তথ্যচিত্র প্রদর্শন হয়েছে স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গ হিসাবে। এর মধ্যেই ঢাকার চারুকলা অনুষদ জানিয়েছে, পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় রংপুরে নিহত ছাত্র আবু সাইদের প্রতিকৃতি থাকছে না। তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিলেও সাইদের পরিবার এ বিষয়ে আপত্তি করায় পিছিয়ে আসা হয়েছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)