Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Rishi Sunak

বাড়তি রোজগারের জন্য সাইকেল চালিয়েছেন, সিগারেট খাননি, সুনকের বেড়ে ওঠাও ঋষিসুলভ

ভাগ্যান্বেষণে ঋষির দাদু-দিদার বিদেশযাত্রা থেকে মায়ের ফার্মেসি তৈরি করা, কঠোর পরিশ্রম এবং লেখাপড়া। এটাই ব্রিটেনের হবু প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের মূল পুঁজি এবং বুনিয়াদি শিক্ষা।

কেমন ছিল ঋষি সুনকের সফর।

কেমন ছিল ঋষি সুনকের সফর। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২২ ১৩:১৪
Share: Save:

তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল সাউদাম্পটন জেনারেল হাসপাতাল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটি ফার্মেসিতে। সাইকেলে চেপে বাড়ি বাড়ি প্রেসক্রিপশন পৌঁছে দেওয়া দিয়ে। যে যাত্রা তার সবচেয়ে বড় জংশনে এসে পৌঁছেছে সদ্য— ১০, ডাউনিং স্ট্রিট। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি আবাস।

তিনি— ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনক এ বার ব্রিটেন শাসন করবেন! মাত্রই ৪২ বছর বয়সে কনজ়ারভেটিভ পার্টির সদস্য ঋষি সে দেশের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে। গত সাত মাসে ঋষিকে নিয়ে তিন জন প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিতে দেখবেন ব্রিটেনবাসী।

সাউদাম্পটন জেনারেল হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে এক ব্যস্ত লোকালয়ে ছিল এক ওষুধের দোকান। নাম ‘সুনক ফার্মেসি’। সেই ‘সুনক’ এখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর শপথবাক্য পাঠ করবেন। ভাগ্যান্বেষণে দাদু-দিদার বিদেশযাত্রা থেকে মায়ের ফার্মেসি তৈরি করা, কঠোর পরিশ্রম এবং লেখাপড়া— এই ছিল ব্রিটেনের হবু প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের মূল পুঁজি এবং বুনিয়াদি শিক্ষা।

ঋষির পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের পঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা। স্বচ্ছন্দ জীবিকার খোঁজে সুনক পরিবারের সদস্যেরা পূর্ব আফ্রিকায় পাড়ি দেন। কিন্তু সেখানে প্রবল ভারত-বিরোধী মনোভাবের কারণে তাঁরা চলে যান ব্রিটেন। ঋষির মা ঊষার পরিবারের কাহিনিও তেমনই সাহসের। ঊষার মা, অর্থাৎ ঋষির দিদা ছিলেন তানজ়ানিয়ার বাসিন্দা। নাম ‘স্রাক্ষা’। সেখানে বাস করতেন পঞ্জাবি সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। বিয়ের পর ঋষির দিদা নিজের গয়না বিক্রি করে সেই টাকায় ব্রিটেন যাওয়ার টিকিট কেনেন। একটিই টিকিট। এবং সেটিও শুধু যাওয়ার, ফেরার নয়। ১৯৬৬ সালে স্বামী, সন্তানকে বাড়িতে রেখে রোজগারের উদ্দেশে একেবারে একা বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের লেস্টারে গ্রন্থাগারিকের কাজ নেন। বিদেশবিভুঁইয়ে একা একা এক বছর কঠিন পরিশ্রম করে যা উপার্জন করেছিলেন, তা দিয়ে পরিবারের খরচ চালানোর ক্ষমতা তৈরি করে ফেলেছিলেন স্রাক্ষা। পরে পরিবারের বাকিরাও চলে যান তাঁর কাছে। ঋষির মা ঊষা অস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়তেন। সেখানেই ডাক্তারি পড়ুয়া যশবীরের সঙ্গে তাঁর দেখা এবং পরিচয়। অতঃপর প্রেম এবং বিবাহ।

বিয়ের পর যশবীর-ঊষা সাউদাম্পটনে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের তিন সন্তান। ঋষি জ্যোষ্ঠপুত্র। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভাল ঋষি। আবার দারুণ আগ্রহ খেলাধুলোতেও। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি— সবই খেলতেন। ব্রিটেনের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষিকা জুডি গ্রেগরির কথায়, ‘‘ক্লাসে ঋষিকে দেখেছি সবচেয়ে শান্তশিষ্ট অথচ সকলের খেয়াল রাখা একটা ছেলে। ভিড়ের মাঝেও কী ভাবে যেন আলাদা করে সবার নজর কাড়ত ও।’’

ঋষির ভাই সঞ্জয় পেশায় মনোবিদ। বোন রাখি কাজ করেন রাষ্ট্রপুঞ্জে।

তবে চ্যাম্পিয়নদের জীবনেও ব্যর্থতা আসে। হয়তো অন্যদের চেয়ে বেশিই। কিন্তু তাঁরা যুদ্ধ করতে জানেন। তাঁরা ভালবাসেন লড়াই করতে। ঋষির প্রথম ব্যর্থতা ১৩ বছর বয়সে। ইচ্ছে ছিল ভাল স্কুলে পড়ার। কিন্তু তার খরচ ছিল অনেক। তাই বৃত্তি পাওয়া প্রয়োজন ছিল। খুব চেষ্টা করেও সেই বৃত্তি পাননি ঋষি। যা এখনও তাঁর জীবনের ‘সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা’ হিসাবে বর্ণনা করেন তিনি। জানান, তাঁর জন্য আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন বাবা-মা। একটি সাক্ষাৎকারে ঋষি বলেছিলেন, ‘‘ওই স্কুলে ভর্তি করার জন্য বাবা-মাকে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে। আমাদের ভাইবোনদের পড়াশোনার জন্য প্রচুর ত্যাগ এবং পরিশ্রম করেছেন বাবা-মা। আমাদের ভাইবোনদের শিক্ষার ব্যাপারে কোনও ফাঁক রাখতে চাননি ওঁরা।’’

কিশোর বয়সে ছুটির দিনে সাইকেল চালিয়েই বেশি সময় কেটেছে ঋষির। ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতেন। তাতে বাড়তি কিছু রোজগার হত। পরিবারকে সাহায্য করা হত। এক সময় সাউদাম্পটনে একটি রেস্তরাঁয় ওয়েটারেরও কাজ করেছেন। কিন্তু এত ভাল ছাত্র হয়েও রাজনীতিতে কেন এসেছিলেন ঋষি?

রাজনীতি নিয়ে অনেকের সাধারণ ভাবে অনাগ্রহ থাকে। তবে কলেজে পড়ার সময় থেকেই ঋষির মনে হত, শিক্ষিত মানুষদের আরও বেশি এবং সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করা উচিত। আখেরে একটি দেশের চালিকাশক্তি রাজনীতিই। ঠিকই ভাবতেন। নিজের প্রতিভা, পড়াশোনা এবং ভাগ্যের সহায়তার তাই মাত্র ৪২ বছর বয়সে সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রে তিনি। কে বলবে ঋষির রাজনৈতিক জীবনের উত্থান ঘটেছে স্রেফ গত সাত বছরে। অভাবনীয়!

সাফল্যের মূল মন্ত্র কী? ঋষি বলেন, ‘‘অবশ্যই পরিশ্রম।’’ পাশাপাশিই জানান, ছাত্রাবস্থায় কখনও কোনও নেশা করেননি। কখনও বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেটে সুখটানও দেননি। অন্য কোনও মাদক তো নৈব নৈব চ। ‘স্টার ওয়ার’ এবং ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের ভক্ত ছিলেন একটা সময়। আর শখ বলতে নিত্যনতুন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম কেনা। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা শেষ করে ‘গোল্ডম্যান স্যাক্স’-এ বিশ্লেষক হিসাবে কাজ করেছেন অর্থনীতির এই ছাত্র। সাউথ কেনিংটনে নিজের টাকায় সেই প্রথম বড় বাড়ি কিনেছিলেন ঋষি। কিছুটা অর্থসাহায্য অবশ্য বাবা-মাও করেছিলেন। চাকরির পাশাপাশি চলছিল এমবিএ। ২০০৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ঋষির আলাপ অক্ষতার সঙ্গে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির কন্যা অক্ষতা অর্থনীতির পাশাপাশি ফরাসি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ফ্যাশন ডিজ়াইনিংয়েও ডিপ্লোমা রয়েছে তাঁর। শোনা যায়, মেয়ের সঙ্গে ঋষির সম্পর্ক জানার পর নাকি প্রথমে খুশি হননি নারায়ণমূর্তি। তবে পরে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঋষির সঙ্গে মুখোমুখি আলাপের পর মনোভাব বদলে গিয়েছিল তাঁর।

বছর কয়েক চুটিয়ে প্রেম করার পর ২০০৯ সালে বিয়ে করেন ঋষি ও অক্ষতা। বেঙ্গালুরুতেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমন্ত্রিতের সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার। উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে-সহ বেশ কয়েক জন খ্যাতনামী। এখন স্ত্রী অক্ষতা, দুই কন্যা কৃষ্ণা ও অনুষ্কা এবং পোষ্য নোভাকে নিয়ে সুখের সংসার ঋষির। এখন ব্রিটেনের বিত্তবানদের মধ্যে অন্যতম তিনি। সুনক দম্পতির মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৭৩০ মিলিয়ন পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় ৬,৮০০ কোটি টাকারও বেশি।

মধ্য লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে ঋষির। পাঁচটি বেডরুম, চারটি স্নানঘর এবং বিশাল বাগান রয়েছে সে বাড়িতে। সঙ্গে একাধিক সুযোগসুবিধা। সেই বাড়ি থেকেই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যাবেন সুনক দম্পতি। রাজার দেশের ভার উঠবে ঋষির হাতে।

ঘটনাপ্রবাহ বলছে, প্রায় ৬০ বছর আগে তাঁর পূর্বপুরুষরা ব্রিটেনে গিয়েছিলেন রুজিরুটির খোঁজে। নিজের মেধা, পরিশ্রম দিয়ে সে দেশের পরিচালনার ভার এসেছে তাঁদের উত্তরপুরুষের হাতে। অভাবনীয়? না কি পরিশ্রমীদের কাছে তেমন অভাবনীয়ও নয়!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy