ভারত ও চিনের মধ্য়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ফের উত্তেজনা। পূর্ব লাদাখে। -ফাইল ছবি।
পড়শির মাথা কাটতে যাবে কেন? নিজের পাঁচিলের ঠিক ও-পারে আপাতত কোনও রক্তপাতই চায় না চিন। অযথা উত্তেজনা, রক্তপাত যে শান্তিতে উপার্জনে বাগড়া দেয়! বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন করোনা সঙ্কটে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘তিরবিদ্ধ’ হয়ে রয়েছে চিন। এমনটাই বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তাঁদের মতে, পাঁচিলের ও-পারের পড়শিকে তাই বেজিং শুধুই ভাবিয়ে রাখতে চায়। তার জন্য যেটুকু বাগবিতণ্ডা, শক্তির আস্ফালন দরকার, শুধু সেইটুকুই করতে চায় চিন। ফলে, পড়শির সঙ্গে যেমন সাময়িক মিটমাট হয়ে যায়, তিন বছর আগের ডোকলামের মতো এ বার পূর্ব লাদাখের প্যাংগং হ্রদ আর গালওয়ান উপত্যকার উত্তেজনাও থিতিয়ে যাবে, রাজনৈতিক আলাপ, আলোচনার মাধ্যমেই। তবে সেটাও সাময়িক ভাবে।
বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, পরে কিন্তু ফের উত্তেজনার সৃষ্টি হবে ভারত ও চিনের মধ্যে থাকা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায়। হয়তো আরও ঘন ঘন। আর সেই উত্তেজনার মাত্রায় তারতম্য থাকবে, এলাকা ও সমসাময়িক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে।
উহানে উৎপত্তির পর কোভিড-১৯ ভাইরাস যদি বিশ্বত্রাস না-ও হয়ে উঠত, তা হলেও পড়শি ভারতকে এই শক্তির আস্ফালন দেখাতেই হত বেজিংকে। আদ্যোপান্ত ব্যবসা-মনস্ক চিনের রুটি-রুজির প্রয়োজনে। পাকিস্তান, নেপাল-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের সঙ্গে উন্নততর বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রয়োজনে নির্মীয়মাণ চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)-কে সুরক্ষিত ও পড়শির নজরদারির ‘বাইরে’ রাখার জন্য। এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তাই প্যাংগং হ্রদ ও গালওয়ান উপত্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে যে ‘যুদ্ধে’ পৌঁছবে না, তা নিয়ে অন্তত কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ এক রকম নিশ্চিতই। তবে তাঁরা মনে করছেন, এই ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’টা চলবে। কিছু দিন চলার পর তা মেটানো হবে লোকদেখানো ভাবে। তার কিছু দিন পর পরিস্থিতি বুঝে সেই ‘খেলা’ আবার শুরু হবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, চিনেও তো একটা জাতীয়তাবাদী শক্তি বা শক্তিগোষ্ঠীকে সামলাতে হয় শাসক দল চিনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) ও প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংকে। করোনা সঙ্কটের জেরে চিনের অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে আর যে ভাবে প্রায় গোটা বিশ্বের আঙুল উঠেছে চিনের দিকে, তাতে সেই জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সামলেসুমলে রাখতে কোনও প্রতিপক্ষ পড়শির বিরুদ্ধে শক্তির আস্ফালনটা জরুরি হয়ে পড়েছে চিনা প্রেসিডেন্টের। আর তার জন্য খুব সহজে খুব অল্প সময়ে যেটা করা যায়, বেজিং সেটাই করেছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বিতর্কিত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করেছে, পূর্ব লাদাখের বেশ কয়েকটি এলাকায়।
শিবাশিস মনে করেন, “এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা এখন চিনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রে শাসক দল বিজেপি-র। কারণ, দ্রুত করোনা সংক্রমণ, তা রুখতে আপাতত দু’মাসেরও বেশি ধরে চলা লকডাউনের জেরে ভারতে যে ভাবে বেকারি, ছাঁটাইয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে চলেছে, যে ভয়াবহ ঋণাত্মক আর্থিক বৃদ্ধির অশনি সংকেত মিলেছে ইতিমধ্যেই, কাঁধ থেকে তার বোঝাটা হাল্কা করার জন্যই আবার একটা দেশপ্রেমের জোয়ারের প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রী মোদীর। আর সেটা আরও জোরালো হয় পাকিস্তান বা চিনের সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কা থাকলে বা তা বাড়িয়ে দেখানো সম্ভব হলে।’’
তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, নিজেদের স্বার্থেই এই পর্যায়ের ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’টা কিছু দিন চালিয়ে যেতে চাইবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও চিনের প্রেসিডেন্ট।
আরও পড়ুন- তপ্ত ভারত-চিন সীমান্ত, মধ্যস্থতা করতে চেয়ে টুইট ডোনাল্ড ট্রাম্পের
আরও পড়ুন- দৃষ্টি ঘোরাতেই কি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চিনের আগ্রাসী তৎপরতা, না অন্য কিছু!
কত দিন ধরে চলবে এই পর্যায়ের ‘খেলা’? সেটা অবশ্য এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না ওয়াকিবহাল মহলের।
“তবে ‘খেলা’টা আরও কিছু দিন চললে চিনা প্রেসিডেন্টের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীই বেশি খুশি হবেন”, বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সংযুক্তা ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যে ভাবে ভারতে লাফিয়ে বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের, ভারতের অর্থনীতি যে ভাবে সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে এই পরিস্থিতিতে, তাতে দেশপ্রেমের জোয়ারকে কাজে লাগিয়ে জনমতকে পাশে রাখার প্রয়োজনটা চিনফিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি মোদীর। চিন তার রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে যেমন অনেক কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তেমনই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে জনমতকেও। ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় সেটা পারে না। তা ছাড়াও করোনা সঙ্কটের জেরে আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-সহ গোটা বিশ্ব অভিযোগের আঙুল তোলায় চিন যে ভাবে কোণঠাসা হয়ে রয়েছে আপাতত, তাতে ভারতের সঙ্গে কোনও যুদ্ধ বা সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক ভাবে আরও একঘরে হয়ে পড়ার ঝুঁকিটা নিতে যাবে কেন?”
উত্তেজনায় থমথম করছে ভারত ও চিনের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন এলাকা। পূর্ব লাদাখে। - ফাইল ছবি।
তাই এ বার ডোকলামের মতো ঘটনাটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। মাসদু’য়েক কেটে যাওয়ার পরেও ২০১৭-য় ডোকলাম পরিস্থিতি নিয়ে সুর তেমন নরম করতে দেখা যায়নি বেজিংকে। এ বার কিন্তু সার্বভৌমত্বের কথা বলেও চিনকে আলাপ, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানোর কথা অনেক আগেভাগেই বলতে শোনা যাচ্ছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবাজীপ্রতিম বসু বলছেন, ‘‘এখন আগবাড়িয়ে যুদ্ধের পথে এগোলে বা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করলে আন্তর্জাতিক ভাবে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে চিন। করোনা সঙ্কটের জেরে আমেরিকা-সহ বহু দেশ যখন প্রায় কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে চিনকে, তখন কেন এই ঝুঁকি নিতে যাবে বেজিং?”
তবে চাপ সৃষ্টির চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে বেজিং। তার নানা কারণ রয়েছে। ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত পৌঁছনোর রাস্তাঘাট প্রায় সুগম করে ফেলেছে। উন্নত পরিকাঠামো বানিয়ে ফেলেছে ওই সব এলাকায়। যাতে পাকিস্তান, নেপাল-সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর ধরে নিশ্চিন্তে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে উন্নত করার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেজিংয়ের উদ্বেগ বেড়েছে। করোনা সঙ্কটের জেরে চিন থেকে মার্কিন পুঁজি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভারতে আসার উপক্রম হয়েছে। বোঝার উপর শাকের আঁটি, ভারত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (‘হু’) কার্যনির্বাহী এগজিকিউটিভ বোর্ডের চেয়ার হয়েছে। করোনা সঙ্কটের জেরে হু-র যে বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই চিন-বিরোধী।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার বলছেন, “এই সবই বোঝাচ্ছে, সাময়িক ভাবে মিটে গেলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভবিষ্যতেও এই উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। আর সেটা হবে আরও ঘন ঘন। তাই এটা শুধুই কোনও নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনা নয়। এটা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়ারই অংশ।’’
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দু'পাড়ের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় বরফ গলতে শুরু করলেই প্রায় ফিবছর ভারত ও চিনের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বরফটা আরও ভাবে জমে ওঠে। তার কারণও রয়েছে। শিবাজীপ্রতিম ও অনিন্দ্যজ্যোতির কথায়, “প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়েও তো বিরোধ মেটেনি এখনও। তার বহু এলাকার এ-পার বা ও-পার আদতে কার, চিন না ভারতের, তা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। ফলে, বরফ গললেই দু'দেশের সেনা চলে যায় এ-দিক ও-দিক। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে। এই প্রক্রিয়া আগামী দিনেও চালু থাকবে।’’
যার মর্মার্থ, দু'পক্ষের সেনাদের ‘অনুপ্রবেশ’ আর ‘রণং দেহি’ অবস্থা ভবিষ্য়তেও দেখা যাবে ভারত ও চিনের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর। সমস্য়াটা আজ-কালের নয়, দীর্ঘমেয়াদিই!
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy