Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ককপিট-দরজা চালকের হাতে, বিপদ সেখানেও

আকাশে ছিনতাইয়ের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই তৈরি হয় বিমান ঘিরে নিরাপত্তার যাবতীয় খুঁটিনাটি ব্যবস্থা। সে জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বিমানের ককপিটের নিরাপত্তাকে। আর সেই ব্যবস্থাতেও যে অন্য ‘বিপদ’ রয়েছে, তা দেখিয়ে দিল জার্মানউইঙ্গস বিমানের দুর্ঘটনা। এয়ারলাইন্স কর্তাদের বক্তব্য, বিমান ছিনতাইয়ের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই ককপিটের দরজা ‘বুলেট-প্রুফ’ করা হয়।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

আকাশে ছিনতাইয়ের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই তৈরি হয় বিমান ঘিরে নিরাপত্তার যাবতীয় খুঁটিনাটি ব্যবস্থা। সে জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বিমানের ককপিটের নিরাপত্তাকে। আর সেই ব্যবস্থাতেও যে অন্য ‘বিপদ’ রয়েছে, তা দেখিয়ে দিল জার্মানউইঙ্গস বিমানের দুর্ঘটনা।

এয়ারলাইন্স কর্তাদের বক্তব্য, বিমান ছিনতাইয়ের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই ককপিটের দরজা ‘বুলেট-প্রুফ’ করা হয়। বাইরে থেকে গুলি করলেও সেই দরজার কোনও ক্ষতি হয় না। নিরাপত্তার খাতিরেই ককপিটের ভিতরে এমন ব্যবস্থা থাকে যে পাইলটের অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ ঢুকতে পারে না। দু’জন পাইলটের একজনও যদি ককপিটের বাইরে যান, তা হলে তাঁর ঢোকাটাও ককপিটের ভিতরে থাকা দ্বিতীয় পাইলটের মর্জির উপরে নির্ভর করে। ককপিটের ভিতরে এমন একটি লিভার রয়েছে, যা এক দিকে চেপে ধরে রাখলে বাইরে থেকে অন্য কারও ককপিটে ঢোকা অসম্ভব। পাইলটদের অনেকেরই ধারণা, দুর্ঘটনাগ্রস্ত জার্মানউইঙ্গস বিমানের কো-পাইলট ওই লিভারটি চেপে ধরে ছিলেন বলেই বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছে বুঝেও পাইলট বা অন্য কেউ ককপিটে ঢুকে তা আটকানোর চেষ্টা করতে পারেননি।

দক্ষিণ ফ্রান্সে লুফৎহানসা-র সহযোগী জার্মানউইঙ্গস বিমানের দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, বিমানটি ভেঙে পড়ার ঠিক আগে ককপিটে একা বসে বিমান চালাচ্ছিলেন কো-পাইলট। ককপিটের দরজার সুরক্ষা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে প্রধান পাইলটকে তিনি ঢুকতেই দেননি ভিতরে। বিমান সোজা আছড়ে পড়েছে পাহাড়ের কোলে। মারা গিয়েছেন দেড়শো মানুষ।

পাইলটরা বলছেন, প্রতিটি ককপিটের দরজার বাইরে একটি নম্বর-বোর্ড থাকে। সেই ককপিটে ঢোকার একটি নির্দিষ্ট ও গোপনীয় কোড নম্বর থাকে। যে নম্বর ওই বিমানের দুই পাইলট এবং মুখ্য বিমানসেবিকার কাছে থাকে। ককপিটে পাইলটদের কফি-জলের প্রয়োজন হলে প্রথমে বাইরের ওই নম্বর বোর্ডে থাকা একটি বেল বাজান বিমানসেবিকারা। কখনও আবার কেবিন থেকে ফোন করে ককপিটে ঢোকার অনুমতি চান। তাঁরা ওই কোড ব্যবহার করেন না। ককপিটের লিভারের এক দিকে থাকে ‘আনলক’, অন্য দিকে থাকে ‘লক’ বা ‘ওভাররাইড’। মাঝে থাকে ‘নরম্যাল’ বা ‘নিউট্রাল’। লিভার সব সময় নরম্যাল বা নিউট্রাল অবস্থায় থাকে। দরজা খোলার দরকার হলে লিভারটি ‘আনলক’ অবস্থানে আনা হয়। লিভার ছেড়ে দিলে স্প্রিং থাকায় তা ফিরে যায় নিউট্রাল-এ।

‘ওভাররাইড’ বা ‘লক’ ব্যবস্থাটা তা হলে কী?

জার্মানউইঙ্গস-এর যে বিমানটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছে, সেটি একটি এয়ারবাস ৩২০। ওই ধরনের বিমান চালানোয় অভ্যস্ত ক্যাপ্টেন জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “বিমানে ছিনতাইবাজরা যদি প্রধান বিমানসেবিকার মাথায় বন্দুক ধরে, তা হলে তার কাছ থেকে কোড নম্বর জেনে নিয়ে তারাও ককপিটে ঢুকতে পারে। এবং সহজেই বিমানের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেতে পারে। এটা আটকাতেই ওই ‘ওভাররাইড’ ব্যবস্থা। কেউ কোড নম্বর ব্যবহার করলেই ককপিটের ভিতরে আলো জ্বলে উঠবে। ককপিটে রাখা একটি মনিটরে ফুটে উঠবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির ছবি। পাইলট তখন সেই লিভার ব্যবহার না করলেও দরজা কয়েক সেকেন্ড পরে আপনাআপনি খুলে যাবে। কিন্তু মনিটরে যদি পাইলট দেখেন বাইরে সন্দেহজনক কেউ রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে লিভারটি ‘ওভাররাইড’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে, কোড নম্বর ব্যবহার করলেও আর দরজা খোলা সম্ভব হবে না। ককপিটের ভিতরে থাকা পাইলট কিংবা কো-পাইলটই একমাত্র পারেন ওভাররাইড ব্যবস্থা থেকে ককপিটের দরজা খুলতে।”

মনে করা হচ্ছে, অভিশপ্ত বিমানের ককপিটে থাকা কো-পাইলটও ওই ‘ওভাররাইড’ জায়গায় নিয়ে গিয়ে চেপে ধরেছিলেন লিভার। ছেড়ে দিলেই সেই লিভারের নিউট্রাল অবস্থায় ফিরে আসার কথা ছিল। যার অর্থ, অন্য পাইলট যাতে ককপিটে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে কো-পাইলট আটকে রেখেছিলেন দরজা।

ককপিটে একা থাকার সময়ে যদি আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন পাইলট? যদি তাঁর হাতের চাপে লিভার ‘ওভাররাইড’ জায়গায় আটকে যায়, তখন?

পাইলট ক্যাপ্টেন সর্বেশ গুপ্ত-র কথায়, “ভারতে নিয়ম রয়েছে, এক জন পাইলট কোনও কারণে ককপিট থেকে বাইরে এলে, বেরনোর সময়ে যে কোনও একজন বিমানসেবিকাকে ককপিটে রেখে যাবেন। এই নিয়ম না মানলে শাস্তি অবধারিত। ককপিটে একা থাকার সময়ে অন্য পাইলট অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন দরজা খুলে দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা মেনে চলি।” আমেরিকার পাইলটেরাও এই নিয়ম মানেন। কিন্তু, ইউরোপের পাইলটেরা অনেক ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানেন না বলেই পাইলটদের সূত্রের খবর। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির ককপিটে পাইলটের অনুপস্থিতিতে একজন বিমানসেবিকা থাকলে কখনওই এমনটা ঘটত না বলে মনে করেন এ দেশের পাইলটেরা।

একজন পাইলট কি চাইলে এই ভাবে মেরে ফেলতে পারেন যাত্রীদের?

জয়দীপ বলেন, “মধ্যমগ্রামের দিক থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নামার সময়ে বিমানের গতি থাকে ঘণ্টায় আড়াইশো কিলোমিটার। প্রতি মিনিটে এক হাজার ফুট করে নামতে থাকি। সেই সময়ে আমি সোজা গোঁত্তা খেয়ে নীচের দিকে ঝাঁপালে মাটিতে নামতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে! কেউ বাঁচাতে পারবে না! সঙ্গে কো-পাইলট থাকলেও নয়।”

জার্মানউইঙ্গসের ঘটনার পরে কি ককপিটের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পাইলটের হাত থেকে নিয়ে অন্য কারও হাতে দেওয়া উচিত? উত্তরে সরাসরি না বলছেন বেশির ভাগ পাইলট এবং বিমান সংস্থার কর্তাই। এক বিমান সংস্থার শীর্ষ কর্তার কথায়, “পাইলটের হাতেই থাকে বিমানের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ। তা কেড়ে নিলে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে।” তাঁর যুক্তি, যাত্রীবোঝাই বিমান নিয়ে পাইলট মরণঝাঁপ দিচ্ছেন, এমন ঘটনা খুব বেশি শোনা যায়নি। পাইলটেরা বলছেন, এমন মাত্র দু’টি ঘটনার কথা তাঁরা জানেন। ১৪ বছর আগে সিঙ্গাপুর এয়ালাইন্সের একটি বিমান এবং বছর পাঁচেক আগে আফ্রিকার একটি বিমানের ক্ষেত্রে এমন ঘটেছিল।

এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার জন্য কী করা উচিত?


স্মরণ। বৃহস্পতিবার জার্মানির কোলন-বন বিমানবন্দরে। ছবি: রয়টার্স।

পাইলটরা বলছেন, পুরো বিষয়টা ব্যক্তিবিশেষের নির্দিষ্ট সময়ের মানসিক অবস্থার উপরে নির্ভর করে। তবে ককপিটের মধ্যে পাইলট এবং কো-পাইটের একজনের অনুপস্থিতির সময়ে একজন বিমানসেবিকার উপস্থিতি সর্বত্র বাধ্যতামূলক করা হলে অন্তত জার্মানউইঙ্গস-এর মতো পরিণতি অনেকাংশেই ঠেকানো যাবে বলে অভিমত এ দেশের পাইলটদের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE